বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে অভ্যাস ও আচরণগত পরিবর্তন প্রয়োজন

শফিকুল আলম

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, আমি কখনো হেরে যাই না; হয় জিতে যাই অথবা শিক্ষা নিই। কভিড-১৯ সমগ্র বিশ্বকে শুধু স্থবিরই করে দেয়নি কিংবা আমাদের অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়নি, আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে এমন অনেক কিছু যা থেকে শিক্ষা নিতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবী আরো সুন্দর হতে পারে।

মাত্র ছয় মাস আগে অর্থাৎ গেল বছর নভেম্বরেও যেটা অসম্ভব ছিল তা এখন খুব সহজেই সম্ভব। অনেক অভ্যাসই আমাদের জীবনের সঙ্গে আষ্টে-পিষ্টে ছিল যা আমরা কখনই পরিবর্তনের চিন্তা করিনি কিংবা এর প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করিনি। কভিড-১৯ এর কারণে আমরা বুঝতে পেরেছি অনেক কিছুই করা হয়, যা অত্যাবশ্যকীয় নয়। গত কয়েক মাসে আমাদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি কিংবা বিপনীবিতানগুলোতে যাওয়া হয়নি। পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা সহজেই মানিয়ে নিয়েছি। এমতাবস্থায় আমাদের অভ্যাস এবং আচরণে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন এসেছে।
 
যে টেকসই উন্নয়নের কথা আমরা প্রতিনিয়ত বলি, তা অর্জনেও আমাদের আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটি হল জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করা। সে উদ্দ্যেশ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (প্রাক শিল্পায়ন যুগের তাপমাত্রার তুলনায়) এর মধ্যে রাখার জন্য বিভিন্ন দেশ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ নীতি প্রণয়নে আমরা প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দিই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বিভিন্ন দেশের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত নীতিগুলো অনেকাংশেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং জ্বালানি দক্ষতা সম্পর্কিত প্রযুক্তি নির্ভর। যদিও এধরনের প্রযুক্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা এবং আবেদন রয়েছে, আমাদের মাথায় রাখতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা নির্মুল এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ প্রযুক্তিগত সমাধানের চেয়েও বেশি কিছু।
  
বাস্তব জীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার সুযোগ রয়েছে। তার মধ্যে খাদ্যাভ্যাস এবং জ্বালানি ব্যবহার সংক্রান্ত পরিবর্তনের ব্যাপারে এখানে আলোকপাত করা যেতে পারে। যেমন, বিভিন্ন দেশের জলবায়ু নীতিমালায় খাদ্যসংক্রান্ত বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয় না। উল্লেখ্য যে, উদ্ভিজ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য প্রাণীজ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্যের চেয়ে অনেক বেশী স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশবান্ধব। খাদ্য তালিকায় প্রাণীজ আমিষ থেকে উদ্ভিজ আমিষ যুক্ত খাবারের পরিমাণ বাড়ানোর মাধ্যমে উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো সম্ভব কোনো প্রকার অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই।

এদিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সাশ্রয়ীভাবে এবং দক্ষ্যতার সাথে সম্পদ ব্যবহার সম্পর্কিত জ্ঞান এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও, সম্পদ অপচয়ের প্রবনতা আমাদের মধ্যে দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, দুঃখজনক ভাবে পৃথিবীতে প্রতিবছর যে পরিমান খাদ্য উৎপাদন হয়, প্রকৃতপক্ষে তার প্রায় ৩০ শতাংশ অপচয় হয়। এই অপচয় বহুমাত্রিক সমস্যার সুত্রপাত ঘটায়। প্রক্রিয়াজাত হয়ে আমাদের আহারের উপযোগী হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন, পরিবহন এবং রান্নার মাধ্যমে প্রচুর পরিমানে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। দ্বিতীয়ত, এই খাবার যখন আমরা নষ্ট করি তা পচে গিয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন উৎপন্ন করে। আইপিসিসি এর পঞ্চম মুল্যায়ন রিপোর্টে, মিথেন কে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় ২৮ গুণ বেশী কার্যক্ষম বলা হয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীতে যখন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যাভাবে ভোগে, তখন এই বিপুল পরিমান খাদ্য অপচয় নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

অন্যদিকে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি পৃথিবীজুড়েই গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু বহুলাংশেই, আমাদের আচরণ ও অভ্যাসগত সীমাবদ্ধতার কারণে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ পর্যাপ্ত পরিমান জ্বালানি সাশ্রয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। একে রিবাউন্ড ইফেক্ট বা  জেভন্স প্যারাডক্স বলে - যার দুটো দিক রয়েছে। একটি হল, নতুন কেনা জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্র যেহেতু জ্বালানি খরচ কমিয়ে দেয়, অনেকেই একে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী ব্যবহার করে। এতে যে পরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় হওয়ার কথা, বাস্তবে তার চেয়ে কম সাশ্রয় হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি কিনে তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী চালানো।

দ্বিতীয়ত, জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিদ্যুৎ খরচ কমে যাওয়ায়, কারো কারো মধ্যে নিত্য নতুন যন্ত্র বা গেজেট কেনার প্রবণতা দেখা দেয়। এই নতুন যন্ত্র ব্যবহারেও জ্বালানির প্রয়োজন হয়। ফলে প্রথমে যে জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্র কেনা হয়েছিল তার সাশ্রয় পরের যন্ত্র কেনাতে অনেকাংশেই আর থাকে না। দুই ধরনের ঘটনাকে সমন্বয় করলে, জ্বালানি সাশ্রয় এবং গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনে যে বিনিয়োগ করা হয় তা বাস্তবে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে না। কেননা জ্বালানি দক্ষতা অর্জন বা সাশ্রয় বহুলাংশে আমাদের আচরণ এবং অভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
 
কিছু উন্নয়নশীল দেশের দিকে তাকালে পরিলক্ষিত হয়, সচেতনতার অভাব কিংবা অভ্যাসগত কারনে ঘরবাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুলা জ্বালিয়ে রেখে জ্বালানির অপচয় করা হয়। বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারে একটু মনযোগী বা সচেতন হলে আমারা শুধু জ্বালানি অপচয় রোধেই নয় বরং গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি।

এ আলোচনায় প্রতিয়মান হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রনয়নে মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত বিষয়কে আমলে নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের তুলনায় মানুষের আচরণগত পরিবর্তন আনার জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন তা একেবারেই কম। কিন্তু অভ্যাস ও আচরণগত পরিবর্তনের প্রতিদান এবং কো-বেনিফিটস অনেক বেশী।
 
কভিড-১৯ এর কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। ভেবে দেখা যেতে পারে, কী ধরনের সামাজিক প্রণোদনা মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে?
 
পরিশেষে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।

শফিকুল আলম: হুম্বল্ডট স্কলার ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদ
সিনিয়র এডভাইজর হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন