আলোকপাত

করোনাকালে যেমন বাজেট হওয়া উচিত

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

করোনাকাল চলছে। বাংলাদেশে সংক্রমিত, আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা সম্প্রচারে অপ্রচার বেড়েই চলেছে, বারবার ভোল পাল্টাচ্ছে করোনার গতি-প্রকৃতি। তাকে নিয়ন্ত্রণ নিরাময়ের এখনো কোনো সুলুক সন্ধান মেলেনি না বাংলাদেশে, না গোটা বিশ্বে, প্রাকৃতিক প্রেরণায় যেমন এর সৃষ্টি বিকাশ, এর প্রবাহও চলছে সেভাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ চীনের সেই গবেষক বলছেন, ওয়েভ পরিবর্তনের ধারাতেই আছে করোনা, নির্মূল সে হবে না, আরো কঠিন সময় সামনে। ভ্যাকসিন ওষুধ আবিষ্কার এখনো প্রক্রিয়াধীন। ঠিক সময়ে দেশে দেশে অর্থনৈতিক জীবন সচল-সজাগ করার তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে দেখানোর আয়োজন শুরু হয়েছে। যা হয় তা হতে থাকুক বা হবে, বর্তমানকে অন্তত শো-আপ করিএই যখন কর্মভাবনা, তখন বাংলাদেশে ২০১৯-২০ সালের সংশোধিত এবং ২০২০-২১ সালের নতুন বাজেট ঘোষণার সময় সমুপস্থিত। চলতি আগামী বছরটি যথাক্রমে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশতবার্ষিকী উদযাপনের মতো আবেগ নতুন নতুন কর্মসূচি যোজনার। ঠিক সময়টাতেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আকাল সর্বগ্রাসী মন্দা মোকাবেলার ভয় আতঙ্ক গেড়ে বসে আছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। ঠিক সময় মহামারীর দুর্যোগকালে গোটা অর্থনৈতিক জীবনযাপন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ নিয়ামকের ভূমিকা পালনের দিকনির্দেশনা বাজেটে আনতেই হচ্ছে।

ধ্রুপদ ধারণায় বাজেট হচ্ছে জনগণ তথা অর্থনীতির কাছে সরকারের দায় এবং সরকারের সঙ্গে জনগণের দায়িত্ববোধের সমঝোতার সংসদে পাস হওয়া একটি আইনগত দলিল। বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় সরকারের সেবা উন্নয়ন কর্মসূচির পথনকশা নির্দেশক হিসেবে। জনগণ বাজেটে সরকারের ধার্য করা কর ফি, চার্জ খাজনা পরিশোধ করে সরকারের তহবিল জোগান দেয় এবং সে তহবিল ব্যবহার করে সরকার জনগণকে নানান অবকাঠামো সৃষ্টির মাধ্যমে সরবরাহ সেবা পৌঁছায়। বাজেটে সম্পদের বণ্টনবৈষম্য নিরসনের, আয়-উপার্জনে সমতায়নের দ্বারা একটি ন্যায়-নীতিনির্ভর জনকল্যাণমুখী সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের কৌশলপত্র-প্রতিশ্রুতিও থাকে। এসব কারণে কী পরিমাণ কর আরোপ করা হচ্ছে, কীভাবে তা সংগৃহীত হচ্ছে বা হবে এবং সংগৃহীত রাজস্ব ঘাটতি পূরণ কীভাবে হচ্ছে বা হবে, নির্বাহী বিভাগ তার প্রস্তাব করলে পরীক্ষা পর্যালোচনান্তে সংসদই অনুমোদন দেবে বা এর দায়দায়িত্ব নেবে। বাজেটীয় শৃঙ্খলা পরিপালনের বাধ্যবাধ্যকতা অনুসরণ এবং বাজেট বাস্তবায়নের পরিস্থিতি পর্যালোচনার দায়িত্বও (বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে) সংসদের। দাবিদাওয়া পরামর্শ শুনে বাজেট তৈরির সময়টা করোনাকালের হওয়ায় এবারের বাজেটে সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তবায়ন কৌশলে গণআলোচনা-পর্যালোচনার সুযোগ ছিল না বা নেই। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় অনলাইনে যতদূর সম্ভব যোগাযোগ, ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবার প্রস্তার পরামর্শ নিয়েছে। ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়ায় গ্রুপ বিশেষজ্ঞভিত্তিক আলোচনা সভা চলেছে। মন্ত্রণালয় সেগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিত্য দিকনির্দেশনায় এবং অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আমাদের সহকর্মীদের আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যথা পদ্ধতি অনুসরণ করে বাজেট প্রণয়নে সক্ষমতা দক্ষতার ওপর আস্থা সবার রয়েছে।

এটা অনস্বীকার্য যে এবারে করোনাকালে চলতি এবং আগামী বছরের বাজেটটি পর্যায়ে গতানুগতিক, উন্নয়ন অভিমুখীকরণে উচ্চাভিলাষী, রেভিনিউ আর্নিংয়ের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পরিবর্তে এটি অবশ্যই অচল অর্থনীতিকে সচল রাখার, বেকার ক্ষুধা রোখার, করোনায় ক্ষতি পুনরুদ্ধার পুনর্বাসন, করোনায় সৃষ্ট মন্দা মোকাবেলা এবং সম্ভাব্য সুযোগের (কৃষি খাতে অধিক মনোযোগ দক্ষ জনবল সৃষ্টিসহ ওষুধ সরঞ্জাম রফতানি বহুমুখীকরণ চীনফেরত বিদেশী বিনিয়োগ ঘরে আনা) সদ্ব্যবহার হতে হচ্ছে বা হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ে করোনার প্রাদুর্ভাব এখনো যেভাবে গেড়ে বসে আছে, তাতে বিশ্ব জাতীয় অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এবং এর হিসাবনিকাশের ভিত্তি এখনো বারবার পরিবর্তনীয় অবস্থায়, সেহেতু রকম একটা টলটলায়মান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে স্থির প্রাজ্ঞ বাজেট প্রস্তাব পেশ পাস কীভাবে বাস্তবসম্মত হবে তা বলা মুশকিল। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, বরং এবারের চলমান এবং সামনের করোনা যুদ্ধকালীনের জন্য বাজেটটি সাময়িক আপত্কালীন বাজেট আকারে এবং যুদ্ধ শেষে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পূর্ণাঙ্গ বাজেট উপস্থাপনের সুযোগ রাখা যেতে পারে। আমাদের দেশে একবার বাজেট পাস হলে তা সংশোধনের প্রথা হলো অর্থবছর শেষ হওয়ার মাসে সম্পূরক বাজেট হিসেবে কোনো প্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জবাবদিহিতা ছাড়াই পাস হওয়ার। বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা প্রয়োজন হবে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারা ঊর্ধ্বগামী রাখা বা থাকার সুবাদে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ সুগম রাখতে বাজেটের আকার বেড়েছে গত বেশ কয়েক বছর। বাড়তি সেই ব্যয়ের অর্থায়ন অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় দ্বারা পূরণ সম্ভব করতে পর্যাপ্ত উপায়-উপলক্ষ তৈরির চেষ্টা থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় মূলত এবং মুখ্যত কঠিন শর্তের ঋণনির্ভরই হয়েছে অর্থনীতি। লক্ষণীয়, জিডিপির প্রচারিত প্রবৃদ্ধি সংশ্লিষ্ট সব খাতে এখন করোনাকালে বাস্তবে সমিল পাওয়া যেমন কঠিন হচ্ছে, তেমনি অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে ক্ষমতার বলয় বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সমবণ্টন ব্যবস্থাপনাও ক্ষমতার অপব্যবহারের বলয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর রাজস্ব জোগানদাতা ব্যাংকিং সেক্টর স্বতঃসিদ্ধ নিয়মে নিজে নিজে মুখ থুবড়ে পড়লে তাকে টেনে তোলার পথ মিলত। ব্যাংকিং খাতকে তলাবিহীন ঝুড়ি করা হয়েছে, বারবার পুনঃঅর্থায়ন, সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিলের মাধ্যমে, তদারকি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতায় লুট পাচারের পথ-প্রশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে। স্বয়ম্ভর হয়ে মধ্যম আয়ের পথে হাঁটা, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য রাজস্ব আয়ই যে মহার্ঘ, ক্রমান্বয়ে সফলতার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়েই উন্নয়ন-অনুন্নয়ন ব্যয় নির্বাহের আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ার কথা ছিল বা আছে। আরো ছিল এজন্য যে রাজস্ব আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধির পারস্পরিক সম্পর্ক জড়িত। একদিকে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়ানো এখনো যেমন মুখ্য চ্যালেঞ্জ, চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে প্রযোজ্য সব করদাতাকে করের আওতায় আনার। রাজস্ব আহরণ ব্যয় ব্যবস্থাপনা খাতে আবশ্যকীয় সংস্কার সংস্থাপনে কার্যকারিতায় দীর্ঘসূত্রতা এই পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করেছে। করোনাকালে, করোনা মোকাবেলার সময় তা প্রকট হয়ে উঠেছে। এখন করোনাকালে রাজস্ব আয় বাড়ানোর সুযোগ যেমন সীমিত এবং অন্যদিকে শুধু চলমান মেগা প্রকল্পগুলো ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে সমাপ্তকরণের আবশ্যকতায় (বিলম্বে হলে ব্যয় বাড়বে), অচল অর্থনীতি সচলকরণে স্টিমুলাস প্যাকেজ অর্থায়ন এবং বেকার ক্ষুধা রুখতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানো কাজসহ খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হবে, তার সামষ্টিক অর্থনেতিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবে। এখানে অপশন দুটো. অর্থনীতিকে আরো ঋণনির্ভর করা। . এরই মধ্যে আর্থিক খাতসহ অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট কর্তৃক লুণ্ঠন পাচারের দ্বারা সৃজিত বৈষম্য দূরীকরণে কঠোর  পদক্ষেপের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন। শেষোক্ত অপশনটি করোনা মোকাবেলা টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই প্রয়োজন। করোনা বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সূচনা করতে চলেছে, তাতে বাংলাদেশকে একলা নিজের মতো চল পরিস্থিতিতে অবগাহন করতেই হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বহির্মুখিনতা (এক্সপোর্ট, রেমিট্যান্স, ওডিএ এফডিআই নির্ভরশীলতা) থেকে অন্তর্মুখীন স্বনির্ভরতার পথে হাঁটতে হবে। সেখানে সম্পদবৈষম্য ব্যবস্থাপনা বাধার সৃষ্টিই করবে। তারা আরো সম্পদ কুক্ষিগত করার প্রয়াস পাবে, যদি তাদের আড়াল করতে, ভালো রাখতে, তাদের প্রণোদনা দেয়ার সুযোগ তৈরি অব্যাহত রাখা হয় এবং তাদের অর্থ উদ্ধার অর্থনীতিতে ফেরত আনার কঠোর পদক্ষেপে না নেয়া যায়। আবশ্যকতার নিরিখেই নৈতিকভাবে এসব অপ্রদর্শিত আয় এবং অবৈধভাবে অর্জিত, লুণ্ঠিত পাচারকৃত অর্থকে করের আওতায় আনার জরুরিয়তাও রয়েছে। কেন তা আনা যায়নি বা যাচ্ছে না, বাধা পদ্ধতির, না প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিরএর একটা শুমার সংস্কার অনিবার্য হয়ে ঊঠবে করোনাকালের বাজেটে। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় দুর্যোগে আপতিত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকল্পে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে দেশে বিদেশে।

অনেকে একথা মানতে প্রথাগতভাবে রাজি নন যে বাংলাদেশে এখন বাজেটের আকার প্রাক্কলিত হয় ওপর থেকে, নিচে থেকে আসা সক্ষমতার সূচি চাহিদার ভিত্তিতে নয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আরোপিত বাজেট আসে ওপর থেকে, ব্যয়ে প্রকৃত চাহিদা রাজস্ব আয় অর্জন সক্ষমতা বা কর্মপরিকল্পনার নিরিখে নিরূপণ হয় না। Cut (make) your coat (budget) according to your cloth (allocation) রীতি আগে সুর ঠিক করে পরে কথা বসিয়ে গান রচনার মতো। মাঠ পর্যায়ে আয়-ব্যয় বাস্তবায়নকারীর কাছ থেকে প্রাক্কলন না নিয়ে ওপর থেকে প্রাক্কলন চাপিয়ে দেয়ায় বাজেট বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়কে দায়দায়িত্বশীল পাওয়া যায় না। সে কারণে বাজেট সংশোধনে বা পরিবর্তনেও জবাবদিহিতার তাগিদ গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। সংশোধিত বা সম্পূরক বাজেট পাস করার ক্ষেত্রে কার্যকর বাধ্যবাধকতা তাই হালে পানি পায় না। কারণেই বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার পরিচালন ব্যবস্থা এখনো প্রচণ্ডভাবে কেন্দ্র শাসিত, কেন্দ্র অনুপ্রাণিত কেন্দ্র অর্থায়িত। কর্তাভজার দেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বারবার অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছা ব্যক্ত করা হলেও বাস্তবে বিচ্যুতি বাড়ে ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় সাধনে। বাজেট প্রণয়ন বাস্তবায়ন পর্যায়ে পরিবীক্ষণ নির্মোহ মূল্যায়ন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশিক দায়িত্ববোধ নানান বিভাজনের বলয়ে চলে যাওয়ায়।

লক্ষণীয় রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতপার্থক্য ইদানীং বেশ বাড়ছে। রাজস্ব আহরণ বাজেটের লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইদানীং দেখা যায় বর্ধিত রাজস্ব আহরণ করতে হবেএই জরুরিয়তা দেখিয়ে বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তরফে প্রস্তুতি, কর্মপরিকল্পনা পাকাপোক্ত হিসাব কষা বা নিরূপণের ভিত্তিতে হওয়া উচিত, তাহলে কেন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না, তার একটা ব্যাখ্যা আইনসভা পেতে পারে এবং তদানুযায়ী পরিস্থিতি উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের প্রথম থেকে পরবর্তী দেড় ডজনেরও বেশি বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কোন কোন খাত বা ক্ষেত্র থেকে বর্ধিত রাজস্ব আহরণ করবে, তার একটা তালিকা বাজেট দলিলে দেয়া থাকত। ফলে তা অর্জনে জবাবদিহিতে তারা নৈতিকভাবে বাধ্য থাকতেন। যে অর্থনীতি থেকে রেভিনিউ অর্জিত হবে, সেই অর্থনীতি সচল এবং কর রাজস্ব আয়ের উৎস নির্বিঘ্ন কিনা, বিষয়গুলো জানার সুযোগ বাজেটে রাখা বা থাকা দরকার। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই, কেননা যেকোনো অযৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব দপ্তরের অ্যাগ্রেসিভ দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনীতি বিকাশের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে এই অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বড় ব্যয়ের প্রবণতা উৎসাহিত হয়, ফলে আলটিমেটলি সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যয় ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, অপব্যয়, দুর্নীতি ঋণগ্রস্থতা বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতি মরণঘাতী ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এসব সৃষ্ট অব্যস্থাপনার দায়ভার ধাক্কা এবার করোনাকালের বাজেটের ওপর এসে পড়ছে, পড়বে। করোনা পরিস্থিতিতে এখন অর্থনীতিকে নিজের কাছে নিজের জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। উচ্চবিত্তকে নিজের স্বার্থে নিজেকে টিকিয়ে গতিশীল ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে আসতে হবে। কেননা এতদিনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আয়বৈষম্য বৃদ্ধির প্রেরণায় সীমিত না হয়ে থাকলে করোনাকালের কঠিন সময় মোকাবেলায় একটি স্বতঃপ্রণোদিত অবকাশ সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কথা। 

সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ন্যায়নীতি, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার ধ্রুপদ গতিপথকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চললে প্রাকৃতিক নিয়মেই তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। রাজস্ব আয়-ব্যয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উপায়, সুযোগ, অনুষঙ্গ, অনুরঙ্গ কোন পর্যায়ে আছে, তা কঠোর পরিবীক্ষণে রাখা দরকার। এখন মুহূর্তে যেটা বড় প্রয়োজন তা হলো, অর্থনীতির চলত্শক্তির প্রাগ্রসরতা, বোধগম্যতা সহনক্ষমতা সংরক্ষণ। বিনিয়োগে অর্থনীতিতে সম্পদ সৃষ্টি হয়, কর্মসৃজন হয়। কর্ম সৃজিত হলে অন্যান্য আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে, সেখান থেকে জীবনমানের উন্নয়ন যেমন ঘটে, তেমনি রাজস্ব আয়ের সংস্থান হয়, যে রাজস্ব আবার পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। সুতরাং বিনিয়োগ হওয়ার জন্য পুঁজি পরিবেশ প্রয়োজন। বিনিয়োগ-প্রবৃদ্ধি-বিনিয়োগ এটি একটি ঘূর্ণায়মান চক্র। প্রবৃদ্ধি হবে না যদি বিনিয়োগ না হয়, আবার বিনিয়োগ হবে না, প্রবৃদ্ধি না হলে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত, দেশের অভ্যন্তরে নিজস্ব সিন্ডিকেট কর্তৃক লুণ্ঠনকৃত অর্থ উদ্ধারের অর্থ দিয়েই বেসরকারি বিনিয়োগের বন্ধ্যত্ব ঘোচাতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে বৈষম্য সৃষ্টির উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষককেই নিজের থেকে জট খুলতে হবে। কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দিয়ে তা বাস্তবায়নের জটিল পথে না গিয়ে স্ব-উদ্যোগে সে অর্থ সময়োপযোগী খাত ক্ষেত্রে বিনিয়োগে এগিয়ে এলে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পরিবর্তে স্বাগত জানানোর দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে নীতি নৈতিকতা প্রাণিত হতে পারে। নিজস্ব সম্পদের দ্বারা সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে যেমন ডবল লাভ, তেমনি সরকারি বিনিয়োগ ব্যাংক লোন দিয়ে হলে ডবল ক্ষতি। অর্থনীতিকে ভবিষ্যতে আরো ঋণগ্রস্ত করা বা দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিমুখী করার অন্যতম অনাকাঙ্ক্ষিত উপায় হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়া। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে রাজস্ব আয় কমে যাবেব্যাংকগুলোর নিট মুনাফায় ঘাটতি ঘটলে যেমন রাজস্ব আয় কমে যাবে। সুতরাং সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে, নিজস্ব সম্পদ উদ্ধার সৃজনের মাধ্যমে। নিরিখে প্রকল্প নিতে হবে সম্পদ সৃজনকারী উপযোগিতার বাছবিচারে, যেকোনো প্রকার  অনুৎপাদনশীল খাতে এবং গুণগত মান যাচাইযোগ্য হবে না বা নিশ্চিত হবে না এমন প্রকল্প গ্রহণ পরিহার করে। ভিন্ন উদ্দেশাভিমুখী ভাববিলাস ব্যবস্থার বালুচর থেকে বাস্তবতার শক্ত মাটিতে পা রাখতেই এডিপির প্রকল্প বাছাই অর্থ বিতরণ ব্যবস্থায় অগৌণে যথাদৃষ্টি দেয়া অতিজরুরি। আশার কথা, আমাদের পরিকল্পনা কমিশন ব্যাপারে সচেতন আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সব সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি প্রত্যয়ে ঘাটতি হবেই। সমস্যারা পরস্পরের মিত্র, একটার সঙ্গে আরেকটার যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইন-শৃঙ্খলার সঙ্গে ব্যক্তিনিরাপত্তার, ব্যক্তিনিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে আয়-উপার্জনের সব কার্যক্রমের কার্যকরণগত সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয়-উপার্জনের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ। কর্মদক্ষতা কর্মক্ষমতা উৎপাদন ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবেএটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য, যেখানে সীমিত সম্পদের সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটাকে উপেক্ষা মানে যুগপত্ভাবে অন্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেয়া। করোনাকালের অর্থনীতি সামাল দেয়ার জন্য সমস্যার উেস গিয়ে সমস্যা সমাধানে ব্রতী হতে হবে। কাজ কারো একার নয়, শুধু সরকারের তো নয়ই; কাজ সবার। সব উন্নয়ন ব্যয় প্রাক্কলন পুনরায় কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন হবে। অপচয়-অপব্যয়ের সুযোগ সেখানে এখনো রাখা আছে কিনা, এত শক্তিশালী পিপিআর আইন থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ সরকারি পূর্ত নির্মাণ সররবরাহের কাজ একটি মহলের কাছে কীভাবে যায় এবং তার প্রচুর অর্থ কুক্ষিগত করার সুযোগ সেখানে কীভাবে কতটা প্রবিষ্ট হয়েছে, এসব সমীক্ষা শুরু হওয়া দরকার। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের নমিনাল বরাদ্দ এমনিতেই হ্রাসমান ছিল। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো ঘাটতির দৈন্যে এটা বেরিয়ে আসছে যে বরাদ্দ যা- ছিল, তাও অব্যবস্থাপনা দুর্নীতিতে নিঃশেষ, নানান অনুযোগের সুযোগে সিন্ডিকেট স্বাস্থ্যসেবার মতো জরুরি নৈতিক দায়িত্বপালন বার্গেনিং জিম্মিকরণের পর্যায়ে চলে গেছে। সমস্যাগুলো সুদূরপ্রসারী প্রতিফলকে বাজেটে বাস্তবতার চশমায় দেখার দরকার অনিবার্য হয়ে উঠবে। করোনাকালের বাজেটে এসব বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ থাকবে না। 

 

. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন