নিজের চেষ্টায় বাঁচুন

নাজমুল হক তপন

‘রাষ্ট্রের কাছে আপনি শুধুই সংখ্যা কিন্তু পরিবারের কাছে আপনিই পৃথিবী’,- এমন একটা কথা গত কয়েকদিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালে দেয়ালে। বাংলাদেশে চলতি করোনাক্রান্তিতে এর চেয়ে বড় সত্যি আর হয় না। নিজের সুরক্ষা নিজেকেই করতে হবে। কাউকেই পাশে পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা মোটেই প্রয়োজনীয় নয়!

আমাদের রাষ্ট্র কাদের জন্য কিংবা কাদের পাশে থাকে এটা অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। মামলার আসামি অনায়াসেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্স যোগে পাড়ি জমাতে পারেন বিদেশে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে সরকারের সম্মতি ছাড়া উড়োজাহাজ, চার্টার্ড বিমান কিংবা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে মামলার আসামি দেশত্যাগ করতে পারে কি-না? সবার জন্য আইন সমান হতে পারে না, অন্তত বাংলাদেশে বাস করলে তো নয়ই।
করোনাকালে চিকিৎসা ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে এটুকু বললে অতিমাত্রায় সুবিচার করা হবে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি। কার্যত চিকিৎসা বলতে কিছুই নেই। বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে চেম্বার করছেন না বেশিরভাগ ডাক্তার। রোগী নিয়ে একের পর এক হাসপাতালে ছুটোছুটি করে বিনা চিকিৎসায় মৃত্য হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের ঘটনা। দেশের নামী দামী প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা মিলছে না। আর এতে রাষ্ট্রকে ব্যবহার  করে  আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হওয়া লোকেরাও পড়েছেন বিপদে। কেননা করোনা তো আর ধনী-গরীব ভেদাভেদ করছে না। টাকা সব সময়ই বুদ্ধির যোগানদাতা। চার্টার্ড প্লেন, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এসব কেন আছে? টাকা থাকতে এই মরার দেশে মরার ঝুঁকি নিয়ে থাকার দরকারটাই বা-কি? দেশ চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। কুছ পরোয়া নাই। প্রাইভেট উড়োজাহাজে উড়াল দাও ...যেখানে আছে নিশ্চিত স্বাস্থ্য সেবা।
 
রাষ্ট্র কাদের? প্রশ্নটাই অবান্তর। ঈদের ছুটির কথাই ধরা যাক। ৮/১০ ফুট ঘরে পুরো পরিবার নিয়ে বাস করা মেহনতী মানুষদের ঘরে আটকে রাখার কৌশল নেয়া হল। বন্ধ রাখা হল গণপরিবহন। অথচ গাড়িওলাদের ঈদের ছুটি কাটানোর ব্যবস্থা করা হল। প্রাইভেট কার, মাইক্রো নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় উৎসবের আমেজে গ্রামের বাড়ীতে ঈদ উদযাপনের সুযোগ পেলেন সুবিধাপ্রাপ্তরা। ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থাকা মানুষদের কাছে ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা। রাজধানীর ঈদের সঙ্গে তাদের কোনোই মানসিক, সাংস্কৃতিক যোগ নেই। অথচ গণপরিবহন বন্ধ। অনিশ্চয়তার বন্দি দশা থেকে মুক্তির একটা উপায়ই জানা আছে এই মেহনতী মানুষদের। আর সেটা গ্রামের বাড়ি যাওয়া। পায়ে হেঁটে, অটো-সিএনজিতে শেয়ার করে নৌকায় গাদাগাদি করে নদী পার হয়ে গ্রামে ছুটলেন আজীবন জন্মদৌড়কে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো।

এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল জীবন-জীবিকা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ সব আলোচনা। জীবন বাঁচাতে চাই জীবিকা, জীবিকা বাদ দিয়ে জীবন চলতে পারে না, কত কথার মালা। খুলে দেয়া হল অফিস, মিল-কারখানা। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে চাই ওয়ার্কিং ফোর্স। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে গ্রামে গিয়েছিল তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে ঢাকায়। তবে এবারে রাষ্ট্র সদয় (!) হল। ব্যবস্থা করা হল গণপরিবহনের। মওকা বুঝে ব্যবসা করার সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা? স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তত্ত্বের ফিকিরে  ভাড়া আশি শতাংশ বাড়িয়ে নিলেন তারা।
 
অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে গার্মেন্টস শ্রমিকসহ সব মেহনতী মানুষদের বার বার ঢাকা-গ্রাম, গ্রাম-ঢাকা করানোর খেলার যেন কোন শেষ নাই। করোনা ঝুঁকি জেনেও, ডাক দিলেই পিপড়ের মত পিল পিল করতে করতে ওরা আসে কেন? এমন প্রশ্ন করার লোকেরও অভাব নেই। আগুনে পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে পোশাক শ্রমিকেরা কাজ করে কেন? নৌকাডুবির ঝুঁকি নিয়ে ইঞ্জিন বোটে করে পদ্মা পাড়ি দেয় কেন? অনেকে বুঝতে চান না যে,কাজের জন্য মৃত্যু ঝুঁকিকেই নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে মেহনতী মানুষ।

করোনার অবাধ চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। চিকিৎসা ব্যবস্থা ভঙ্গুর। জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা। করোনা সনাক্ত ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে ক্রমেই। এরই মাঝে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সব খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যথারীতি রাজধানীমুখো মানুষের স্রোত। পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে গড়ে প্রতি পাঁচ জনে একজন পজিটিভ। সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহতা কোন মাত্রায় পৌছাতে পারে?  কিছুদিন আগ পর্যন্ত গ্রামগুলোতে সেভাবে আক্রান্ত দেখা যায়নি, এখন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও আক্রান্তের খবর আসছে।

করোনাক সঙ্গী করেই বাঁচার তত্ত্ব এসে গেছে এরই মধ্যে। মেহনতী মানুষ একজন মারা গেলে  আর একজন এসে সেই শুন্যস্থান পুরণ করবে, হিসাব  খুবই পরিষ্কার। চারপাশে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে ঘিরে আছে করোনা। ওঁৎ পেতে আছে ডেঙ্গু। এরই মধ্যে প্রমাণিত যে, এত ভাবার কারো দায় নেই। জীবিকার জন্য আপনি কাজে যাবেন। পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব আপনার। একইসঙ্গে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আপনার। একটু এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ ঘটে যাবে! জীবন-জীবিকার এ লড়াইয়ে আপনি টিকতে না পারলে সেই ব্যর্থতা শুধুই আপনার।

গ্রামে কুলা দিয়ে ধান পরিষ্কার করার সময় মা-খালা-চাচিরা খুব দক্ষতার সঙ্গে চিটাগুলোকে খুব দ্রুত আলাদা করে ফেলেন। আমাদের রাষ্ট্রও তেমনি নাগরিকদের আলাদা করার কৌশল প্রযোগ করে। কোনো কারন ছাড়াই মুহূর্তের মধ্যেই আপনি ‘চিটা’ হয়ে যেতে পারেন। চলে যেতে পারেন খরচের খাতায়। আর তাই পথ একটাই, কোনো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই মৃত্যুফাঁদ এড়িয়ে নিজের চেষ্টায় বেঁচে থাকা।

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন