করোনামৃত অর্থনীতিবিদ পিটার সিনক্লেয়ার

ড. এমএ মোমেন

শেষ পর্যন্ত করোনামৃত বলে চিহ্নিত, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমার পরিচিত প্রয়াত খ্যাতিমানদের শীর্ষে অবশ্যই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান; পাশাপাশি আছেন রোমানিয়ার বামপন্থী ও দেশান্তরী লেখক পল গোমা, সিরিয়ার লেখক নাট্যকার সবেক মন্ত্রী রিয়াদ ইসমাত; দ্য লায়ন কিং, পোকাহান্টা কিংবা দ্য লিটল মারমেইডের এনিমেটর অ্যান সুলিভান, অভিনেত্রী, সাংবাদিক ও জীবনীকার প্যাট্রিসিয়ো বসওয়ার্থ  (দ্য নান স্টোরি সিনেমায় আদ্রে হেপবর্নের প্রিয় বান্ধবী)। অর্থনীতিবিদ পিটার সিনক্লেয়ার আমার কয়েকজন বন্ধুর শিক্ষক, ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪, মোট ২৪ বছর অক্সফোর্ডে পড়িয়েছেন। আমি একবারই ফাঁকে দেখার সুযোগ পাই, লন্ডনে, ১৯৯৩ সালে। পরের বছরই তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ২০১২-তে অবসরে যান, তারপর ৩১ মার্চ ২০২০ মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি সেখানকার ইমেরিটাস প্রফেসর ছিলেন।

তিনি পড়াতেন অর্থনৈতিক তত্ত্ব, আর্থিক নীতি ও কৌশল এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নিজ দেশের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকসহ পৃথিবীর বেশকিছু সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস স্টাডি গ্র“পের সভাপতিত্ব করেছেন। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ডিরেক্টর ছিলেন। প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ইতিহাস ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পাঠের ওপর অর্থনীতিবিদদের আহ্বান জানিয়েছেন। তার ছাত্রদের একজন ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এ কালের অনেক শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ তাদের বর্তমান পর্যায়ে আসার সক্ষমতা পিটার সিনক্লেয়ারই সৃষ্টি করে দিয়েছেন বলে তারা মনে করেন। তাঁর আগ্রহের অর্থনীতিবহির্ভুত বিষয় ছিল ভাষা, স্থাপত্য ও ইতিহাস।

তিনি পড়ানোর সময় পাওয়ার পয়েন্ট কিংবা আধুনিক কোনো শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতেন না। অসনাতন গল্পসল্পের মধ্যে শিক্ষার্থীদের এতটাই ডুবিয়ে রাখতেন যে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্লাস ছেড়ে তার ক্লাসে এসে অর্থনীতির গল্প শুনতে বসতেন। বাস্তবের চিত্র সাজিয়ে তিনি অর্থনৈতিক তত্ত্বে পৌঁছতেন, অর্থনীতিবিদের সীমাবদ্ধতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন।

২০০৭-০৮-এর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য অর্থনীতিবিদরা কতটা দায়ী? মাত্র সামান্য কয়েকজন কেন এই দুর্যোগ আঁচ করলেন, অন্যরা কেন তা পারলেন না? যে অর্থনীতি পড়ানো হয়, তা কি ভুল? যদি তাই হয়ে থাকে, অর্থনীতি পাঠে কি পরিবর্তন আনতে হবে, অর্থনীতিবিদরা কি ভুল প্রশ্ন করছেন? নাকি তারা প্রশ্নের ভুল উত্তর দিচ্ছেন? গবেষণার এজেন্ডা কি বদলাতে হবে? অর্থনীতির যে মডেলগুলো আমরা ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, সেগুলোর কোথায় কী পরিবর্তন আনতে হবে? অর্থনীতির শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট কেন? ভালো অর্থনীতিবিদ কেমন করে তৈরি করা যাবে? অর্থনীতি কোনো? এ প্রশ্নগুলোই পিটার সিনক্লেয়ারের নিত্যকার জিজ্ঞাসা।

তিনি মার্ক্সবাদী নন, কিন্তু লাগামহীন মুনাফা সৃষ্টি হোক, এটিও তার চাওয়া নয়। ডেভিড ক্যামেরন প্রজন্মকে তিনি শিখিয়েছেন, একই সঙ্গে সম্পদ ও সামাজিক সহানুভ‚তি সৃষ্টি করতে হবে। সেই ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে সম্পদ অ্যাকুমুলেশনের হাতিয়ার হয়ে উঠবে। 

তার  মৃত্যুর পর অক্সফোর্ড ও বার্মিংহাম দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ই বলেছে, পিটার সিনক্লেয়ার ছিলেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের অন্যতম। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডেভিড ইস্টউড বলেন, পিটার কখনো বিশ্বাস করতেন না অর্থনীতি একটি ‘বিমর্ষ বিজ্ঞান’, তিনি বিষয়টিকে আনন্দময় করে তুলেছেন এবং মনে করতেন বিষয়টির যথাযথ পাঠ পৃথিবীকে অধিকতর বাসযোগ্য একটি স্থানে পরিণত করতে পারে।

ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, পিটারই তার দেশে সবচেয়ে মানবিক এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান অর্থনীতিবিদ। তিনি ক্যামেরনের ভাষায় একজন ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি মেন্টর’, রয়্যাল ইকোনমিক সোসাইটির কাছে তিনি ইন্সপিরেশনাল ইকোনমিস্ট, প্রেরণাদায়ক অর্থনীতিবিদ। তার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার বহু বছর পরও তিনিই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

পুরো নাম পিটার জেমস নিভেন সিঙ্গলেয়ার। জন্ম ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬। বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা লন্ডন, নরফক ও অক্সফোর্ডে। গ্রেশাম’স স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্নাতক ও পিএইচডি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনের শুরু জার্মান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রতি আগ্রহের শুরুটা সেখানেই। 

২০০৭-০৮-এর আর্থিক বিপর্যয়ের বিশ্বরূপ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন সংকট সৃষ্টির দায় অনেকেরই। ক্রেডিট এজেন্সি, ৯/১১-এর পর গ্রিনস্প্যানের অতি কম সুদহার, ব্যাংকার, রিস্ক ম্যানেজার, রাজনীতিবিদ, অস্বচ্ছ ও সন্দেহজনক শেয়ারবাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতা, রেগুলেটর সবাই এই অপরাধী । অর্থনীতিবিদরা এর জুনিয়র পার্টনার। অর্থনীতিবিদরা এমন সব মডেলের ওপর নির্ভর করেছেন, যেখানে বড় ভ্রান্তি ঘটে না, আর্থিক ধস নামে না। তারা অতি আশাবাদী হয়ে ভবিষ্যৎ বাজারের ধারা এবং অবস্থা নির্ধারণ করেছেন এবং অন্যদেরও অবাস্তব আশাবাদী করে তুলেছেন। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক গবেষণা ভুল ফল দেবে। এক্ষেত্রে সমকালীন অর্থনৈতিক তত্তে¡র খোলনলচে পাল্টাতে না পারলেও পুনর্বিন্যাস করা জরুরি হয়ে পড়ে। 

মনস্তত্ব প্রকৌশল, আইন, গণিত, ভূগোল ও ইতিহাসের সঙ্গে অর্থনীতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত, কেবল ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের বেষ্টনীতে অর্থনীতিকে বিবেচনা করলে চলবে না। আমলাতন্ত্রের বাড়তি স্তর সিদ্ধান্তের গতি শ্লথ করে দেয়, মুক্ত বাণিজ্যের সুফল শুল্ক দপ্তরের ছাকনিতে বিবৃত হয়ে যায়। কাজে শিক্ষকের হাতে পড়ে অর্থনীতির শিক্ষার্থীও বিভ্রান্ত ও হীনমন্য হয়ে পড়ে। অর্থনীতিকে স্বল্পশিক্ষিত শিক্ষকের হাত থেকে উদ্ধার করাও একটি বড় কাজ। 

পিটার সিঙ্গলেয়ারের স্বনামধন্য ছাত্ররা মনে করেন, তাদের এই শিক্ষক যখন তাদের দুর্বলতম রচনাটিকেও বিবেচনা করতেন, সবচেয়ে কম প্রশংসা করতে হলেও বলতেন, দ্যাটস ভেরি ভেরি ইন্টারেস্টিং। তার অধীনে পিএইচডির ছাত্র যারা ছিলেন, প্রায় প্রত্যেকেরই পুনর্জন্ম হয়েছে তাদের এই অধ্যাপকের হাতে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের কেবল অর্থনীতি শেখাননি, তাদের মূল্যবোধ ও বিশ্ববীক্ষণের অবকাঠামোও তৈরি করে দিয়েছেন।

পিটার সিনক্লেয়ার সপ্তাহের ৭০ ঘণ্টা বরাদ্দ রেখেছিলেন তার ছাত্রছাত্রীদের জন্য। তিনি চিমনির মতো ধূমপানের ধোঁয়া ছাড়তেন। ব্যক্তিগত কাজ ও ব্যায়ামের জন্য সময় রাখেননি। শিক্ষার্থীরা তাকে আড়ালে ডাকতেন ‘পাফ দ্য ম্যাজিক ড্রাগন’। তিনি তাদের শিখিয়েছেন ‘আরবিট্রেজার, হেজার ও স্পেকুলেটর’ ভারসাম্যে পৌঁছতে হলে বাজারে তিনজনেরই দরকার।

নিজের পাণ্ডিত্য প্রতিষ্ঠার চেয়ে তার আগ্রহ ছিল তার শিক্ষার্থীদের পণ্ডিত বানিয়ে তোলা।

যে নভেল করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে সংকুচিত করে ফেলেছে, এর রিকভারি প্ল্যান ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে তার জীবিত ও কর্মক্ষম থাকা জরুরি ছিল। তিনিই হলেন এ পর্যন্ত করোনায় মৃত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ। 

ড. এমএ মোমেন, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন