জাতির বিবেক

মুহম্মদ মোফাজ্জল

করোনাকালে এমন একটি অবস্থার কথা চিন্তা করা যাক- যেখানে আপনি দমবন্ধ অবস্থায় ঘরবন্দি আছেন। রিমোট টিপে আপনি একে একে সব টিভি চ্যানেলই ঘুরছেন। কিন্তু কোন চ্যানেলেই দেশ-বিদেশের করোনা মহামারীর কোন খবর পাচ্ছেন না। সব চ্যানেলে শুধু নাচ-গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। ফলে আপনি জানতে পারছেন না করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা, কোথায় কী সংকট, করোনা প্রতিরোধে গৃহীত সরকারি উদ্যোগ, কিংবা কোন হাসপাতালে চিকিৎসার কী অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। ধরুন একই অবস্থা পত্রিকা এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে। এসব মিডিয়াতেও যদি জনসচেনতা সৃষ্টিসহ করোনা মোকাবেলায় কোন ভূমিকাই না রাখে, তাহলে? আর এমন পরিস্থিতিতে আবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরও যদি না পান তাহলে পরিস্থিতি আরো অকল্পনীয়।

এমন পরিস্থিতি হলে তা সত্যিই ভয়াবহ হবে। কিন্তু না, সাংবাদিকরা এমনটা করবেন না বলেই আপনি ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস না পেলেও বিছানায় শুয়ে-বসেই করোনা মহামারীর তথ্য পাচ্ছেন। করোনা মহামারীর শুরুর দিকে আতঙ্কে অনেক চেম্বারেই চিকিৎসকদের না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। আবার অনেকেই অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছিলেন। এমন কঠিন সময়েও টিভি চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠান, পত্রিকার পাতা এবং অনলাইনে পোর্টালে ‘ডাক্তারের চেম্বার’ খোলা থাকতে দেখেছি। করোনার তথ্য তো আর পায়ে হেঁটে বার্তাকক্ষে পৌঁছায় না। তাই পেছনের চিত্রটা হচ্ছে ঝুঁকি নিয়েও সংবাদ পরিবেশন করায় অনেক গণমাধ্যমকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত চারজন মারা গেছেন আর আক্রান্ত হয়েছেন ১৭৪ জন। ১৭৪ জন আক্রান্ত হলে কতজনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হয় সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। আর সে কারণে ইতোমধ্যে কোন কোন গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষ প্রায় শূন্য। তারপরও এ কারণে গণমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশন বন্ধ থাকেনি। করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য আর্থিক প্রণোদনা সহায়ক প্রতিবেদন ছাপানোও বন্ধ ছিল না।

সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত একটি প্রতিবেদন যাদের পক্ষে যায় তাদের কাছে সেই সাংবাদিক ‘জাতির বিবেক’। সেটাও ক্ষণিকের। আর যাদের বিপক্ষে যায় তাদের কাছে সেই সাংবাদিক কী রকম মানুষ বা প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয় তা সহজেই অনুমেয়। সেটা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেন সাংবাদিক নিজে। প্রতিবেদনে যারা নাখোশ বা ক্ষুব্ধ তাদের প্রতিক্রিয়া অম্লমধুর থেকে শুরু করে অনেক স্বাদের হয়। যে সেই স্বাদ গ্রহণ করে তিনিই বুঝতে পারেন।

প্রতিদিন পাঠক বা দর্শক অনেক প্রতিবেদন পড়েন বা দেখেন। তারা যে প্রতিবেদনটি পাঁচ মিনিটে পড়ে ফেলেন বা টিভিতে তিন-চার মিনিটে দেখে ফেলেন তার তথ্য সংগ্রহ এবং প্রতিবেদন তৈরিতে কত সময় কীভাবে লাগে তার ওপর সিংহভাগের ধারণা নেই। তথ্য সংগ্রহে ভিক্ষুকের মতো সাংবাদিকেরও ‘পা-ই লক্ষ্মী’। প্রতিবেদনের জন্য সব তথ্যই সহজলভ্য নয়। মাঝে মাঝে তথ্য চেয়ে সাংবাদিকের আকুতি যেন ভিক্ষুকের আকুতিকেও হার মানায়। খারাপ লাগলেও এতে লজ্জার কিছু নেই। অনেক সময় তথ্য পেতে তাদের কৌশল অবলম্বন করতে হয়। পায়ে হেঁটে, সম্পর্কের খাতিরে এবং কৌশলে তথ্য হস্তগত হলেই যে শতভাগ প্রতিবেদন অনায়াসে তৈরি করা যায় না। কখনো অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়।

অনেক সময় দেখা কোন এক কর্তৃপক্ষ নানামুখি চাপে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কিন্তু একটি প্রতিবেদন সেই ঝুলে থাকা সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে সহজ করে দেয়। ছোট্ট একটি প্রতিবেদন যেমন গোটা ইকনোমিক লাইফ লাইনকেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে তেমনি কোন অসহায়ের জীবন রক্ষায়ও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। সেখানেই সাংবাদিকের আত্মতৃপ্তি। সাংবাদিকতা পেশা নয়, পেশন। একটি সফল প্রতিবেদনের সুখানুভূতির সাথে অন্য পেশার সুখানুভূতির অনেক ফারাক।

পৃথিবীতে একটি মাত্র পেশা আছে যারা দেয় বেশি নেয় কম। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক। এটা প্রমাণিত সত্য। মাত্র একশ শব্দের একটি প্রতিবেদনও অনেক সময় কর্তৃপক্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নেও ভুল শুধরে দেয়। যার পরোক্ষ সুবিধাভোগী হয় সাধারণ মানুষ। ধরা যাক কোন একটি সংবাদের কারণে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ বা রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বড় রকমের লোকসান থেকে বেঁচে গেল। তখন কি তারা সাংবাদিককে ডেকে বলেন যে ভাই আপনার রিপোর্টে আমরা এত কোটি টাকার লোকসান থেকে বাঁচালেন? তাই বিনিময়ে আপনিও এই পরিমাণ টাকা পাচ্ছেন। কিংবা একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন যখন অপর কোন পক্ষের শত কোটি টাকা লাভে সহায়ক ভূমিকা রাখে তখন তারাও কি এমনটা করেন? একেবারেই না। কারণ প্রতিবেদনের প্রতিদান কাম্য নয়। সাংবাদিকরাও সেইসব প্রতিবেদনের কথা ভুলে গিয়ে নতুন তথ্যের সন্ধানে ঘোরেন। এটিই তাদের কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে কখনো তার কপালে জুটে সংক্ষুব্ধ পক্ষের অপবাদ, তীরস্কার, হুমকি, হামলা, মামলা, চাকুরিচ্যুতি বা তারও বেশি কিছু। গণমাধ্যম জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নয়। প্রথম জবাবদিহিতা গণমাধ্যমকর্মীর নিজের বিবেকের কাছে। তারপর নিজের অফিস এবং প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে  গণমাধ্যমকর্মীকে জবাবদিহীতার আওতায় আনা যায়। গণমাধ্যমকর্মীরও ভুল হয়। কারণ তারাও মানুষ। কিন্তু দৃশ্যত এখন তারা ভুলের জন্য যতটা না নাজেহাল হচ্ছেন তার চেয়ে বেশি নাজেহাল হচ্ছেন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কথিত ’মানহানি’ মামলায়।

একটি প্রতিবেদন একজনকে যেমন তারকা খ্যাতি অর্জনে সহায়তা করে তেমনি ন্যায় বিচার পেতেও সহায়তা করে। গণমাধ্যমকর্মী দায়িত্ব পালনে কোন বাছবিচার বা প্রতিশোধ পরায়ণ আচরণ করেন না। আজ যে বাহিনী গণমাধ্যম কর্মীকে পেটাল আগামীকাল দেখা গেল সেই বাহিনীর এক সদস্যের দায়িত্ব পালনকালে বুকফাটা কষ্টের একটা ছবি পত্রিকায় ছাপা হল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হল আর গোটা দেশ সহানুভূতি প্রকাশ করল।

আত্মতৃপ্তিই হচ্ছে সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় পাওয়া। যা আসে একটি প্রতিবেদনের সফল প্রতিফলের মাধ্যমে। একটি তথ্য পাওয়ার পর সাংবাদিকের অন্তর্নিহীত উপলব্ধি হচ্ছে- আমি পেয়েছি, পেয়েছি। তিনি এমন একটা কিছু পেয়েছেন যা প্রকাশিত হলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরকার বা দেশ উপকৃত হবে কিংবা বড় রকমের ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে। একটি প্রতিবেদন যখন ফলপ্রসূ হয় তখন একজন সাংবাদিকের চেয়ে সুখী আর কেউ থাকে না। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কোন কোন সাংবাদিকদের যানাজায় অংশ নিয়ে ছোট্ট জটলায় ফিশফিশে আলোচনায় কান পেতে বুঝা গেছে জাতির বিবেকের মৃতদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর খরচের টাকাটা কীভাগে জোগাড় হয়েছে তাই নিয়ে কথা হচ্ছে। এটি হচ্ছে সুখানুভূতির পেছনের চিত্র।

যতই সাংবাদিককে জাতির বিবেক বলে কটাক্ষ বা ব্যক্তিস্বার্থ বিঘ্নিত হলে শত্রু ভাবাপন্ন ভাবুন না কেন, জাতির বিবেক সংকুচিত হলে সাধারণের অধিকারও সংকুচিত হয়, প্রতিষ্ঠান ও সরকারের বন্ধু ও শত্রু চিনতে ভুল হয়, ভালো উদ্যোগ বিতর্কিত হয়, ভেস্তে যায়, সর্বোপুরি সুশাসন বিঘ্নিত হয়। সেটা কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না।

লেখক: মুহম্মদ মোফাজ্জল
সাংবাদিক, লেখক ও নির্মাতা 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন