মহামারী পরবর্তী কেমন সরকার প্রয়োজন?

রঘুরাম রাজন

কভিড-১৯ এর বিস্তার থেমে নেই, এর মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে যে মহামারী পরবর্তী সমাজ তাহলে কেমন হবে? কত সহজে জীবন ফুরিয়ে যেতে পারে- তা দেখে সাধারণ জনগণ বিহ্বল হয়ে পড়েছে, তাই তারা ঝুঁকি কমাতে চাইবে। উদীয়মান নতুন ঐকমত্য অনুসারে, তারা চাহিদা চাঙ্গা করা (অর্থনীতিতে কোটি কোটি ডলারের অনুপ্রবেশ ঘটানো), কর্মীদের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিধি বিস্তার এবং অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে অবস্থান নিবে।

কিন্তু প্রায় প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন স্তরের সরকার রয়েছে, এক্ষেত্রে সম্প্রসারণটা কোন সরকারের ক্ষেত্রে ঘটবে? যুক্তরাষ্ট্রে স্পষ্টভাবেই কেবলমাত্র ফেডারেল গভার্নমেন্টের হাতে সম্পদ রয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোতে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আছে। যা এখন অব্দি এই স্তরের সরকারের পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি অনুমোদন করে না। সর্বোপরি, এটি এমন কিছু নীতি গ্রহণ করতে সক্ষম যা কিছু নির্বাচনী এলাকাকে সুরক্ষিত করলেও অন্যদের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে, কিছু দেশ লকডাউনের ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং উঠিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে কেন্দ্রীভূত করেছে, অন্যরা সিদ্ধান্তগুলো রাজ্য সরকার এমনকি পৌরসভার উপর ছেড়ে দিয়েছে। (বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভারত যেমন এ পদ্ধতির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে)। তবে যে বিষয়টি স্বচ্ছ হয়েছে তাহলো, সব অঞ্চল ব্যবসা সংক্রান্ত একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি নয়।

জনাকীর্ণ নিউইর্য়ক শহরে কঠোর লকডাউন ব্যবস্থা যেমন রাস্তা থেকে লোকজন সরানোর একমাত্র উপায় হতে পারে, এবং যার অর্থনৈতিক প্রভাবও সহনশীল হতে পারে এ কারণে যে জনগণ মূলত ফাইনান্সের মতো দক্ষ পরিষেবাগুলোতে কাজ করে, যা দূর থেকে বা ঘরে বসেও করা সম্ভব। তাছাড়া, ছাঁটাই হয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁর ওয়েটার আর হোটেল কর্মীরা জানে যে, জনগণ যতদিন পযর্ন্ত না বাইরে যেতে নিরাপদ বোধ করবে ততদিন পর্যন্ত তারা তাদের কাজে ফিরে পাবে না। স্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্ধেগগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বিপরীতে নিউইর্য়ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ’নিউ মেক্সিকোর ফার্মিংটনে খুব অল্পসংখ্যক লোক জানেন যে, কেউ একজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তবে বেশিরভাগ মানুষই তাদের চেনেন যারা করোনা ভাইরাসের কারণে চাকরি খুইয়েছেন।’ রাষ্ট্রটির গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক আরোপিত লকডাউন এমন একটি সম্প্রদায়ের জন্য অপ্রচলিত হয়ে উঠেছে যারা মহামারী শুরু হওয়ার আগেই গুরুতর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত ছিল। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক উদ্বেগগুলো আরো বেশি স্বাস্থ্যগত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।

এ পার্থক্যগুলো কেন্দ্রীয়ভূতীকরণের ত্রুটির, সবার জন্য একই পদ্ধতি সঠিক, বিষয়টি তুলে ধরে। তবে বিকেন্দ্রীকরণও সমস্যা হতে পারে। একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যদি বিভিন্ন মাত্রায় ভাইরাস থাকে সেক্ষেত্রে কী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করা সম্ভব? এর ফলে যা দাঁড়ায়  তাহলো,  নিরাপদ অঞ্চলগুলো সম্ভাব্য হট জোনগুলো থেকে লোক আসা নিষিদ্ধ করতে অথবা তাদের লম্বা কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে চাইবে। একটি দ্রুত, সস্তা এবং নির্ভরযোগ্য করোনা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা সম্ভাবত উক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান আনতে পারে।

অঞ্চলগুলোর মধ্যে কিছু মাত্রার সমন্বয় এক্ষেত্রে সবার জন্য উপকারী হতে পারে, অনন্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়ের অভাবে চীন থেকে আসা দুষ্প্রাপ্য চিকিৎসা সারঞ্জামের সরবরাহ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশগুলো একে অপরের সঙ্গে রীতিমতো নিলাম যুদ্ধে লিপ্ত। সাধারণ সময়ে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারগুলি দক্ষতার সঙ্গে এ জাতীয় পণ্য বরাদ্দ দেয়। তবে স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থায়, বাজারগুলো অপটুভাবে কার্যসম্পাদন করতে পারে, ক্রেতার অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য বরাদ্দ দিতে পারে; এতে করে ধনী রাজ্যগুলো হয়তো তাদের সমর্থ্য অনুযায়ী সবগুলো ভেন্টিলেটর ও টেস্টিং কিট কিনে নিলো, বিপরীতে দরিদ্র রাজ্যগুলো কিছুই পেল না। ফলে মহামারী প্রতিরোধে দেশটি সক্ষমতা হারাবে।

এ অবস্থায়, কেন্দ্রীয়ভাবে সংগ্রহ মূল্য কমিয়ে রাখতে পারে এবং সম্ভাব্য প্রয়োজনভিত্তিক বরাদ্দে সক্ষম করে। কিন্তু, ’হতে পারে’ এবং ’সম্ভাব্য’ হচ্ছে অপারেটিভ ওয়ার্ড। যদি কোনও কেন্দ্রীয় সরকারের সন্দেহজনক উদ্দেশ্য থাকে কিংবা সে অক্ষম হয় তাহলে হিসাব বদলে যায়। যেমনটা আমরা ব্রাজিল, মেক্সিকো, তানজানিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখেছি। সরকার প্রধান যখন মহামারীর মাত্রাকে খাটো করো দেখে, তখন তারা তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

ব্রাজিলের ফেডারেল গভার্নমেন্টের বিভিন্ন ব্যর্থতার মধ্যে ভেন্টিলেটর ক্রয় পরবর্তী তা বিতরণের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটস নিয়ন্ত্রণাধীন রাজ্যগুলোর তুলনায় রিপাবলিকান শাসিত রাজ্যগুলোতে কেন্দ্রীয় মেডিকেল চিকিৎসা সারঞ্জাম প্রাপ্তি সহজতর হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে ভারতে শহরে বসবাতরত লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিককে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই লকডাউন চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। ছোট ছোট শিশু নিয়ে পরিবারগুলো শত শত মাইল হেঁটেছে, পথে তাদের সহায় হয়ে এসেছে অপরিচিত কোনো ব্যক্তি আর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দয়া এবং সম্ভাব্যতা তারা ভাইরাসটি বহনও করেছে। একটি বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া রাজ্যগুলোতে লকডাউন চালুর বিষয়টিকে বিলম্বিত করেছে (কেননা প্রাথমিকভাবে তাদের আক্রান্তের পরিমান কম ছিল), তবে যারা আগেভাগে লকডাউন চালু করেছে তাদের দেখে অন্য রাজ্যগুলো ভালো ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষা নিয়েছে।

অতত্রব, চূড়ান্ত পর্যায়ের কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ উভয়ই সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে একটি সমন্বিত মধ্যম পন্থা। রাজ্য ও পৌরসভাগুলির উপর প্রকৃত সিদ্ধান্ত ছেড়ে কেন্দ্রীয় সরকার এক্ষেত্রে যা করতে পারে তা হচ্ছে লকডাউন চালু করা ও উঠিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নুন্যতম একটি মান প্রতিষ্ঠা করা।

কথিত আছে, যদি পক্ষপাতদুষ্ট থাকতে হয় তাহলে একটি অনুদানের নীতি অনুসরণ করে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যাওয়া উচিত, ক্ষমতা যেখানে সর্বনিম্ন সম্ভাব্য কার্যকরী প্রশাসনিক স্তরে অর্পণ করা হয়। সযত্নে পরিচালিত বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষ গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক সত্তার সদস্যরা কেবল একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয় না; তারা সাধারণত বৃহত্তর সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংহতি প্রদর্শন করে, আর এটি তাদের পরস্পরের সঙ্গে জড়িত হওয়া এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করার বিষয়গুলোকে সহজ করে তোলে।

আঞ্চলিক রাজনীতি মাঝেমধ্যে উনিশ শতকের কেনটাকি ও পশ্চিম ভার্জিনিয়ার হ্যাটফিল্ড-ম্যাককয়ের জাতিগত বিবাদের অনুরূপ হলেও বর্তমানে কেন্দ্রীয় আইনসভা যে ধরনের বিড়ম্বনা ও বৈরিতা ভোগ করে ওটি তার তুলনায় কম। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত বা নিযুক্ত সংস্থাগুলোর গৃহীত সিদ্ধান্তে লোকেরা মালিকানা বিষয়ক একধরনের অনুভুতি বোধ করে। এ ধরনের ক্ষমতায়ন তাদের জাতীয় এবং বৈশ্বিক বাজারগুলোর দয়ায় থাকার চেয়ে বরং বাজারগুলো থেকে কীভাবে উপকৃত হওয়া যায় সে সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে।

আর এ কারণেই, আমরা যখন মহামারী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য নীতিমালা তৈরি করছি তখন কে কোথায় আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিবে তা নিয়ে আমাদেরও চিন্তা করা উচিত। উদাহরণসরূপ, অবকাঠামোগত ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থের একটি নায্য অংশ গোষ্ঠীভিত্তিক অনুদানে রূপ নেওয়া উচিৎ, যা কিনা প্রায়োজন অনুযায়ী তহবিল বরাদ্দের জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। যদিও প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা করে জাতীয় জলবায়ু নীতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না, তবেঐক্যমতের ভিত্তিতে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে।

বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদীদের উত্থান রাজনৈতিক ক্যারিশমাটিক নেতাদের আকুল তৃষ্ণার বিষয়টি প্রতিফলিত করে, সাধারণ মানুষ এদের শনাক্ত করতে সক্ষম। এ ধরনের জননেতা তাদের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনের ফায়দা নিয়ে সাংবিধানিক রীতি-নীতিকে এড়িয়ে যাচ্ছে, যা দেশগুলোকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কর্তৃত্ববাদের ঝুঁকি কমানোর সঙ্গে সরকারের পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিপুল জনসমর্থিত স্বাধীন শক্তিশালী সংস্থা প্রয়োজন। সাংবিধানিকভাবে আঞ্চলিক ও স্থানীয় সরকারগুলোকে আরোও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ সামনের দিকে অগ্রসরের পন্থা হতে পারে।

রঘুরাম রাজন, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর 
(প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর রুহিনা ফেরদৌস)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন