বাজার ও অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিবাদ

বণিক বার্তা ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে বিদ্যমান দা-কুমড়া সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ওয়াশিংটন শিগগিরই বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে, তাতে মনে হচ্ছে যে তারা নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিতে বেশিদিন সময় নেবে না। বিশেষ করে হংকং ইস্যু সম্ভাবনা আরো জোরালো করেছে। অবস্থায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহী, বিনিয়োগকারী অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের জন্য যে প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো, পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে। খবর ব্লুমবার্গ।

বুধবার নতুন করে দুটি ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে নিজেদের কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল পম্পেও বলেছেন, চীন কার্যত হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ করছে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালানোর কারণে চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার অনুমোদন দিয়েছে। ওয়াশিংটনের খড়্গের নিচে আরো রয়েছে হুয়াওয়ে টেকনোলজিস কোম্পানি, মার্কিন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা চীনা কোম্পানি হংকংয়ের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ব্যাংকগুলো।

তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিলে চীন যে ছেড়ে কথা বলবে, তা নয়। বেইজিংও ওয়াশিংটনের যেকোনো সিদ্ধান্তের পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।

বিনিয়োগকারীরা এখন পর্যন্ত চলমান উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তাদের মতো করে সামাল দিয়েছেন। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি গভীর এক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এর ফলে মহামারীটির বৈশ্বিক রূপ ধারণের প্রথম দিকে প্রায় সব পুঁজিবাজারেই শেয়ারদরে ব্যাপক ধস নামে। তবে বিভিন্ন দেশের সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজিরবিহীন প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দেয়ার পর বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আশাবাদী হয়ে ওঠেন। ফলে শেয়ারদরও মার্চের শুরুর দিকের পর রেকর্ড উচ্চতায় উঠে যায়। এছাড়া করোনা প্রতিরোধে আরোপ করা লকডাউন শিথিল হতে শুরু করায়ও বাজার কিছুটা চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। তবে তার মানে এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।

বরং বাজারের জন্য সামনের দিনগুলোয় কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এর লক্ষণ এরই মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। অফশোর ট্রেডিংয়ে বুধবার চীনের ইউয়ানের মান ছিল রেকর্ড সর্বনিম্ন। এদিন বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের তুলনায় হংকংয়ের লাখ ৯০ হাজার কোটি ডলারের পুঁজিবাজারের বাজার মূলধন ১৯৯৮ সালে এশিয়ার আর্থিক সংকটের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসে।

গুয়াংঝুর স্নোবল ওয়েলথের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লি চ্যাংমিন বলেছেন, আমার কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র চীন তাদের দ্বন্দ্বকে পুরোদমে আর্থিক যুদ্ধের রূপ দিচ্ছে। এর প্রভাবে মুদ্রার মান কমে যাচ্ছে, তহবিল সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়ছে, কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি আটকে যাচ্ছে।

সিসিবি ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের হেড অব স্ট্র্যাটেজি ক্লিফ ঝাও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আরো বাড়লে সামনের মাসগুলোয় হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক ১০ শতাংশের বেশি কমে প্রায় চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে যেতে পারে। এছাড়া হংকং ডলারের বড় ধরনের অতিমূল্যায়নের আশঙ্কাও করছেন বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে হংকংয়ের মুদ্রার মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে এর ট্রেডিং ব্যান্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ১৯৩০-এর দশকের পর সবচেয়ে বাজে সংকোচনের মুখে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। তবে ধীরে ধীরে পতন থেকে উত্তরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ঠিক সময়ে ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের আঘাত-পাল্টা আঘাত নীতির কারণে কেবল তাদের মধ্যকার ফেজ ওয়ান বাণিজ্য চুক্তিই হুমকির মুখে পড়বে না, বরং পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

হংকং ইস্যু যুক্তরাষ্ট্র চীন উভয়ের জন্যই কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেকোনো কঠোর নীতি গ্রহণ করলে দুই দেশকেই এর মূল্য চুকাতে হবে। হংকং হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্ট হাব। ২০১৯ সালে এখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আর হংকং থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ পণ্য রফতানি হয়, তার ৯৯ শতাংশই চীনে তৈরি। এছাড়া চীনের বাজারে ব্যবসার ক্ষেত্রেও মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য নিরাপদ একটি ঘাঁটি হলো হংকং। কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে প্রায় ২৯০টি মার্কিন কোম্পানির আঞ্চলিক সদর দপ্তর ছিল হংকংয়ে। আরো ৪৩৪টি কোম্পানির আঞ্চলিক কার্যালয় ছিল সেখানে।

অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রাইমারি গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে হংকং। ২০১৮ সালে দেশটির লাখ ১৮ হাজার কোটি ডলারের আর্থিকবহির্ভূত বিনিয়োগের ৫৩ শতাংশই প্রবাহিত হয়েছে চ্যানেল দিয়ে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রায় শতাংশ সম্পদ রয়েছে হংকংয়ে। সেখানকার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে শত শত চীনা কোম্পানি।

অর্থাৎ হংকং ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র চীন কোনো কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হলে তা উভয় দেশের অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা পুরো বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের বিষয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন