কভিড ১৯ : বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ এবং বাজেট

রাজেকুজ্জামান রতন

বাজেট শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, একটি অর্থনৈতিক নির্দেশনাও বটে। বাজেট ২০২০-২১ এমন সময় প্রণীত হতে যাচ্ছে যখন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ করোনা সংক্রমণ, মৃত্যু, কর্মহীনতা, ছাঁটাই, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের কারনে কারখানা বন্ধ করা এবং আবার খুলে দেয়া, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সংকোচন করা ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এক ঝুঁকিপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ চিহ্নিত হয় ৮ মার্চ ২০২০। চীনের উহানে ডিসেম্বর ২০১৯ এ করোনা সংক্রমণের পর বিশ্বব্যাপী তার বিস্তৃতি ও ভয়াবহতা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার কী প্রভাব পড়তে পারে এবং শ্রমজীবী মানুষ কতখানি দুর্দশায় পড়তে পারেন তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র বুঝতে পারা যায় নি। প্রথম ধাক্কাটা এলো তখনই যখন ফেব্রুয়ারিতে বিদেশ থেকে কাজ হারিয়ে প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরে আসতে শুরু করেছিলো। একদিকে তাদের যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিনে করতে না পারায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি ও পরিধি বেড়ে যায় অন্যদিকে কর্মহীন প্রবাসীদের ভবিষ্যৎ কি হবে তা এক দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর যে দেশেই যাওয়ার সুযোগ আছে সেখানেই বাংলাদেশের যুবকরা পাড়ি জমিয়েছে কাজ এবং উন্নত জীবনের আশায়। পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন আর দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার এক নিয়মিত সরবরাহকারী এই প্রবাসী শ্রমিকেরা। ১৫৯টি দেশে ১ কোটি ২২ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করে বছরে ১৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায় তারা। এই শ্রমজীবীদের মধ্যে থেকে ইতোমধ্যে ৬ লাখের বেশি ফিরে এসেছেন, আরও ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। আবার অন্যদিকে বিদেশে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা ৪ লাখ কর্ম প্রত্যাশী যুবকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শ্রমশক্তির প্রধান বাজার তেলের উপর নির্ভরশীল মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছে ফলে তাদের দেশে কাজের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিদেশ যেতে আগ্রহী বাংলাদেশের শ্রমিকদের উপর। কভিড ১৯ প্রবাসী শ্রমিকদের শুধু করোনা সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলেছে তা নয় তাদের জীবিকা এবং ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। কাজের ধরন পালটে গেলে বর্তমান দক্ষতা দিয়ে কাজে যুক্ত থাকা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে বিদেশ যেতে হলে নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা ও দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য করনীয় পন্থা এবং তাদের কর্মসংস্থানের খাতসমুহ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৯৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এতো বড় খাতে এতো কম বাজেট, এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।     
 
বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রধানত গার্মেন্টস, পাট, চামড়া, চা, মৎস্য, ওষুধ শিল্পের উপর নির্ভরশীল। এ সবগুলো শিল্পই শ্রমঘন এবং স্বল্প মজুরি ও দীর্ঘ কর্ম ঘণ্টা নির্ভর। কাজের নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা দুর্বল। করোনা পরিস্থিতি এসব খাতের শ্রমিকদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে সাথে সাথে চাকুরির নিশ্চয়তা কমিয়ে দিয়েছে প্রচণ্ড ভাবে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত, রপ্তানির ৮০ ভাগের বেশি জুড়ে আছে তৈরি পোশাক খাত। গত অর্থ বছরে মোট রপ্তানি ৪০ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছিল তৈরি পোশাক খাত থেকে আসা। যদিও অর্থনীতির হিসাবে ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হলেও এ খাতের জন্য আমদানিও বিপুল। প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার। আমদানি রপ্তানির ব্যবধান ১৬ বিলিয়ন ডলার। শ্রমিকের মজুরী গড়ে ১০ হাজার টাকা ধরলে বার্ষিক মজুরী বাবদ ব্যয় দাঁড়ায় ৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বাবদ খরচ বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে সেটাই মালিকদের মুনাফা। এক্ষেত্রে কারখানা যত বড়, মুনাফা তত বেশি।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত প্রায় সম্পূর্ণটাই ইউরোপ ও আমেরিকা নির্ভর। করোনায় সে সব দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশ খানিকটা। বিশেষ করে সে অঞ্চলের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তার প্রভাব বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে পড়বে। ইতিমধ্যে  বিদেশী ক্রেতাদের মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতার কারনে অনেক ক্রয় আদেশ তাঁরা স্থগিত করেছেন, যার পুরো আঘাতটাই মালিকরা চাপিয়ে দিতে চাইছেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপর। মজুরী কেটে নেয়া, ছাঁটাই, কারখানা লে অফ করা তো চলছেই এবং আশংকা সৃষ্টি হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে, এরপর আক্রমণটা আসবে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের উপর। তাদেরকে শুধু চাকুরিচ্যুত করাই নয়, বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে শাস্তি দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে যা অতীতেও দেখা গেছে। এই খাতে কর্মরত ৪০ লাখ শ্রমিক যারা এতদিন মালিকের মুনাফা আর সরকারের রাজস্ব যোগাতে প্রধান ভুমিকা পালন করেছেন তাঁরা আজ কাজ হারিয়ে বেকারত্বের ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছেন।

দেশীয় শিল্প হিসেবে পাট শিল্প ও শ্রমিকরা জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। একটি স্থায়ী শিল্প হিসেবে একে টিকিয়ে রাখা এবং শ্রমিকদের মজুরি পাওয়ার বিষয়টি ভাবতে হবে। গত অর্থবছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে পাট শিল্প রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা, পাট চাষের সঙ্গে যুক্ত কৃষক, পাট সম্পর্কিত কাজে যুক্ত মানুষ নিয়ে ভাবলে পাট শিল্প বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনো বিশ্ববাজারে পাট ও পাট জাত দ্রব্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রথম এবং এর বিস্তার ঘটানোর বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশ সম্মত পণ্য উৎপাদনে পাট এখন দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।  

পরিবহন খাতকে দেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহের সাথে তুলনা করা যায়। প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। যাত্রী, কৃষি ও শিল্প পণ্য পরিবহন, আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহন সহ সেবা খাতের এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে পরিবহণ খাত যুক্ত নয়। কিন্তু এখাতের সঙ্গে যুক্ত ৬০ লাখ শ্রমিকের চাইতে ঝুঁকিপূর্ণ আর কেউ নয়। এই ঝুঁকি শুধু দুর্ঘটনার নয় তাদের জীবিকা ও চাকুরিও ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরাপত্তাহীন। এছাড়াও নির্মাণখাতের ৩০ লাখ, রি রোলিং, চা, তাঁত, রিক্সা, অটো রিকশা, ইজি বাইক, ছোট দোকানদার, চা দোকানদার, হকার, পর্যটনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ, গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সেলুনকর্মী, পাদুকা শ্রমিক সহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক যাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি এবং যারা অর্থনীতিতে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখে তারা সব সময়ই উপেক্ষিত থাকে। কি বাজেটে, কি প্রণোদনা প্রাপ্তিতে তাদের অবস্থান নগন্য। প্রচারের আলোয় দৃশ্যমান না হলেও দেশের অর্থনীতি ও কর্ম সংস্থানের প্রধান খাত হিসেবে এসব খাতের ব্যাপারে করনীয় নির্ধারণ ও বাজেটে বরাদ্দ করাটাও খুব জরুরি।
  
লেবার ফোরস সারভে অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রমশক্তির সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখের বেশি। তারা দেশকে কী দেন? উৎপাদনে, বিপণনে ভুমিকা রাখেন এটা তো সবাই দেখে কিন্তু নীরবে দেশের অর্থনীতিতে কত বড় ভুমিকা তারা রাখেন তার উল্লেখ কোথাও থাকে না। বাজেটে তারা উপেক্ষিত যদিও বাজেটের অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে তাদের ভুমিকা উপেক্ষণীয় নয় কোনমতেই। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টাকা রোজগার করলে তারা বছরে কমপক্ষে ৭ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেন। এই টাকার পুরোটাই তারা খরচ করেন খাদ্য, বাসা ভাড়া, পোশাক, চিকিৎসা, যাতায়াত করার জন্য। ফলে দেশের অর্থনীতিতে এ এক বিশাল সংযোজনা। এই শ্রমজীবীরা রাজস্ব প্রদানেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। শুধু ভ্যাট প্রদানের কথা বিবেচনা করলেও তো তারা ১ লাখ কোটি টাকার বেশি প্রদান করেন। এরা ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয় না, বিদেশে টাকা পাচার করে না, বরং দেশের উৎপাদিত পন্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবদান অনস্বীকার্য যদিও তাদের মাথাপিছু আয় ঘোষিত আয়ের চেয়ে কম। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতেও একটা দেশ কতটা স্থিতিশীল ও বিকাশমান তা বুঝার জন্য আভ্যন্তরীণ বাজার কত বড় তা একটা মাপকাঠি। যেমন ধরুন, চীনের মানুষের মাথাপিছু আয় ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশ তো বটেই জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়ার চাইতে কম কিন্তু তার অর্থনীতি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম। এর বড় কারণ চীনের বিশাল আভ্যন্তরীণ বাজার, যে কারনে চীনের অর্থনীতি শুধু বিকাশমান নয় অনেক দেশের জন্য আতংকেরও বটে।

করোনা মহামারী সারা বিশ্বের অর্থনীতির গতিপথ এবং ধরন পাল্টে দেবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। করোনা ভাইরাসজনিত কারণে ব্যবসা সংকুচিত হওয়া, উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, মানুষের চলাচল কমে যাওয়ায় অনেক ধরনের পেশার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। করোনা দেখিয়ে দিয়েছে আভ্যন্তরীণ খাত দুর্বল রেখে উন্নয়ন অনেকটা বালু চরে বালু দিয়ে সৌধ নির্মাণ করার মত। দুর্দশা আর বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে সস্তা শ্রমিক আর রপ্তানিমুখি পোশাক শিল্পের উপর নির্ভর করা অর্থনীতি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। মুনাফার আগ্রাসী থাবায় বিপর্যস্ত শ্রমিক যদি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যই ব্যস্ত থাকে তাহলে তার উৎপাদনশীলতার বিকাশ ও দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি কোনটাই সম্ভব নয়। বাজেটে তাই শ্রমিকের রেশন, চিকিৎসা, বাসস্থান, সন্তানের শিক্ষা, শিশু যত্ন কেন্দ্র, দুর্ঘটনা বীমা বাবদ বরাদ্দ দরকার যেন শ্রমিক জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করতে পারে। শ্রমিকের ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে তা যে অর্থনীতিকেই গতিশীল করে তা তো নতুন করে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। দরকার বাজেটে তার প্রতিফলন।

লেখক: রাজেকুজ্জামান রতন
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন