ইউরোপের পথে লিবিয়ায় নতুন রুট ব্যবহার করছে মানবপাচারকারীরা

অন্যতম হোতা হাজী কামাল গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বল্প খরচে ইউরোপে পাঠাতে লিবিয়ার রুটটি ব্যবহার করে থাকে দালালচক্র। আর কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পৌঁছতে ব্যবহার করা হয় নিত্যনতুন রুট। লিবিয়াতে মানবপাচারের নতুন রুটের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বিশেষ বাহিনীর ভাষ্যমতে, বর্তমানে চক্রটি বাংলাদেশ থেকে কলকাতা, মুম্বাই, দুবাই, মিশর, বেনগাজি হয়ে ত্রিপোলিতে অবৈধভাবে লোক পাঠাচ্ছিল। সেখান থেকে সমুদ্রপথে শুরু হতো ইউরোপ যাত্রা।

মানবপাচার চক্রের মূলহোতা মো. কামাল উদ্দিন ওরফে হাজী কামালকে গ্রেফতারের পর আজ সোমবার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় র‌্যাব। 

র‌্যাব-৩ জানায়, অবৈধভাবে ইউরোপে পাঠানোর সময় সম্প্রতি লিবিয়ার মিজদাহ শহরে গত ২৮ মে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয় ২৬ বাংলাদেশী। ওই ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন আরো ১১ বাংলাদেশী। ঘটনার সঙ্গে জড়িত চক্রের অন্যতম মূলহোতা এই হাজী কামাল। লিবিয়ায় নিহতের ঘটনায় মাদারীপুরের রাজৈর থানা এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় মানবপাচার বিরোধী আইনে ২টি মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগীর স্বজনেরা। ওই মামলার তদন্তে সোমবার ভোর ৫টায় রাজধানীর শাহজাদপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তার হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট ও জাল ভিসা। 

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, হাজী কামাল বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর যাবত এই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি বিদেশী চক্রের যোগসাজশে অবৈধভাবে বাংলদেশী নাগরিকদের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে আসছে। তিনটি ধাপে তারা অবৈধভাবে মানবপাচারের কাজটি করে থাকে। ধাপগুলো হলো:

বিদেশে গমন ইচ্ছুক নির্বাচন
এই চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে থাকে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। এই বিদেশ গমনেচ্ছুদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় ইত্যাদি কার্যাবলী এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পরবর্তীতে তাদের এককালীন টাকা বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে ইউরোপের পথে পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিস্তি নির্ধারণ করে থাকে। ইউরোপ যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা নিয়ে থাকে। এর মধ্যে ৫ লাখ টাকা লিবিয়ায় যাওয়ার আগে এবং বাকি ৩ লাখ টাকা লিবিয়ায় গিয়ে পরিশোধ করতে হয়। 

বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায়
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চক্রের সদস্যরা বেশ কয়েকটি রুট ব্যবহার করে থাকে। রুটগুলো তারা সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী মাঝে মধ্যে পরিবর্তন অথবা নতুন রুট নির্ধারণ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়া যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ-কলকাতা-মুম্বাই-দুবাই-মিশর-বেনগাজি-ত্রিপোলি রুটটি ব্যবহার হয়ে আসছিল। দুবাইয়ে পৌঁছে তাদেরকে বিদেশী এজেন্টদের তত্ত্বাবধানে সপ্তাহখানেক অবস্থান করানো হয়। এসময়ের মধ্যে ‘মারাকাপা’ নামের একটি ডকুমেন্ট বেনগাজি থেতে দুবাইতে পাঠানো হয়। যা দুবাইয়ে অবস্থানরত বিদেশী এজেন্টদের মাধ্যমে ভিকটিমদের হস্তান্তর করা হয়। পরে ওই ডকুমেন্টসহ বিদেশী এজেন্ট তাদেরকে মিশর ট্রানজিট নিয়ে বেনগাজি পাঠায়। বেনগাজিতে বাংলাদেশী এজেন্ট তাদেরকে ত্রিপোলিতে স্থানান্তর করে।

লিবিয়া থেকে স্বপ্নের ইউরোপ
ভিকটিমরা ত্রিপোলিতে পৌঁছানোর পর সেখানে কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকে। তাদেরকে ত্রিপোলিতে বেশ কয়েকদিন রাখা হয়। এসময় এজেন্টদের দেশীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে ভিকটিমের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে। পরে ভিকটিমদের ত্রিপোলির বন্দর এলাকায় একটি সিন্ডিকেটের কাছে অর্থের বিনিময়ে ইউরোপে পাচারের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করা হয়। ওই সিন্ডিকেট তাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে সমুদ্রপথ অতিক্রম করার জন্য নৌ-যান চালনা এবং দিক নির্ণয়যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুসঙ্গিক বিষয়ে নানাবিধ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোর রাতে এক সঙ্গে কয়েকটি নৌ-যান লিবিয়া হয়ে তিউনিশিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন