কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মানবপ্রেম

অনজন কুমার রায়

বাংলা কবিতায় আধুনিকতা স্থান পেয়েছে যেসব কবির লেখনীতে তার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে জাগরণ সৃষ্টি করেন। ধূমকেতু পত্রিকায় আনন্দময়ীর আগমনে কবিতাটি প্রকাশিত হলে তাকে কারাবরণ করতে হয়। ব্রিটিশ বিরোধী এই কবিতাটিতে ক্ষুব্ধ মনের বহির্প্রকাশ শব্দে প্রোত্থিত করেছেন বিপ্লবের রণভেরীতে। তাই জনমানসে অধিষ্ঠিত হলেন বিদ্রোহীরূপে জাজ্বল্যমান শব্দের অন্তরালে।

কবিপ্রেমের বিভিন্ন অঙ্গনে মননশীলতায় বিদ্রোহ মনোভাবের পাশাপাশি নিয়ে এসেছেন প্রকৃতি প্রেম ও মানব প্রেমের সৌন্দর্যের অবয়ব। অসাম্প্রদায়িকতা কিংবা ভালবাসায় মানবীয় রূপ উন্মোচনে বৈচিত্র্যময়তা তার কাব্যে ধরা পড়ে। তার লেখনীতে যৌবনের শক্তির স্ফূরণ ঘটিয়ে তারুণ্য জয়গানের মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যৌবনে তারুণ্য শক্তি সঞ্চালনের মাধ্যমে নিজেকে অন্য এক জগতের মাঝে অধিষ্ঠিত করেছেন। তবে বিদ্রোহ মনোভাবের পাশাপাশি মানবপ্রেম রচনা সমগ্র ভান্ডারকে করেছে আরো সমৃদ্ধ।

ক্ষুদ্র গন্ডী থেকে বেরিয়ে এসে সমগ্র পৃথিবীকে দেখার অদম্য প্রয়াসে লিখেছেন ‘সংকল্প’ কবিতাটি। ত্রিনয়নে হয়তো বিশ্বকে দেখেতে চেয়েছেন তাই ‘সংকল্প’ কবিতাটি লিখে মুক্ত জীবনের আভাস এনে দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘থাকব নাক বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে’।
বীরত্বসূচক শব্দ ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে অন্যদের থেকে পৃথকভাবে সমৃদ্ধিধারা সৃষ্টি করেছেন। তার লেখার মানসপটেই আমরা এসব শব্দের সঠিক র্স্ফূরণ দেখতে পাই। এক্ষেত্রে সাহিত্যকে এক গতিময়তা দান করেন।

আবার 'ছাত্রদল' কবিতাটি যেন শক্তি-সামর্থের আধার। সেখানে তারুণ্য কিংবা যৌবনে চঞ্চলতার জয়গানে দীপ্তিমান। সেজন্যই কবিতাটিতে অবতারনা করেছেন:
‘আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল।’
নারী মনের অব্যক্ত কথাগুলো ব্যক্তভাবে তুলে ধরেছেন। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন নারীকে। ‘বীরাঙ্গনা’ কবিতায় নারীকে নিষ্পাপ আখ্যায়িত করে লিখেছেন-
অহল্যা যদি মুক্তি লাভে, মা, মেরী হতে পারে দেবী,
তোমরাও কেন হবে না পূজ্য বিমল সত্য সেবি?
কিংবা, নারী-পুরুষ ভেদাভেদে স্থান না দিয়ে লিখেছেন-
গাহি সাম্যের গান-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদেভেদ নাই।
কবির মননে যা কিছু ধ্বনিত হয় তাতে
দেশপ্রেমের পরিচয়ও ফুটে উঠে সহজে। সেজন্যেই লিখে যান
‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী।’

মানবপ্রেমের কান্ডারী কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের স্বরূপ চিত্রিত করে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ না রেখে সমাজকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর জ্ঞান গর্ভ লেখনীর মাধ্যমে যেমন বিদ্রোহ লক্ষ্য করা যায় তেমনি তেজোদীপ্ততে সদা অটল ছিলেন। সেজন্যই হয়তো লিখেছিলেন আনন্দদময়ীর আগমনে। সমসাময়িক ধারণা থেকে বেরিয়ে এক নতুন যুগের সুচনা করে বিদ্রোহ মনোভাব প্রকম্পিত করে তুলে- ‘আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।’ বিদ্রোহ মনোভাব প্রকম্পের জন্যই ইংরেজ কবি শেলীর সাথে তুলনা করা চলে।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভাবনার এক নিগূঢ় তত্ত্বে বিরাজ করে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। দারিদ্র্যে কায়-ক্লেশে জর্জরিত থেকেও প্রকৃতি প্রেমের প্রতি উদারতায় আকৃষ্ট করেছেন পাঠক সকলকে। নিচু স্তরের মানুষও তার কবিতার মাঝে ঠাই মিলে যেখানে অন্য কোন কবির রচনা সমগ্রে তা সহজে পাওয়া যায় না। জাতপাতের বিরুদ্ধে সমাজকে পরিবর্তনে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। নিচুস্তরের সমাজে কায়-ক্লেশে জীবন ধারণ করা মানুষের ছবি সুন্দররূপে চিত্রিত করেছেন।

তাছাড়াও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণায় মুখর করে তুলেছিলেন। ‘প্রভাতী’ কিংবা ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’ কবিতা বাংলা সাহিত্যে তার অনবদ্য সৃষ্টি। তাতে তিনি বিচিত্র্যতা ফুটিয়ে তুলেছেন। শিশুতোষ ক্ষেত্রে খুঁকী ও কাঠবিড়ালী ছেলেবেলার মানসপটে এখনো ধরা পড়ে-
‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?’

সৃষ্টির আঙ্গিকে নিজেকে অন্যের কাছ থেকে পৃথক রেখে সৃষ্টির বিলাসিতায় কবিতা কিংবা অন্য লেখনীর মাধ্যমে নিজেকে মেলে ধরেছেন।
সকালবেলায় দ্যুতি ছড়িয়ে পড়তে অনিন্দ্য প্রয়াসে ব্যক্ত করেছেন ‘খোকার সাধ’ কবিতাটিতে। তাই অবতারনা করেছেন, ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি’। আবার ভোরের অলসতাকে ভেঙ্গে শিশুরা জেগে উঠার প্রয়াস ব্যক্ত করে লিখেছেন ‘প্রভাতী’ কবিতা, ‘ভোর হল দোর খোল, খুকুমনি উঠরে’। নান্দনিকতার মিশেলে ছেঁয়ে আসে কবিতা দুটিতে।

নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহ থাকলেও প্রেম ও প্রকৃতির মাঝেও খুঁজে ফেরে মেলবন্ধন। তাই, তোমারে পড়িছে মনে কবিতায় লিখেছেন,
আজি হেথা রচি নব নীপ মালা-
স্মরণ পারের প্রিয়া, একান্তে নিরালা
অকারণে! জানি আমরা জানি
তোমারে পাব না আমি এই গান, এই মালা খানি।

বস্তুত তার সাহিত্যের ছদ্মাবরণে মিশে আছে মানবপ্রেম যেখানে লিখনশৈলীতে ধরা দেয় কাব্যপ্রেমী ও প্রেমানুরাগী মন কিংবা নিষ্পেষিত নারীদের। মানবতাবাদী কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তার স্থান অনস্বীকার্য। অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি পেয়ে মানবতার জয়গান গেয়েই লিখেছেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

যুগে যুগে তার গান ও কবিতা প্রেরণাদায়ক হয়ে আছে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসেবে। আবার কোন কোন কবিতায় প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতিকে কাছে টেনে নিয়েছেন। তাই, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতায় প্রকৃতি ও প্রেমের স্পর্শ অনুভব করা যায় হৃদয়েতে-
জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী
নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি !

কিংবা মাঝে মাঝে আমাদের মানসপটে ভেসে আসে-
চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচ্ছে,
গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলি মাঝে।

সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই কলম ধরেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে। তাই যুগবাণীতে লিখেছেন, ‘বাস্তবিক আজ আমরা অধিন হইয়াছি বলিয়া চিরকালই যে অধীন হইয়া থাকিব, এরূপ কোন কথা নাই। কাহাকেও কেহ কখনো চিরদিন অধীন করিয়ে রাখিতে পারে নাই ইহা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ’।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে সমাজকে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র হিসেবে।
তাই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতে বলতেই পারি-
খুঁজি না রাস্তার নামে, জানি নেই মর্মর মূর্তিতে,
তুমি থাকবে, তুমি আছো আমাদের নিত্য দুঃখ জয়ের সংগ্রামে।

পরিশেষে বলি, অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ কিংবা বাঙালী জাতিসত্তায় কাজী নজরুল ইসলাম নামটি চির ভাস্বর হয়ে থাকবে আমাদের মাঝে।

অনজন কুমার রায়: ব্যাংকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন