ছয় মাসও টিকল না দুই চেয়ারম্যানের নির্মিত বাঁধ

বণিক বার্তা প্রতিনিধি খুলনা

৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে হরিণখোলা ২নং কয়রায় ৩৬০ মিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের ঠিকাদার ছিলেন কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর। কিন্তু এসব বাঁধ নির্মাণের মাত্র তিন মাসের মাথায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বিলীন হয়ে গেছে। একই অবস্থা ঘাটাখালীতে ছয় মাস আগে নির্মিত ৬০০ মিটার বেড়িবাঁধের। ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধের ঠিকাদার ছিলেন কয়রা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম। স্থানীয়দের অভিযোগ, কোটি টাকা ব্যয় হলেও এসব বাঁধ কোনো কাজে আসেনি। তবে দুই চেয়ারম্যানের দাবি, তাদের নির্মিত বাঁধের কোনো ক্ষতিই হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে খুলনার কয়রা উপজেলা সুরক্ষায় ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার জলোচ্ছ্বাসের আঘাতেই বেড়িবাঁধ নড়বড়ে হয়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে এসব বাঁধ জরুরি মেরামতকাজের আওতায় সংস্কার করা হয়। চলতি অর্থবছরেই এর আওতায় ঘাটাখালী, হরিণখোলা ২নং কয়রায় তিনটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে মোট ব্যয় হয় কোটি লাখ টাকা। দরপত্র ছাড়াই স্থানীয় বিবেচনায় এসব কাজের ঠিকাদারির দায়িত্ব দেয়া হয় এসএম শফিকুল ইসলাম হুমায়ুন কবীরকে। এর মধ্যে ঘাটাখালীর কাজ ছয় মাস আগে এবং বাকি দুটির কাজ তিন মাস আগে শেষ হয়। গত ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে সব বাঁধই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে স্থানীয়রাই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এসব বাঁধ আবার সংস্কার শুরু করে।

গোলখালী গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ঘাটাখালীতে নির্মিত বাঁধের উচ্চতা নির্ধারিত সীমার চেয়ে তিন ফুট কম ছিল। ৩০ ফুটের স্থলে পাঁচ-সাত ফুট চওড়া করে বাঁধ বানানো হয়েছিল। তখন এসব অনিয়ম বন্ধ করে সঠিকভাবে কাজ করানোর জন্য পাউবোকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। ফলে এখন আম্পানের আঘাতে ওই বাঁধ ভেঙে গেছে। আর ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

উপজেলা উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কয়রা উপজেলায় জরুরি কাজের নামে যে কয়টি বাঁধ মেরামত করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই আম্পানের আঘাতে ভেঙে গেছে। কয়রায় আসলে বেড়িবাঁধে জরুরি কাজের নামে অর্থ লুটপাট হয়েছে। বেড়িবাঁধ কয়রার মানুষের আদতে কোনো উপকারই হয়নি।

ব্যাপারে কয়রা সদর ইউপির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর বলেন, পাউবোর বোর্ডের নির্দেশনা পেয়েই তিনি কাজ করেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওই কাজের অর্থ তিনি পাননি। আর বাঁধের যে স্থানে তিনি কাজ করেছিলেন, সে স্থান ঠিকই আছে। আম্পানে ওই বাঁধের অন্যত্র দুর্বল স্থান থেকে ভেঙে গেছে। তার করা বাঁধ এখনো ঠিক আছে।

কয়রা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, যেখানে তিনি কাজ করেছিলেন, সেখানে বাঁধের কোনো ক্ষতিই হয়নি। ঘাটাখালীতে অন্য স্থানে ভেঙে গেছে।

জানতে চাইলে পাউবো কয়রার এসও মশিউল আবেদিন বলেন, কয়রা সদর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের তিনটি পয়েন্টে জরুরি মেরামত কাজ করা হয়েছে। ঘাটাখালী বাঁধের কাজ ছয় মাস আগে শেষ হয়। আর হরিণখোলা ২নং কয়রার বাঁধের কাজ তিন মাস আগে শেষ হয়েছে। আম্পানের আঘাতে তিনটি বাঁধই ভেঙে গেছে।

তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানায় ঘাটাখালীতে মসজিদসংলগ্ন এলাকায় পৃথকভাবে ৩০০ মিটার করে ৬০০ মিটার কাজ করা হয়, যা এসএম শফিকুল ইসলাম করেন। কাজের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে তিনি তার কাজের ৪০ শতাংশ বিল পেয়েছেন। আর হরিণখোলা ২নং কয়রার কাজ করেছেন হুমায়ুন কবীর। হরিণখোলার কাজের জন্য ২২ লাখ টাকা ২নং কয়রার কাজের জন্য ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। ২নং কয়রার ২১০ মিটারের স্থলে ৬০ মিটার কাজ করা হয়েছিল।

তিনি আরো জানান, আম্পানের আঘাতে কয়রার ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৪০ কিলোমিটার কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে আট কিলোমিটার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে কয়রায় বাঁধ মেরামতের জন্য ২৫০ কোটি টাকার চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে। তবে আগেও কয়রার বাঁধ মেরামত করার জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তখন অতি জরুরি কাজ ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে করে নেয়ার জন্য বলা হয়েছিল।

তিনি বলেন, জরুরি মেরামতের জন্য টেন্ডারের প্রয়োজন হয় না। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাজ করার মতো ঠিকাদারকে দায়িত্ব দেয়া হয়, যা বোর্ডের কার্যক্ষমতায় রয়েছে। ঠিকাদার বাছাইয়ের একক ক্ষমতা তাদেরই দেয়া আছে। আর জরুরি ভিত্তিতে কাজ করলেই ঠিকাদার তার সমুদয় পাওনা পেয়ে যান না। ঢাকা থেকে পর্যবেক্ষণ টিম আসে। তারা সরেজমিন পরিদর্শন করার পর প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে কোনো ধরনের আপত্তি না হলে অর্থবছর শেষে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার টাকা পান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন