করোনার আগেই নিম্নমুখী ছিল বিদেশী বিনিয়োগ

বদরুল আলম

নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে থমকে আছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। রফতানি থেকে শুরু করে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) সবখানেই চলছে খরা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, করোনাভাইরাসের আঘাত আসার আগে থেকেই নিম্নমুখী ছিল এফডিআই প্রবাহ।

চলতি মাসে এফডিআইয়ের সাময়িক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। ২০১৮ সালে দেশে এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩৬১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই কমেছে ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এটি করোনাভাইরাস হানা দেয়ার আগের চিত্র। বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, করোনাভাইরাসের প্রভাবে চলতি বছর বিদেশী বিনিয়োগ আরো কমে ২০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসতে পারে।

এফডিআই আকর্ষণে ২০১৮ সালে বড় উল্লম্ফনের মুখ দেখেছিল বাংলাদেশ। এর পেছনে মূল কারণ ছিল জাপানি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী তামাক ব্যবসা অধিগ্রহণ। বড় আকারের ওই অধিগ্রহণের অর্থ দেশে প্রবেশের ফলে এক লাফে ৬৮ শতাংশ বেড়ে যায় এফডিআই। কিন্তু পরের বছর নতুন বিনিয়োগ যেমন আসেনি, তেমনি বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরাও পুনরায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করেননি। ফলে ২০১৯ সালে বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ কমে গেছে।

অর্থনীতির বিশ্লেষকদের মতে, করোনার আগেই এফডিআই কমে যাওয়ার চিত্রটি ছিল বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশের নাজুক বাস্তবতার প্রতিফলন। জমি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের মতো ভৌত অবকাঠামোগত সম্পদে ঘাটতির পাশাপাশি বিনিয়োগের সার্বিক পরিবেশে ব্যাপক অস্বস্তি, অস্বচ্ছতা বিভ্রান্তি রয়েছে বাংলাদেশে। সক্ষমতার উন্নয়ন হচ্ছে ধীরগতিতে, যা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না। সবকিছুর প্র্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ২০১৯ সালের বিনিয়োগপ্রবাহের তথ্যে। করোনা প্রাদুর্ভাবে বৈশ্বিক বিনিয়োগের গতিপ্রকৃতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। সেখানে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমিন ভুল কৌশলে এগোলে এফডিআই প্রবাহ আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক . আহসান এইচ মনসুর বলেন, কভিড-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বিদেশী বিনিয়োগে অনেক ভালো কিছু দেখার সম্ভাবনা ছিল, কারণ অনেক কোম্পানি চীন থেকে মাইগ্রেট করছে। কিন্তু সেটা আমরা ধরতে পারছি না।  কভিডের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা আমাদের সামনে ছিল। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাপান থেকে অনেক কোম্পানি চলে আসছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানও চলে আসছে। আবার ট্যারিফসহ নানামুখী কারণে চীনা কোম্পানিগুলোও রি-লোকেট করছে। ইন্দোনেশিয়ায় এরই মধ্যে ২৭টি আমেরিকান কোম্পানি রি-লোকেট করছে। আমরা এখনো কিছু পাইনি।

আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, ২০২০ সাল অতিবাহিত হওয়ার পর বোঝা যাবে বিদেশী বিনিয়োগের অবস্থা কী দাঁড়ায়। খুব খারাপ পরিস্থিতিতে ২০০ কোটি ডলারের নিচেও নেমে যেতে পারে তা। সরকার নড়েচড়ে বসেছে, কিন্তু কতখানি সফল হবে তা বলা মুশকিল। কভিড নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাও আমাদের পিছু হটিয়ে দেবে। আশা ছাড়া যাবে না, আমাদের চেষ্টা করতে হবে। অনেক প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে নতুন মার্কেট অ্যাকসেস খুঁজতে হবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। ভিয়েতনাম যদি করতে পারে আমরা কেন পারব না?

ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বিনিয়োগকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে নিয়ে আসা অর্থসংক্রান্ত জরিপের ভিত্তিতেই এফডিআই প্রবাহের পরিসংখ্যান গতিপ্রকৃতির তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে নিট নিজস্ব মূলধন (ইকুইটি ক্যাপিটাল), আয়ের পুনর্বিনিয়োগ (রিইনভেস্টেড আর্নিংস) আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ (ইন্ট্রাকোম্পানি লোন) তিন ভাগে এফডিআই প্রবাহ হিসাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত বছর বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের আয়ের পুনর্বিনিয়োগ ছিল সবচেয়ে বেশি। মোট এফডিআই প্রবাহ ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার ডলারের মধ্যে নিট নিজস্ব মূলধন ছিল ৮০ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। আয়ের পুনর্বিনিয়োগ ছিল ১৪৬ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণপ্রবাহ ছিল ৬০ কোটি ২৯ লাখ ডলার।

বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে নিট নিজস্ব মূলধন প্রায় ২৯ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ বিদ্যমান বা নতুন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের নতুন বিনিয়োগপ্রবাহ কমেছে। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ বেড়েছে ১২ শতাংশ। আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণের মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ কমেছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন সূচক বিবেচনায় নতুন বিনিয়োগ আসছে না। আবার ঋণের মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ কমেছে ব্যাপক হারে। আর বিদ্যমান বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় থেকে পুনরায় বিনিয়োগ হচ্ছে সামান্য।

২০১৯ সালে প্রবাহ কমে গেলেও নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেশ তত্পরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) করোনাভাইরাসের উত্পত্তিস্থল চীন থেকে অনেক বিনিয়োগ প্রকল্প সরে যাওয়ার গুঞ্জনে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য করমুক্ত সুবিধা, বিনিয়োগ প্রণোদনা নির্ধারণসহ নানামুখী নীতিনির্ধারণ নিয়ে ব্যতিব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে সংস্থা দুটির কার্যক্রমে।

বিনিয়োগ আকর্ষণে নিয়োজিত পোষক কর্তৃপক্ষসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালে বিদেশী বিনিয়োগে বড় উল্লম্ফনের কারণ আকিজের তামাক ব্যবসা অধিগ্রহণ। কিন্তু ওই বিনিয়োগটি বাদ দিলেও বিদেশী বিনিয়োগে ঊর্ধ্বগতির প্রবণতাই ছিল। তবে এটা ঠিক যে সেই ঊর্ধ্বগতি নিয়ে স্বস্তির কোনো কারণ নেই। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আসা দরকার ছিল তা আসেনি। আরো অনেক তত্পরতা সমন্বয়ের প্রয়োজন, যার ঘাটতি আছে। প্রস্তুতি নিয়ে পরিপূর্ণ একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বীরা কীভাবে এফডিআই আকর্ষণ করছে তা লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। কভিড-১৯-এর কারণে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। সেই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে কাজ করে যেতে হবে। বেজাও কাজ করছে। পরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য বেজার জমি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে।

কভিড-১৯-এর আগে থেকেই এফডিআই আকর্ষণে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, কভিড-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে তা নতুন করে সাজাতে হবে বলে মনে করেন বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এফডিআই বাড়াতে বড় ধরনের কৌশল নির্ধারণ করে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। আমাদের হতাশ হলে চলবে না। কভিড-১৯ আমাদের আরো কোণঠাসা করে ফেলেছে। আমাদের চিন্তা করতে হবে আসন্ন বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা মাথায় রেখে। মহামন্দাকে আমরা কীভাবে মোকাবেলা করব, সে বিষয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে।

আঙ্কটাড বলছে, কভিডের প্রভাবে বৈশ্বিক এফডিআই প্রবাহ ৩২ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাবে তথ্য উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম আরো বলেন, এর অর্থ দাঁড়ায় কভিড-১৯-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এফডিআই নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হবে। এফডিআই আকর্ষণে আমাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে। কভিড-১৯ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। যে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ছিল তা অর্থবছর বা আগামী অর্থবছরে অর্জন করা খুবই কঠিন হবে। বছর তো যাবেই না, কারণ পুরো একটি প্রান্তিক সবকিছুই স্থবির ছিল। আগামী বছর প্রবৃদ্ধিটা যেন ধরে রাখতে পারি, সে চেষ্টাই করতে হবে। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর। কভিড-১৯ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাটা অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে। এখন পর্যন্ত বিষয়ে পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম আমরা হইনি।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে ইনভেস্টমেন্ট ট্রেন্ডজ মনিটর প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের বিনিয়োগ বাণিজ্য প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা আঙ্কটাড। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে এফডিআইয়ের বৈশ্বিক প্রবাহ ছিল কম। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক এফডিআই প্রবাহ ছিল দশমিক ৪১ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালে শতাংশ কমে দশমিক ৩৯ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিক ধারা অব্যাহত রেখে গত বছরও এফডিআই প্রবাহ কম ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট এফডিআই প্রবাহ কমলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে বলে জানিয়েছিল আঙ্কটাড। অঞ্চলে এফডিআই প্রবাহ ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে হাজার কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধির চালক ছিল ভারত। দেশটিতে গত বছর ১৬ শতাংশ বেড়ে এফডিআই প্রবাহের আনুমানিক পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগের বেশির ভাগই এসেছে সেবা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। ভারতে বাড়লেও বাংলাদেশ পাকিস্তানে এফডিআই প্রবাহ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি এফডিআই এসেছে চীন থেকে। এর পরই বেশি বিনিয়োগ এসেছে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র নরওয়ে থেকে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, ভারত, জাপান, তাইওয়ান, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, বারমুডা, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কানাডা, মালয়েশিয়া ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস থেকেও বিনিয়োগ এসেছে দেশে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন