উন্নয়নের প্রচল চিন্তা ও কভিডকালীন শিক্ষা

হুমায়ুন কবির

চলমান মূলধারার উন্নয়নচিন্তা সর্ব-দিকবিস্তারী নয়, একপেশে। এখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই মুখ্য। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি ও জীব-অনুজীবের স্বভাবিক সহাবস্থানের সম্পর্ক এখানে গৌণ। ফলে পরিবেশধংসী শিল্পায়ন, বড় করপোরেশনগুলোর মুনাফা সর্বোচ্চকরণ ও প্রবৃদ্ধির সংখ্যাগত উল্লম্ফনই সবসময় বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বিদ্যমান উন্নয়নচিন্তায়। এ চিন্তাপ্রক্রিয়ায় এমনকি প্রকৃতি, জীব-অণুজীবসহ প্রাণসম্পদও প্রবৃদ্ধির আধার ও মুনাফার উৎস। বাড়তি প্রবৃদ্ধির অভিপ্রায়ে উদগ্রভাবে গবেষণার বিষয় হয়েছে কৃত্রিম প্রজনন, উদ্ভিদ-প্রাণীর জিনগত রূপান্তর। এক্ষেত্রে কোন দেশ কার চেয়ে এগিয়ে থাকবে, এটিই যেন নিয়ত প্রতিযোগিতা। কিন্তু হঠাৎ করে এ চিন্তায় বড় ধরনের ছেদ ঘটিয়েছে একটি ক্ষুদে ভাইরাস। নভেল করোনাভাইরাস আক্ষরিক অর্থেই পুরো বিশ্বকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিকে করেছে স্থবির। সংকটে ফেলেছে কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা। করোনাভাইরাস মানবজাতি হিসেবে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে, বিদ্যমান প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্যারাডাইম এবং ধরিত্রী সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হাজির করছে। 

প্রথম শিক্ষা হলো, অবরুদ্ধ মুহূর্ত আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে ধরিত্রী সব প্রজাতির জন্য এবং আমরা যখন ঘরবন্দী হই, সড়কে গাড়ি চলাচল কমিয়ে দিই, তখন বায়ুদূষণ লক্ষ্যণীয় মাত্রায় কমে। ডলফিন সৈকতের কাছাকাছি এসে লুটোপুটি খায়। বিভিন্ন দেশের নানা এলাকায় হাতি-বানর ও অন্যান্য প্রাণী নিজেদের সুখ উদযাপন করে, নির্ঝঞ্ঝাটে জীবন চালিয়ে নেয়।

দ্বিতীয় শিক্ষা হলো, এ মহামারী ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়’ নয়, জলবায়ুর চরমভাবাপন্নতা বা বিরূপতা যেমনটা নয় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। উদ্ভূত রোগের মহাবিস্তারও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো, মানুষের কর্মকাণ্ড দ্বারা সৃষ্ট। বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে, যেহেতু আমরা বনের প্রতিবেশব্যবস্থায় অনধিকার চর্চা করেছি, বিভিন্ন প্রজাতির বসত ধ্বংস করেছি এবং মুনাফার জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর রূপান্তর ঘটিয়েছি; সেহেতু নতুন নতুন রোগের শর্তও সৃষ্টি করেছি। গত ৫০ বছরে ৩০০ নতুন প্যাথোজেন-ভাইরাস আবির্ভূত হয়েছে। এটা সুবিদিত এইচআইভি, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মার্স ও সার্সসহ প্রায় ৭০ শতাংশ প্যাথোজেন তখনই আবির্ভূত হয়; যখন বনের প্রতিবেশব্যবস্থার স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করা হয় এবং যখন ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষের কাছে জাম্প করে। যখন মুনাফাভিত্তিক সভ্যতার জন্য প্রাণীদের শিল্পখামারে আবদ্ধ করা হয়, তখন সোয়াইন ফ্লু ও বার্ড ফ্লুর বিস্তার ঘটে। বলতে গেলে, অন্য প্রাণী-প্রজাতি ও আমাদের সমকক্ষ আদি নৃগোষ্ঠীগুলোর অধিকারের প্রতি কোনো ধরনের সম্ভ্রমহীন মানব লালসাই হলো চলতি মহামারী ও ভবিষ্যৎ মহামারীগুলোর মূল। সীমাহীন প্রবৃদ্ধির মোহভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থনীতি ধরিত্রীর সম্পদের প্রতি সীমাহীন ক্ষুধার জন্ম দেয়, বিপরীতে যা ধারিত্রিক সীমানা, প্রতিবেশব্যবস্থার সীমানা এবং প্রজাতির সীমার নির্বিচার লঙ্ঘন ঘটায়।

আমাদের প্রতি দেয়া ভাইরাসটির তৃতীয় শিক্ষা এই যে, স্বাস্থ্য জরুরিবস্থা প্রজাতির বিলুপ্তি ও বিনাশের সঙ্গে সংযুক্ত। যখন আমরা পোকা ও আগাছা দমনে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করি, তখন একটি বিলুপ্তির সংকট অনিবার্য হয়ে উঠে। যখন আমরা ৬০০ মিলিয়ন বছরের অধিক সময়ে জমা হওয়া জীবাশ্ম কার্বন পোড়াই, তখন আমরা গ্রহের সীমানা লঙ্ঘন করি। আর এর পরিণাম হলো জলবায়ু পরিবর্তন। 

বৈজ্ঞানিক পূর্বানুমান নির্দেশ করে যে পৃথিবী এবং তার প্রজাতির বিরুদ্ধে এ মানবসৃষ্ট যুদ্ধ বন্ধ না করলে কয়েকশ বছরের মধ্যে আমরা সেই ব্যবস্থাটিই ধবংস করব, যা আমাদের মানবজাতির বিবর্তন ও টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। অন্য প্রজাতিগুলো প্রতিদিনই যে ক্রমে অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে, আমাদের অবস্থাও হবে তাই-ই। মানুষের লোভ, উদগ্রতা এবং দায়িত্বহীনতার জন্য আমরা হব অস্তিত্বের হুমকিতে পড়া বিপুলসংখ্যক প্রজাতির আরো একটি।  

আমাদের সময়ের সব জীবনসংহারী স্বাস্থ্য জরুরিবস্থাগুলো মানুষকে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে দেখার একটি যান্ত্রিক, সামরিক, মানবকেন্দ্রিক বিশ্ববীক্ষায় প্রোথিত। অর্থাৎ মানুষকে ধরিত্রীর প্রভু হিসেবে দেখার একটি প্রবণতা, যারা মুনাফার জন্য অন্য প্রজাতির ওপর মালিকানা আরোপ, ম্যানিপুলেট এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। এটি এমন এক অর্থনৈতিক মডেলের সঙ্গেও সংযুক্ত, যেটি প্রাতিবেশিক ও নৈতিক সীমাকে বাধা হিসেবে দেখে। এই মডেলে মাতৃবসুধার অধিকার, অন্য প্রজাতির অধিকার, মানবজাতির অধিকার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকারের কোনো স্থান নেই। 

সংকটকালে এবং লকডাউন-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের সময় আমাদের অবশ্যই পৃথিবী, তার জলবায়ু ব্যবস্থা, বিচিত্র প্রজাতি, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, নারী, কৃষক এবং শ্রমিকদের অধিকার ও প্রাতিবেশিক পরিসর সুরক্ষার বিষয়টি জানতে হবে। আমাদের অবশ্যই লোভ ও সীমাহীন প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি থেকে সরে আসতে হবে, যা আমাদের আজকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছে। আমাদের মনে এই বিষয়টি জাগিয়ে তুলতে হবে যে, আমরা সবাই একটি বৃহত্তর আর্থ ফ্যামিলির সদস্য এবং এখানে প্রকৃত অর্থনীতি হলো ধরিত্রী ও একে অন্যের যত্ন নেয়া।

ভবিষ্যৎ মহামারী, দুর্ভিক্ষ এবং মানুষকে খরচযোগ্য ভাবা ও ছুঁড়ে ফেলার একটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট এড়াতে আমাদের অবশ্যই বিশ্বায়িত, শিল্পায়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে যেতে হবে; যা জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে প্রজাতিগুলোকে বিলোপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং জীবনসংহারী রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে। বিচিত্র প্রজাতি, বিচিত্র সংস্কৃতি এবং বিচিত্র অর্থনীতির বিকাশের পরিসর সৃষ্টির ভালো উপায় পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক স্থানীয়করণ। আমাদের সচেতনভাবে প্রাতিবেশিক পদচিহৃ কমাতে হবে, যাতে আমরা অন্য প্রজাতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পদ ও প্রাতিবেশিক পরিসর সহভাগ করতে পারি, বিনিময় করতে পারি। চলতি স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এবং লকডাউন আমাদের দেখিয়েছে যে রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলে আমরা বি-বিশ্বায়ন করতে পারি।

চলুন, অর্থনীতির এই বি-বিশ্বায়ন দীর্ঘস্থায়ী করি এবং নিজস্ব দেশীয় বাস্তবতা ও  লোকজ সংস্কৃতি, দর্শনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উৎপাদনের স্থানীয়করণ ঘটাই।

অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, মাটি, পানি এবং প্রাণবৈচিত্র্যের পুনরুৎপাদন অক্ষুণ্ণ রেখে স্থানীয়, জীববৈচিত্র্যময় অর্গানিক খাদ্যব্যবস্থা আমাদের সবার স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের জোগান দিতে পারে। আমাদের বনে, খামারে, আমাদের অণুজীব ব্যবস্থায় প্রাণবৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি ধরিত্রী এবং মানুষসহ তার বিচিত্র প্রজাতিকে রোগের পরিবর্তে উন্নত স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করে।  

একটি ক্ষুদে ভাইরাসের মারণতাণ্ডব আমাদের সামনে দুটো পথ উন্মোচন করেছে। এক. প্রকৃতির সঙ্গে সংহতি বজায় রাখাপূর্বক আমরা এখন একটি ধরিত্রীবান্ধব, প্রাতিবেশিক সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারি। দুই. প্রকৃতির ওপর চলমান আধিপত্য জারি রেখে দ্রুত পরবর্তী মহামারী এবং চূড়ান্তভাবে আমাদের বিলুপ্তির যাত্রা সুগম করতে পারি। নিজেদের বিবর্তন না বিলোপ, কোন পথ আমরা বেছে নেব, সে পছন্দ এখন একান্ত আমাদেরই।

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন