‘কিছু হয়নি অর্থাৎ আমরা কিছু হওয়া থেকে বাঁচিয়েছি’

জার্মানির বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ক্রিস্টিয়ান ডোরস্টেন। নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রশংসা যেমন পেয়েছেন, সমালোচিতও হয়েছেন। করোনা মোকাবেলায় জার্মানির সাফল্যের পেছনে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্প্রতি কভিড-১৯ নিয়ে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা সামনের দিনগুলোতে মহামারী মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে ডার স্পিয়েগেলকে একটি সাক্ষাত্কার দিয়েছেন তিনি। সেই সাক্ষাত্কারের চুম্বকাংশ সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হলো

 ডার স্পিয়েগেল: করোনা সংকটের শুরুতে আপনি স্বেচ্ছায় সামনে এগিয়ে এসেছিলেন, কেন?

ডোরস্টেন: আমি চাইনি পরবর্তী সময়ে মানুষ আমাকে এই বলে দায়ী করুক যে সময়মতো আমি সতর্কবার্তা দিতে পারিনিমানে ভাইরাসের আক্রমণে মানুষও মারা যেতে পারে। এছাড়া মহামারী সম্পর্কে তাদের আর কে ব্যাখ্যা করতে পারত? করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করা একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব ছিল।

ডার স্পিয়েগেল: আপনাকে ছাড়া মহামারী নিয়ে জার্মানির প্রস্তুতি কি আরো খারাপ হতো?

ডোরস্টেন: হ্যাঁ, অবশ্যই। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক পেয়েছি, যেখানে তারা টেস্ট করেছে। তারা নিয়মিত অন্য ল্যাবগুলোর সঙ্গে তাদের জ্ঞান উপকরণ ভাগাভাগি করেছে। ওই সময়েই জার্মানি সার্স-কোভ--এর নিয়মিত পরীক্ষা শুরু করতে পেরেছিল, যা অন্য দেশগুলো কদাচিৎই পেরেছে। কার্নিভালের সময়ে আমরা আমাদের প্রথম করোনা রোগী পেয়েছিলাম, যে কিনা আক্রান্ত কোনো অঞ্চলে ভ্রমণ করেনি। কেউ জানত না সে কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে। সে সময় একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল যে জার্মানিতে অগোচরেই ভাইরাস তখন ছড়িয়ে পড়েছে।

স্পিয়েগেল: এটা কি কখনো না কখনো অবশ্যম্ভাবীরূপে ঘটত না?

ডোরস্টেন: হ্যাঁ, কিন্তু এক মাস পরই ইতালি, স্পেন ব্রিটেনে মৃতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আক্রান্ত হওয়ার পর আইসিইউতে গিয়ে মারা যেতে সময়টা নিয়েছিল। কিন্তু সময়ের মাঝে আমার ল্যাবরেটরি জার্মানিকে টেস্ট করার মাধ্যমে এগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কারণে আমরা নিজেদের আজ ভালো অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। আমরা বিজ্ঞানীরা যদি রাজনীতিবিদদের না জানাতাম আজ মৃতের সংখ্যা জার্মানিতে ৫০ হাজার থেকে লাখে গিয়ে ঠেকত।

স্পিয়েগেল: এখন আপনার সঙ্গে জার্মানির সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ট্যাবলয়েড বিল্ড-এর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তারা আপনার বিরুদ্ধে ভুল গবেষণার অভিযোগ এনেছে...

ডোরস্টেন: আমার কি ভয় পাওয়া উচিত? আমি মনে করি না। আমি শেষবার বিল্ড পড়েছিলাম বরিস বেকার উইম্বলডন জেতার পর যখন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা হয়েছিল। বিল্ড আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ না। আমার আশপাশের কেউ বিল্ড পড়ে না। তাই সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না।

স্পিয়েগেল: সপ্তাহে তারা সংক্রামক শিশুদের নিয়ে আপনার গবেষণা মারাত্মকভাবে ভুল ছিল অভিযোগ করে শিরোনাম করেছে।

ডোরস্টেন: এটা হতে পারে, যেসব পাঠক কেবল বিল্ড পড়েন তারা বিশ্বাস করেন যে ডোরস্টেন একজন খারাপ বিজ্ঞানী। আমি দেশের ভাগ্যকে ভুল পথে পরিচালিত করেছি এবং অন্যান্য যেসব গালগল্প চলছে, তার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু বিজ্ঞানী হিসেবে আমার সুনাম নষ্ট করতে চাইলে অন্য বিজ্ঞানীদের বিল্ড যা লিখেছে তা বিশ্বাস করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে আমি কেবল অন্যদের সমর্থনই পেয়েছি।

স্পিয়েগেল: আপনাদের গবেষণার মূল বিষয় ছিল শিশুরা বয়স্কদের মতো সংক্রামক কিনা। যার উত্তরের ওপর স্কুল এবং ডে কেয়ার সেন্টার খোলার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছিল।

ডোরস্টেন: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে টেকসই গবেষণার অভাব রয়েছে এবং স্কুল বন্ধ থাকলে এমন গবেষণা সম্ভব নয়। যে কারণে আমরা সংক্রমিত শিশুদের পরীক্ষা করেছি। যা কিনা তারা কত বেশি সংক্রামক তার একটি ইঙ্গিত দিতে পারে।

স্পিয়েগেল: প্রশ্ন হচ্ছে, শিশুরা কি বয়স্কদের মতো সংক্রামক?

ডোরস্টেন: আমাদের ডাটা বলছে, কিছু শিশু যাদের উপসর্গ নেই তারা বয়স্কদের মতো সংক্রামক হতে পারে। পরিসংখ্যানবিদদের কাছ থেকে এমন অনেক পরামর্শ পেয়েছি, যেগুলো বেশ মূল্যবান ছিল। আমরা এখন গবেষণা পুনর্মূল্যায়ন করে দ্রুত প্রকাশের জন্য জমা দেব। আমরা একজন সমালোচককেও বোর্ডে রেখেছি। কিন্তু গবেষণার ফল পুনর্বিবেচনায় পরিবর্তিত হয়নি।

স্পিয়েগেল: অনেক মানুষ মনে করে আসলে কিছু হয়নি।

ডোরস্টেন: প্রতিরোধ কিছুটা প্যারাডক্সের মতো। কিছু হয়নি অর্থাৎ আমরা কিছু হওয়া থেকে বাঁচিয়েছি।  

স্পিয়েগেল: এখান থেকে এখন কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যাবে?

ডোরস্টেন: আমরা মুহূর্তে খুব ভালো অবস্থায় আছি। শাটডাউন অনেকটাই উঠে গেছে। ধীরে ধীরে বাকি সবও খুলে যাবে। এখানে তাত্ক্ষণিকভাবে মহামারী বিকশিত হতে পারেনি। এটা হতে পারে যে ভাইরাস একটা সময়ের জন্য আমাদের একা রেখে গেছে।

স্পিয়েগেল: কতদিনের জন্য?

ডোরস্টেন: সবসময়ের জন্য না। কিন্তু সম্ভবত আমরা দ্বিতীয় শাটডাউন এড়িয়ে যেতে পারব। শুরুতে আমাদের সব ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল কারণ আমরা নিশ্চিত ছিলাম না কী আমাদের সাহায্য করবে। কিন্তু এখন আমরা ভাইরাস সম্পর্কে ভালোভাবেই জানি। আমরা জানি এটা কীভাবে ছড়ায়।

স্পিয়েগেল: স্কুল ডে কেয়ার সেন্টার খোলার ব্যাপারে কী হবে?

ডোরস্টেন: এগুলো খুলে দিতে হবে। যদিও আমরা জানি না শিশুরা আসলে কতটা সংক্রামক। আমাদের দেখতে হবে বড় প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তা। নয়তো বড় প্রাদুর্ভাব নিশ্চিতভাবে আসতে পারে।

স্পিয়েগেল: চার্চে যাওয়া এবং বড় পার্টিগুলো কি আগামী কয়েক মাস বন্ধ রাখতে হবে?

ডোরস্টেন: পার্টি হতে পারে যদি তা বাইরে আয়োজন করা যায় এবং খুব বেশি মানুষ যুক্ত না থাকে।

স্পিয়েগেল: আগামী বসন্তে কি ভ্যাকসিন সমস্যার সমাধান করতে পারে?

ডোরস্টেন: আমি নিশ্চিত তখন একটি ভ্যাকসিনও আসবে না। জার্মানির বাস্তবতা রকম। কিন্তু আমরা ভ্যাকসিনের পথে ভালোভাবেই আছি।

স্পিয়েগেল: কিন্তু এটি আসার আগে শীত আসবে। তখন কি ভাইরাস ফিরে আসতে পারে?

ডোরস্টেন: হ্যাঁ। এটা বোঝা যাচ্ছে যে তাপমাত্রার একটা প্রভাব আছে। প্রশ্ন হচ্ছে এটি কীভাবে আসে। সম্ভবত শীতে মানুষ একটি ঘরে একত্র হলে সেখান থেকে। কিন্তু আমরা হয়তো গ্রীষ্মের মধ্যে প্রস্তুত হতে পারব। নতুনভাবে টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করে এবং আউটব্রেক ট্র্যাক করার পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়ে আমরা তা করতে পারি।

স্পিয়েগেল: নয়তো কি দ্বিতীয় ঝড় আসতে পারে?

ডোরস্টেন: সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ অনেক মানুষকে সংক্রমিত করার জন্য আমাদের অল্প কজন মানুষ দরকার।

স্পিয়েগেল: এই মহামারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি কি, যার উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।

ডোরস্টেন: সেটি হচ্ছে কেন শিশুদের কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। আরেকটি হচ্ছে কোন ভ্যাকসিনটি সেরা?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন