বিশ্লেষণ

আমেরিকার করোনাকালীন নগরবিরোধী রাজনীতি

ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ

আমেরিকায় ইদানীং করোনাভাইরাস সংক্রামক ব্যাধির জন্য চীন ছাড়াও আরেকটি বিষয়কে ভীষণভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। সেটা হচ্ছে নগরের ঘনবসতি। অনেক মানুষ নগর এলাকায় বসবাস করায় যেহেতু সামাজিক দূরত্ব তৈরি করা সম্ভব নয়, সেহেতু মানুষ থেকে মানুষে করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অভিযোগটির কেন্দ্রভূমি নিউইয়র্ক সিটির দিকে তাকানো যাক, অনেক বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন যে শহরের জনঘনত্বের কারণেই এখানে কভিড-১৯- আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে (মে ১৬ তারিখের তথ্য অনুযায়ী ২০,০০০ জন) এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নগরের উচ্চ জনঘনত্ব প্রায়ই আলো-বাতাসহীন, স্যাঁতসেঁতে, রোগজীবাণু-সংক্রমণ উপযোগী অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে. আপাতদৃষ্টিতে এটা ঠিক মনে হতেই পারে। নিউইয়র্ক শহরের জনঘনত্ব আমেরিকায় সবচেয়ে বেশিপ্রতি বর্গমাইলে গড়ে ২৮ হাজার জন মানুষ, যদিও নিউইয়র্ক শহরের একটি বরো বা প্রশাসনিক বিভাগ, ম্যানহাটনে এটা ৭০ হাজারের ওপরে (নিউইয়র্ক শহরকে পাঁচটি বরোতে ভাগ করা হয়েছেম্যানহাটন, কুইন্স, ব্রুউক্লিন, ব্রংক্স আর স্টাটেন আইল্যান্ড)

নগরের জনঘনত্বকে মহামারীর মৃত্যুমিছিলের জন্য দোষারোপ করা যাবে কিনা, সেই বিতর্কে পরে আসছি। জনঘনত্বই রোগ সংক্রমণের জন্য দায়ী অভিযোগের পেছনে যে রক্ষণশীল রাজনীতি কাজ করে, তার কারণে এক নতুন প্রজন্মের বর্ণবাদী আর অর্থনৈতিক শ্রেণীভিত্তিক সামাজিক বিভক্তি তৈরির ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। নগর মানেই অনেক মানুষের একসঙ্গে বসবাস। এখানে অনেক ভাবধারার সম্মিলন ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই নগরে উদারপন্থী রাজনীতির বিকাশ ঘটে সহজেই। কাজেই নগরবাসীকে যদি বিভিন্ন স্ববিরোধী গোষ্ঠীতে ভাগ করে দেয়া যায়, তাহলে স্বার্থান্বেষী, অতিরক্ষণশীল রাজনীতির ক্ষেত্র বিস্তার হয়। এসব কারণে করোনাভাইরাসকেন্দ্রিক ডানপন্থী রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কগুলো নগরবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম দিচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক নিউইয়র্কবাসী তাদের প্রিয় শহর ছেড়ে অনেক কম জনঘনত্বের সাবারব বা উপশহরে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে করোনা-পরবর্তী নগরায়ণ আলোচনায় নগর নয়, উপশহরই নীতিনির্ধারণী গুরুত্ব পাবে।

নিউইয়র্কের উচ্চজনঘনত্বই কি এখানে অনেক করোনাজনিত মৃত্যুর জন্য দায়ী? অন্য কয়েকটি তুলনীয় উদাহরণের দিকে তাকানো যাক, হংকংয়ের নগর জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ১৮ হাজার ৪৯২ জন, যদিও এখানকার কিছু জায়গায়, যেমন মং কক এলাকা, জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে লাখ ৩০ হাজার জনের ওপরে। হংকংয়ের এসব এলাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ। কিন্তু এখানে নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কেমন? মাত্র হাজার ৫৩ সংক্রমণ, আর মৃত্যু ৪। অথচ হংকং মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে মাত্র ৫৭১ মাইল দক্ষিণে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল আর জাপানের রাজধানী টোকিওর জনঘনত্ব ম্যানহাটনের মতোই। তাহলে প্রশ্ন হলো, নিউইয়র্ক সিটিতে করোনাজনিত মৃত্যুমিছিল হলো, কিন্তু হংকং, সিউল আর টোকিওতে হলো না কেন? হংকংয়ের কথাই ধরা যাক, ২০০৩ সালে এখানে সার্স মহামারী ২৯৯ জনের প্রাণ নিয়েছিল। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে হংকং মহামারী প্রস্তুতি আর প্রতিরোধের লক্ষ্যে তৈরি করেছিল একটি বিশাল জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো। আর শুরু করেছিল ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার একটি সামাজিক আন্দোলন। ২০২০ সালে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হংকংয়ের পূর্বপ্রস্তুতির ফলাফল কিছুটা প্রত্যাশিত ছিল।

নিউইয়র্ক শহরের কিছু জায়গায় কীভাবে দারিদ্র্য, জনবিচ্ছিন্নতা, বর্ণবাদী সামাজিক দেয়াল, আর অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা নিম্নবিত্তের মানুষদের সহজেই মহামারীর শিকার করে তোলে, তা না বুঝে শুধু জনঘনত্বকে, মানুষের ভিড়কে দোষারোপ করলে নগরে করোনা আক্রমণকে কৃত্রিমভাবে সরলীকরণ করা হবে। নিউইয়র্ক শহরের সবচেয়ে দরিদ্র বরো ব্রংক্সের কথা ধরুন, ব্রংক্সের দরিদ্রতার হার ২৮ দশমিক , যেখানে নিউইয়র্ক শহরের অন্যান্য বরোর হার ১৮ দশমিক ৪। ব্রংক্সের জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ অভিবাসী। বার্ষিক গড় পারিবারিক উপার্জন মাত্র ৩৮ হাজার ডলার; যা অন্যান্য বরোর তুলনায় অনেক কম। ব্রংক্সের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে এখানকার নিম্নবিত্তের মানুষদের অনুভূতি রকম: বস্তিবাসীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা মানে অনেক লম্বা লাইন, নিজেদের মনে হয় পরিত্যক্ত কুকুর। অন্যান্য বরো থেকে এখানে দ্বিগুণ হারে করোনা-আক্রান্ত রোগী মারা গেছে।

১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ থেকে আসা মোহাম্মদ জাফরের মর্মান্তিক গল্পটা শুনুন। নিউইয়র্ক শহরের প্রতীকী হলুদ রঙের ট্যাক্সির চালক জাফর এই ব্রংকসের একটি ছোট্ট ঘরে থাকতেন তার নিম্নবিত্ত পরিবার নিয়ে। তার অত্যন্ত মেধাবী ছেলে হার্ভার্ডে অর্থনীতি আর ইতিহাসের ছাত্র। পুরো স্কলারশিপ দিয়ে পড়ছে। সাত বছরের মেয়ে বিখ্যাত আর অত্যন্ত দামি ট্রিনিটি স্কুলে পড়ছে  স্কলারশিপ পেয়ে। জাফর ট্যাক্সি চালিয়ে আমেরিকার স্বপ্নপূরণ করে যাচ্ছিলেন। গত এপ্রিল জাফর করোনা রোগে মারা গেছেন। ২০১৬ সালে, যে বছর তার ছেলে হার্ভার্ডে যাত্রা শুরু করেছিল, সে বছরই তার স্ত্রী ক্যান্সারের শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। জাফরের ছেলেমেয়ে আজ এতিম। ব্রংক্স তাদের জন্য এখন নিস্তব্ধ। একটা শহরের মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে শুধু তার জনসংখ্যার ঘনত্বকে দোষারোপ করলে নগরের বহুমাত্রিক, জটিল সামাজিক সমস্যাগুলো কখনই বোঝা যাবে না।

ইদানীংকার নগর জনঘনত্ববিরোধী চেতনা আসলে নগরবিরোধী চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকার রক্ষণশীল রাজনীতিতে এর একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন আমেরিকা নগর জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল, তখন রক্ষণশীল রাজনীতিবিদরা নগরায়ণকে আমেরিকার নৈতিক অধঃপতনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু করল। জন বুনইয়ানের সপ্তদশ শতাব্দীর বাইবেলীয় গল্প পিলগ্রিমস প্রগ্রেসের রক্ষণশীল আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা বলল, নগর হচ্ছে পাপের স্থান, এখানে মানুষ বিপথগামী, বেপরোয়া আর অসৎ জীবনযাপনে উৎসাহী হয়। নগর উগ্র বিপ্লববাদিতা উসকে দেয়। নগর হচ্ছে ভয়ংকর জায়গা, যেখানে জেফার্সনীয় গ্রামীণ সততার মৃত্যু ঘটে। মানুষে ঠাসা নগরগুলোয় অলস দরিদ্ররা সরকারি অনুদানেই চলে আর নোংরা অভিবাসীরা বিশুদ্ধ মার্কিন শরীরকে কলুষিত করে। উগ্র রক্ষণশীল সারা পেইলিন বলেন, সত্যিকারের আমেরিকা খুঁজে পাওয়া যাবে গ্রামে, উদারপন্থীদের তীর্থকেন্দ্র শহরে নয়।

আমেরিকার রাজনীতি অনেকটাই পরিচালিত হয় শহর-গ্রামের ফল্ট লাইন ধরে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৮ সালের গবেষণা অনুযায়ী, ডেমোক্র্যাটদের শতকরা ৬২ ভাগ থাকে শহরে আর রিপাবলিকানদের ৫৪ ভাগ থাকে গ্রামীণ এলাকায়। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৬ সালের নির্বাচনে শতকরা ৬২ ভাগ গ্রামীণ রিপাবলিকান ভোট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিততে সাহায্য করেছিল। নগরকেন্দ্রিক অভিবাসীরা আমেরিকার মূল্যবোধ নষ্ট করে দেয় কিনা, রকম একটি প্রশ্নের জবাবে শতকরা ৭৮ ভাগ গ্রামীণ রিপাবলিকান বলেছে, হ্যাঁ। উত্তরটির রাজনৈতিক উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে রক্ষণশীল নগর বিরোধিতায়, অভিবাসনবিরোধী ইতিহাসে, বুদ্ধিজীবী বিরোধিতায়, আর শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বর্ণবাদী তত্পরতায়।

নভেল করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে আমেরিকায় নগরবিরোধী প্রচারণা নগর প্রশাসনকে ভুলিয়ে দিতে পারে যে নগরের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করতে হবে। ঘনজনবসতির নগরকে ভাইরাস সংক্রমণের স্বর্গরাজ্য বলা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্বকে এক ধরনের পলিসিতে পরিণত করে নগরের জনঘনত্ব কমানোর নামে আসলে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে, যেটাকে আমেরিকার বিখ্যাত লেখিকা জেইন জ্যাকবস বলেছেন, উইয়ার্ড উইজডম বা নগরের অদ্ভুত জ্ঞান, যেটা ধীরে ধীরে সামাজিকভাবে তৈরি হয়, যখন অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকে, যখন একটি পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিবেশী সংস্কৃতি তৈরি হয়। নগর অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ফ্লোরিডা বলেছেন, নগর সংস্কৃতির এই স্বকীয় জ্ঞানই সব পেশার সৃষ্টিশীল শ্রেণীকে নগরের দিকে আকৃষ্ট করে। এই সৃষ্টিশীল শ্রেণী আর তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা হলো নগর এবং জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি।

রক্ষণশীল রাজনীতিবিদরা নগর আর ঘনবসতিকে এভাবে দেখতে চায় না। তারা বুঝতে চায় না যে জনঘনত্ব আর জঞ্জাল এক নয়। ঘিঞ্জি এলাকা কেউ পছন্দ করে না। করার কারণ নেই, কিন্তু পরিকল্পিত ঘনবসতি ভিন্ন ব্যাপার। কাছাকাছি, পরিকল্পিত ঘনবসতি পরিবেশের ওপর চাপ কমায়। ঘনবসতি মানুষের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমায় বলে পরিবেশ সংরক্ষণ হয়। পরিকল্পিত ঘনবসতির নগরে যে সংবেদনশীল মানসিকতা, সামাজিক নিরাপত্তা, উদার মনোবৃত্তি আর সৃষ্টিশীল অর্থনীতি তৈরি হয়, সেটা নিয়ে অনেক বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হয়েছে। কাজেই নগরবিরোধী ডানপন্থী রাজনীতির অভিযোগ আসলে অভিবাসনের বিরুদ্ধে, উদারপন্থী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, গণমানুষের রাজনীতির বিরুদ্ধে। এর পেছনে আরো আছে বাজার অর্থনীতির শ্রেষ্ঠত্ববাদী দর্শনকে পাকাপোক্ত করার প্রয়াস আর পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি উদাসীনতা। নতুন সামাজিক দেয়াল তৈরি করে অবহেলিত সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে ঘেঁটো-বন্দি করা আর তাদের সামাজিক নিরাপত্তা জালকে অগ্রাহ্য করা সহজ হয় যখন নগর সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ করা যায়।

সব শেষে বলতে চাই, নগর মানুষের ঘনত্ব আসলে সমস্যা নয়; সমস্যা হলো নগরের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিনিয়োগে ব্যর্থতা, সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি, আর মহামারী রোধে পূর্বপ্রস্তুতির অভাব। হোয়াইট হাউজের বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে আমেরিকার মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হবে কিনা, সে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।

 

. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ: স্থপতি, স্থাপত্য ইতিহাসবিদ, নগরবিদ, গবেষক

ওয়াশিংটন ডিসিতে অধ্যাপক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন