৩০ মে ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্বাভাবিকভাবেই নানা আয়োজন, স্মৃতিচারণ, বিশ্লেষণ হয়েছে; লকডাউনে কিবোর্ড কিংবা ফেসবুক সরব ছিল ঋতুকে স্মরণে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে কলকাতার পাইকপাড়ার একটি ফ্ল্যাটে ঘটেছে চমকপ্রদ এক ঘটনা। লকডাউনের মাঝে কাকতালীয়ভাবে ঋতুপর্ণ ঘোষের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের পাইকপাড়ার ফ্ল্যাটে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাচ্ছিলেন সৌম্যকান্তি দত্ত। এই সৌম্য ‘সন্দেশ’ ম্যাগাজিনের একজন সদস্য এবং কয়েকজন তরুণের সঙ্গে মিলে তিনি লীলা মজুমদারের সাহিত্যকর্মগুলো ডিজিটাল সংস্করণে নেয়ার কাজে লিপ্ত। যাহোক, ২৯ মে ফ্ল্যাট ঝাড়ামোছা করতে গিয়ে সৌম্যকান্তি পেলেন এমন এক দলিল, যেখানে দেখা যাচ্ছে ঋতু লীলা মজুমদারের দুটি জনপ্রিয় উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দিতে লেখকের অনুমতি চেয়েছিলেন। এ-সংক্রান্ত ঋতুর নিজ হাতে হিজিবিজি লেখা একটি নোট খুঁজে পেয়েছেন সৌম্যকান্তি।
কভিড-১৯ ঠেকাতে ভারতজুড়ে চলা লকডাউনের সময় এমন আরো কয়েকজন কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনের অজানা কিছু বিষয় উদ্ঘাটিত হয়েছে, যার মধ্যে আছেন সত্যজিৎ রায়, উস্তাদ বিলায়াৎ খান ও পংকজ মল্লিক। শুক্রবার লীলা মজুমদারের একটি পকেট সাইজ নোটবুক পাতা উল্টিয়ে দেখছিলেন সৌম্য, হঠাৎই একটি পাতায় দেখলেন ১৯৯৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঋতুপর্ণ ঘোষের নিজ হাতে লেখা একটা নোট। সৌম্য জানাচ্ছেন, ‘‘নোটবুকের প্রথম দিকের পাতাগুলোয় তার (লীলা মজুমদার) নিজের হাতে লেখা বিভিন্ন নোট। বেশির ভাগ নিত্যদিনের ডায়েরির মতো। তারপর হঠাৎই একটি পাতায় দেখলাম ঋতুপর্ণ ঘোষের হাতে লেখা নোট, যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘মাকু’
বা ‘হলদে পাখির পালক’
গল্প দুটির চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বত্ব সংগ্রহ করা সম্ভব কিনা। ঋতুর লেখাটা এ-বিষয়ক লাইনগুলোর পরে অন্য কেউ লিখেছেন যে তার সঙ্গে এসেছিলেন সুদেষ্ণা রায় ও শিশির দত্ত।’’
সব মিলিয়ে লীলা মজুমদারের নোটবুকের পাতায় ঋতুপর্ণ ঘোষের নিজ হাতে লেখা ছিল ‘মাকু’ বা ‘হলদে পাখির পালক’ গল্প দুটির চিত্রস্বত্বর জন্য এসেছিলাম। গল্প দুটির ফিল্ম রাইট ফ্রি আছে কিনা, একটু জানা দরকার। এরপর অন্য কেউ লিখেছেন, “সঙ্গে এসেছিলাম সুদেষ্ণা রায় ও শিশির দত্ত”। এরপর তিনজনের ল্যান্ডফোন নম্বর দেয়া।
এই পৃষ্ঠায় ঋতুপর্ণ ঘোষের হাতের লেখা চিনতে সৌম্যকান্তি দত্তের কয়েক মুহূর্ত সময় লেগেছিল। ঋতুর ল্যান্ডফোন নম্বরটি সবকিছু পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। সৌম্র দ্রুতই একটি পুরনো টেলিফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে দেখেন নম্বরটি আসলেই ঋতুপর্ণ ঘোষের ইন্দ্রানী পার্কের বাসার ফোন নম্বর। ‘এরপর লীলা মজুমদারের পুত্র ড. রঞ্জন মজুমদার ও নাতনি শ্রীলতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে ঋতুপর্ণ ঘোষ একদিন লেখিকার সঙ্গে দেখা করতে তার পুরনো বালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু লীলা অসুস্থ থাকায় সাক্ষাৎ করতে পারেননি। ঋতুপর্ণ ঘোষ তখন তার প্রস্তাব লেখিকার নোটবুকে লিখে রেখে এসেছিলেন।
লীলা মজুমদারের পরিবারের কেউ ওপরের তথ্যটুকু ছাড়া আর কিছু জানাতে পারেননি। অন্যদিকে সৌম্যকান্তি বুঝতে পারছিলেন না ঋতুপর্ণ ঘোষের হাতের লেখার নিচে অন্য নোটটি কে লিখেছিলেন। অবশ্য নোটবুকের পাতাটির স্ক্যানকপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে পরিচালক সুদেষ্ণা রায়ের চোখে পড়ে। তিনি জানান, ‘ঋতুর সঙ্গে সেই সফরে আমি গিয়েছিলাম। আমি একটা ম্যাগাজিন নিয়ে কাজ করছিলাম এবং তাই মাঝে মাঝেই লীলাদির বাসায় যেতাম তার লেখা আনতে। ঋতুকে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। তার হাতের লেখার নিচে লেখা লাইনগুলো আমার লেখা।’
সুদেষ্ণা রায় জানিয়েছেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ তাদের সঙ্গে লীলা মজুমদারের কাজ নিয়ে আলোচনা করতেন। ১৯৫৭ সালে শান্তিনিকেতনে বসে লীলা রচনা করেছিলেন ‘হলদে পাখির পালক’। আর ‘মাকু’
রচিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন আবার সত্যজিৎ রায়।
ঋতুপর্ণ ঘোষ তার ক্যারিয়ারে শিশুদের জন্য মাত্র একটি ছবিই নির্মাণ করেছিলেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রচিত কাহিনী অবলম্বনে ১৯৯২ সালে ঋতুপর্ণ নির্মাণ করেছিলেন হীরের আংটি। এটা ছিল তার প্রথম ছবি। ঋতুপর্ণ লীলা মজুমদারের কাজ নিয়ে ছবি নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন কিনা এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সুদেষ্ণা জানান, ‘ঋতু প্রচুর পড়ত। সে লীলাদির লেখার ভক্ত ছিল। সে তার এ দুটো উপন্যাস নিয়ে সিনেমা নির্মাণের আগ্রহের কথা বলত। দহন ছবি মুক্তির পর ঋতু লীলাদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সে নির্মাতা হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট ধরনের ছবি নির্মাণের টাইপকাস্ট নির্মাতা হয়ে থাকতে চায়নি। সে থ্রিলার নির্মাণেরও চেষ্টা করেছে। তাই শিশুতোষ উপন্যাস নিয়ে তার ছবি নির্মাণের বিষয়টি আমাদের অবাক করেনি।’
টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে শানজিদ অর্ণব