রফতানির অর্থ আসছে না, বাড়ছে আমদানি দায় পরিশোধের তাগাদা

হাছান আদনান

কভিড-১৯ তাণ্ডবে স্থবিরতা নেমে এসেছে বৈশ্বিক বাণিজ্যে। তলানিতে নেমে গেছে দেশের রফতানি। যতটুকু পণ্য রফতানি হয়েছে তার অর্থও আসছে না। অন্যদিকে বাড়ছে আমদানি দায় পরিশোধের তাগাদা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা টাকা না দেয়ায় বিপাকে রয়েছে ব্যাংক। সব মিলিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য।

ব্যাংকাররা বলছেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি দায় পরিশোধের সময় দ্বিগুণ করে দিয়েছে। আবার রফতানি আয় প্রত্যাবাসনের সময়ও বাড়ানো হয়েছে। এর সুযোগ নিচ্ছেন দেশের অনেক আমদানিকারক। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের টাকা দিচ্ছে না তারা। যদিও ব্যবসায়ীদের পক্ষে আমদানি দায় ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এতে ব্যাংকের বিপদ বাড়ছে।

অন্যদিকে আমদানিকারকদের বক্তব্য হলো পণ্য দেশে এলেও সে পণ্য বিক্রি হয়নি। যতটুকু পণ্য বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে, তার অর্থও ফেরত আসেনি। আবার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির ক্ষেত্রে দ্বিমুখী সমস্যা তৈরি হয়েছে। রফতানি করা পণ্যের অর্থ ফেরত আসছে না। এতে ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়েছেন। এখন ব্যাংক অসহযোগিতা করলে পথে বসতে হবে তাদের। আবার ব্যাংককেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রফতানি পণ্যের অর্থ আসছে না, আবার রেমিট্যান্সও এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে আমদানি দায় পরিশোধে আমরা বাধ্য হচ্ছি। পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট তীব্র হয়েছে। অফশোর ব্যাংকিংয়েও তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সংকট উত্তরণের জন্য ব্যাংক, ব্যবসায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বিপর্যয় মহাবিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে।

২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে দেশের রফতানি আয় ছিল ৩০৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। করোনার আঘাতে বছরের এপ্রিলে তা মাত্র ৫২ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। সে হিসেবে এপ্রিল মাসে রফতানি আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। এপ্রিল পর্যন্ত চলতি বছরের ১০ মাসে রফতানি আয় কমেছে ১৩ দশমিক শূন্য শতাংশ। বিপর্যয় নেমে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্য খাত রেমিট্যান্সেও। এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমেছে ২৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।

বৈশ্বিক মহামারীর সময়ে দেশের আমদানি খাতেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। গত এপ্রিলে ঋণপত্র  (এলসি) খোলা হয়েছে মাত্র ১৬০ কোটি ডলারের। ২০১৯ সালের একই মাসে ৫২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এপ্রিলে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। একই পরিস্থিতি এলসি নিষ্পত্তিতেও। এপ্রিলে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৯৫ কোটি ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে ৫০৮ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল।

করোনায় বিধ্বস্ত ব্যবসা-বাণিজ্যকে সুরক্ষা দিতে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে তত্পরতা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্থবির অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে জারি করা হয় শতাধিক প্রজ্ঞাপন। গঠন করা হয় অর্ধলক্ষ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়া হয় আমদানি দায় পরিশোধ রফতানি আয় প্রত্যাবাসনের সময়সীমা। স্থগিত করা হয় এপ্রিল মে মাসের সব ব্যাংকঋণের সুদ। একই সঙ্গে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গ্রাহক ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি না করার নির্দেশনা দেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব পদক্ষেপে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও চোখে অন্ধকার দেখছে ব্যাংকাররা। বিদ্যমান পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে যেসব পণ্য রফতানি হয়েছে, তার অর্থ দেশে আসছে না। আবার আমদানির জন্য যেসব ঋণপত্র খুলেছিলাম, তার অর্থ পরিশোধ করে দিতে হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহকদের কাছ থেকে কোনো টাকা পাচ্ছি না। ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ থাকায় ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ৯০ শতাংশ কমে গেছে। এতটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি পুরো ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে দেখিনি।

অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, প্রতিদিনই ব্যাংকের আমানত কমছে। কিন্তু বিপরীতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ থাকায় মূল ঋণের সঙ্গে সুদ যুক্ত হওয়াই এর কারণ। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডি রেশিওতে যেটুকু ছাড় দিয়েছে, তাও পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফারমার্স ব্যাংকের মতো লাইফ সাপোর্ট দিয়ে না বাঁচানো হলে দেশের অনেক ব্যাংকই দেউলিয়া হবে।

দেশের ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থতার অভিযোগ অনেক পুরনো। গত দুই বছরে অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ব্যাংক। নিয়ে নিজ নিজ দূতাবাসের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিল বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। করোনা পরিস্থিতিতে এলসি দায় সমন্বয়ের ঢিলেমি অনেক বেড়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত সময়ে এলসি দায় পরিশোধের জন্য নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, নির্ধারিত সময়ে এলসি দায় সমন্বয় না হলে দেশের রেটিং খারাপ হবে। একই সঙ্গে বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক সম্পর্কও নষ্ট হবে। এজন্যই নির্ধারিত সময়ে এলসি দায় সমন্বয় করা জরুরি।

বিদেশী পণ্যের এলসি দায় সমন্বয়ের জন্য তাগাদা থাকলেও দেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের অর্থ ফেরত আসছে না। নিয়ে রফতানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ উত্কণ্ঠা বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে বিদেশী ক্রেতাদের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে রফতানিকারকদের সংগঠনগুলো।

তৈরি পোশাক খাতের একজন প্রথম সারির ব্যবসায়ী জানান, তার প্রতিষ্ঠানের রফতানীকৃত পণ্যের অর্থ ফেরত আসছে না। রফতানীকৃত অনেক পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্দরে পড়ে আছে, সেসব পণ্য ক্রেতারা বুঝে নেয়নি। আবার পণ্য বুঝে নিয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানও বিক্রি না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে মূল্য পরিশোধ করছে না।

ব্যবসায়ী নিজেও দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। তার মতে, করোনা তাণ্ডবের মধ্যেই বিদেশী ক্রেতার অনুরোধে আমার প্রতিষ্ঠানের কিছু পণ্য উড়োজাহাজে করে পাঠিয়েছিলাম। সেসব পণ্যও ক্রেতারা বুঝে নেয়নি। আজকেও (শনিবার) কনটেইনারে করে কিছু পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ট্রাক বন্দরে পৌঁছার আগেই বিদেশী ক্রেতারা সেসব পণ্য এক মাস পরে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছে। এজন্য ওয়ার হাউজ ভাড়া করে সেসব পণ্য চট্টগ্রামে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি যদি এই হয়, তাহলে রফতানিকারকরা বাঁচবে কীভাবে?

রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বণিক বার্তাকে বলেন, কাঁচামালের মূল্য পরিশোধ হচ্ছে এলসির টার্মস অনুযায়ী। কারণ কভিডের প্রাদুর্ভাব হবে এটা তো কাঁচামাল সরবরাহকারী জানতেন না। এলসির টার্ম অনুসরণ না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিবিলিটিও নষ্ট হবে। সবচেয়ে অপেশাদারি আচরণ দেখা যাচ্ছে ক্রেতার তরফ থেকে। একদিকে রফতানির অর্থ আসছে না, অন্যদিকে আমদানির অর্থ ফোর্স লোন করে হলেও পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে ব্যাংকের অবশ্যই চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এটা ঠিক, কিন্তু সবশেষে দায় উদ্যোক্তারই। দীর্ঘমেয়াদি ফলস্বরূপ এর প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ কর্মসংস্থানে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন