ডব্লিউজিসির প্রতিবেদন

মহামারীতে বেশি বেশি স্বর্ণ কিনছেন বিনিয়োগকারীরা

বণিক বার্তা ডেস্ক

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী বৈশ্বিক পণ্যবাজারে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। জ্বালানি তেলের রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। মন্দার মুখে ব্যবহারিক ধাতু কৃষিপণ্যের বাজার। আর এসবের মূলে রয়েছে মহামারীকালে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া। তবে ব্যতিক্রম দেখা গেছে স্বর্ণের বাজারে। বেশির ভাগ পণ্যের চাহিদা কমলেও মহামারীর টালমাটাল সময়ে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বেড়েছে দামও। কাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক মহামারীতে শেয়ার মুদ্রাবাজারে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ফলে নিরাপদ বিনিয়োগ উৎস হিসেবে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের প্রতি ঝুঁকেছেন। তারা বেশি বেশি স্বর্ণ কিনছেন। এতে বেড়েছে মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা।

স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) এতে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বিশ্বজুড়ে মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের সম্মিলিত চাহিদা ছিল হাজার ৭০ দশমিক টন। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে মূল্যবান ধাতুটির বৈশ্বিক চাহিদা শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার ৮৩ দশমিক টনে। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা বেড়েছে ১৩ টন।

চলতি বছরের শুরুতে নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে চীন। দেশটি থেকেই প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিস্তারের সূচনা। এরপর ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত হয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে নভেল করোনাভাইরাস। কভিড-১৯ রোগের বিস্তারে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বুকে স্বর্ণের শীর্ষ ভোক্তা দেশ। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব দেশে মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তবে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই, টানা লকডাউন জনগণের আয় কমে যাওয়ার ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগের ক্ষেত্রে স্বর্ণের চাহিদায় ভাটার টান পড়েছে। বেড়েছে বিনিয়োগ হিসেবে মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা।

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে স্বর্ণের চাহিদা প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বর্ণালংকার, প্রযুক্তি, বার কয়েন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) পাঁচটি খাতে পুরো বিষয়টিকে ভাগ করেছে ডব্লিউজিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে অলংকার, প্রযুক্তি, বার কয়েন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা কমতির দিকে ছিল। এর বিপরীতে ইটিএফ খাতে মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। এটা মূলত ব্যক্তিক প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগ। তাই বলা যায়, করোনা মহামারীর সময় বিনিয়োগকারীরা বেশি বেশি স্বর্ণ কিনে মূল্যবান ধাতুটির বৈশ্বিক চাহিদা বাড়াতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন।

ডব্লিউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বর্ণালংকার খাতে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ ব্যবহার হয়। ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে স্বর্ণালংকার হিসেবে মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা ছিল ৫৩৩ দশমিক টন। চলতি বছরের একই সময়ে চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২৫ দশমিক টনে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে অলংকার হিসেবে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা কমেছে ২০৭ টনের বেশি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণালংকার মূলত ব্যক্তিক পর্যায়ের ভোগ। চীন ভারতে স্বর্ণালংকারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দুটো দেশই করোনা মোকাবেলায় টানা লকডাউনের ভেতর দিয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। সময় চীন ভারতে সামাজিক ধর্মীয় উৎসব উদযাপন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। অর্থনৈতিক কার্যক্রম শ্লথ হয়ে আসায় মানুষের আয়ও কমেছে। ফলে তারা অলংকার হিসেবে স্বর্ণ কম কিনেছেন। ফলে বছরের প্রথম তিন মাসে খাতে মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা কমেছে।

প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনেও স্বর্ণের চাহিদায় ভাটার টান দেখা গেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে খাতে স্বর্ণের চাহিদা ৭৩ দশমিক টনে দাঁড়িয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে ডব্লিউজিসি। আগের বছরের একই সময়ে প্রযুক্তি খাতে মূল্যবান ধাতুটির বৈশ্বিক চাহিদা ছিল ৭৯ দশমিক টন। মহামারী মোকাবেলায় টানা লকডাউনের কারণে দেশে দেশে উৎপাদন খাত কার্যত স্থবির থাকায় খাতে স্বর্ণের চাহিদা কমে এসেছে।

ডব্লিউজিসির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বার কয়েন হিসেবে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে ২৪১ দশমিক টনে। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ২৫৭ দশমিক টন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসেবে গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১৪৫ টনে। ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয় মূল্যবান ধাতুটির সম্মিলিত চাহিদা ছিল ১৫৭ টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের চাহিদা কমেছে ১২ টন।

তবে পাঁচটি খাতের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ইটিএফ। ডব্লিউজিসির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ইটিএফ হিসেবে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে ২৯৮ টনে। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল সাকল্যে ৪২ দশমিক টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ইটিএফ হিসেবে বিশ্বজুড়ে মূল্যবান দাতুটির চাহিদা বেড়েছে রেকর্ড ২৫৫ টনের বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মহামারীতে এশিয়া ইউরোপের শেয়ারবাজারে বড় পতন দেখা গেছে। ওয়াল স্ট্রিটের গ্রাফও দীর্ঘদিন নিম্নমুখী ছিল। চাহিদা কমতির দিকে থাকায় পণ্যবাজারে টালমাটাল অবস্থা। জ্বালানি তেলের দাম ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ভারতীয় রুপি, ইউরো, চীনা ইউয়ানকোনোটাই দীর্ঘমেয়াদে সুখবর দিতে পারছে না।

পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরাও অনিশ্চিয়তার মধ্যে রয়েছেন। তারা হন্যে হয়ে বিনিয়োগের নিরাপদ উৎস খুঁজছেন। আপত্কালে স্বর্ণ সবসময় সেফ হেভেন বা নিরাপদ বিনিয়োগ উৎস বিবেচিত হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তুলনামূলক নিরাপদ বিবেচনা করে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা বেশি বেশি স্বর্ণ কিনছেন। মূলত কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অন্যান্য খাতে কমলেও ইটিএফ হিসেবে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন