করোনায় লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন ও সংগ্রাম

প্রকাশ দত্ত

গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি, জীবনমান, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সারা বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কমবেশি আলোচনা হয়ে থাকে। মিডিয়ার কল্যাণে জনগণের একটি বড় অংশ জানতে পারে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন ও পেশাগত সমস্যার সেই কথা। আর করোনা ভাইরাসের মহামারীর মধ্যে মালিক ও সরকারের পদক্ষেপে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাছেও পৌঁছে গেল গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুর্বিসহ জীবনের কথা। কিন্তু দেশের মধ্যে লোকাল গার্মেন্টসে কর্মরত কয়েক লাখ শ্রমিক যারা পোশাক তৈরি করে থাকে তাদের নিয়ে আলোচনা নেই কোথাও। করোনা পরিস্থিতিতে কী অবস্থায় কাটছে তাদের জীবন; কোথাও নেই এ খবর। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর জন্য শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, জ্যাকেট, মহিলাদের পোশাক, বাবাস্যুট (বাচ্চাদের কম্পিলিট সেট) তৈরি করে সমাজ জীবনে ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ৯০ পরবর্তী শহরের শ্রী বৃদ্ধির সাথে বাহারি শপিংমল থেকে শহরের ফুটপাথে তৈরি পোশাকের যে সমারোহ তার একটি বড় অংশই তৈরি করে লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকরা। বাসাবাড়িতে ক্ষুদ্র পরিসরে ৭৫ পরবর্তীতে এ শিল্পের যাত্রা। বর্তমানে তা একটি বড় অংশের জীবন ও জীবিকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। লোকাল গার্মেন্টসের কারখানাগুলোর একটি বড় অংশ ঢাকার সিদ্দিক বাজার, নর্থ সাউথ রোড, কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, মানিকনগর, শনির আখড়া, সাইনবোর্ড, কালীগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সাভারে অবস্থিত। তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশ এই সব কারখানায় তৈরি হয়ে থাকে। এর বাইরে সৈয়দপুর, বগুড়াসহ বিভাগীয় শহর ও কোনো কোনো জেলায় কিছু কিছু কারখানা আছে।

লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশের বয়স ১৬-২৫ বছরের মধ্যে। এই বয়সটা শোষণের জন্য যেমন উপযোগী, একই সাথে পুঁজির স্বার্থে বাজার দখলের প্রয়োজনে যুদ্ধের খোরাকের জন্যেও উপযোগী। যাদের বয়স একটু বেশি তারা অধিকাংশ কাটিং মাস্টার। আর সবচেয়ে কম বয়সী হেলপার। কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন পদের মধ্যে আছে কাটিং মাস্টার, বডি ম্যান, কলার ম্যান, হোল্ডম্যান (বোতামের ঘর করে), ফিট অব দ্য ম্যান (বোগলের নিচে সেলাই করে), আয়রন ম্যান, হেলপার- এই সব পদে তারা চাকরি করে থাকে। হোল্ডম্যান, ফিট অব দা ম্যান এবং সুতা কাটা হেলপার ছাড়া সবাই পিচ রেটের শ্রমিক। ১২ মাস কাজ করলেও স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে এদের কোন স্বীকৃতি নেই। পিচ রেট নির্ধারণ করে মালিক তথা মহাজনরা। এই নির্ধারণের সাথে বাজারদরের কোন সম্পর্ক নেই। পিচ রেটের বৃদ্ধি নির্ভর করে মহাজনদের মর্জির ওপর। পিচ রেটের টোপ ঝুলিয়ে দেয়ায় শ্রমিক রাত-দিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে অতিরিক্ত রোজগারের আশায়। এই অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে পারার বড় কারণ তাদের বয়স। শ্রমিক তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে তাদের অসচেতনতা। পিচ রেট বা ফুরন কাজের এই পদ্ধতি মালিক ও পুঁজির জন্য লাভজনক। স্বল্প পুঁজি থেকে বৃহৎ পুঁজির মালিক হওয়ার বাসনায় লোকাল গার্মেন্টসের মালিকরা শ্রমিকদের জীবনীশক্তিকে বেপরোয়াভাবে নিংড়ে নিচ্ছে। এই শিল্পের শ্রমিকরা কর্ম সময় হিসেবে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত, এরপর ২ ঘন্টা বিরতি দিয়ে বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত; আর কাজের মৌসুমে (নববর্ষ, ঈদ, পূজা পার্বনে) রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হয়। এই শ্রমিকরা কারখানায়ই থাকে ও ঘুমায়। ঘুমায় বললে ভুল হবে, হাড় ভাঙা খাটুনির পর ক্লান্ত শরীর নিস্তেজ ঘুমিয়ে পড়ে। যে কারণে প্রতিটি কারখানায় প্রচণ্ড ছারপোকা থাকার পরও শ্রমিকের ঘুমে কোন ব্যাঘাত হয় না। ঘুম ভাঙার পর যখন শরীরের দিকে তাকায় তখন দেখতে পায় ছারপোকার কামড়। যেখানেই কাজ, সেখানেই খাওয়া আর সেখানেই ঘুম। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে জন্ডিস, শ্বাসকষ্ট, টিবি, চর্ম রোগ আক্রান্ত হয় শ্রমিকরা। আর ৫/৬ বছর কাজ করার পর অধিকাংশ শ্রমিকেরই দেখা দেয় চোখের সমস্যা। চাকরির টাকা দিয়ে পরিবার নিয়ে বাসা ভাড়া করে ঢাকায় থাকা সম্ভব হয় না বলে কিছু সংখ্যক শ্রমিক মেসে এক সাথে চার-পাঁচজন আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। অতিরিক্ত পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ক্ষুধা মেটানোর জন্য শুধু পেট ভরে দু’মুঠো ভাত খাওয়া। জীবনের অনিশ্চয়তাসহ সব মিলিয়ে ১০ বছর চাকরি করার পর ভেঙ্গে পড়া শরীর দেখলে মনে হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স।

এই শিল্পে দুই ধরনের মালিক আছে। এক হচ্ছে যাদের কারখানা ও প্রতিষ্ঠান আছে; তাদের বলে ডাইরেক্ট মহাজন (উৎপাদন ও বিপণনকারী)। আর যাদের শুধু কারখানা আছে; তাদের বলে মজুরি মহাজন। এই মহাজনরা নিজেদের লাভের ব্যাপারে যতটা মনোযোগী ঠিক তার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং নির্দয় শ্রমিকের আইন সঙ্গত পাওনা দেওয়ার প্রতি। এই শিল্পের শ্রমিকরা আইন বলতে বোঝে মালিকের মুখের কথা। আর মালিকদের মুখের ওপর কথা বললে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, মারধর এবং কখনও কখনও কোন পাওনা-দেনা না দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়। শ্রমিকদের স্বার্থে সংগঠনের দুর্বলতা, দেশের বিভন্ন অঞ্চল থেকে আসার কারণে এরা কেউই নিজ নিজ এলাকার ভোটার না হওয়ায় ভোট ব্যাপারীরাও তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে চায় না। সব মিলিয়ে নির্মম নিগৃহের স্বীকার এই শ্রমিকরা। অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরি, বৎসরে দুইটি ঈদ উৎসব বোনাস, স্ববেতনে সাপ্তাহিক ছুটি, নৈমিত্তিক ছুটি, চিকিৎসা ছুটি, বার্ষিক ছুটি, উৎসব ছুটি ইত্যাদি শ্রমআইনের প্রাপ্য অধিকার এই শিল্পের শ্রমিকদের কাছে স্বপ্নের মত। যে বিষয়টি অবাক করার মতো তাহলো এই শিল্পের মালিকরা বছরে দুই কিস্তিতে দুই ঈদের সময় মজুরি পরিশোধ করে। ভাতের বিল, নাস্তার টাকাসহ অন্যান্য দৈনন্দিন খরচের জন্য মজুরির একটি অংশ শ্রমিকরা প্রতি সপ্তাহে মালিকদের নিকট হতে নিয়ে থাকে, যা মাসে সাকুল্যে ৫/৬ হাজার টাকারও কম। নির্মমতার চরম স্বীকার এই শ্রমিকরা কর্মরত অবস্থায় পানি খেলেও তার জন অধিকাংশ কারখানায় মালিক পানির বিল হিসেবে পৃথকভাবে মজুরি হতে টাকা কেটে রাখে। এর বাইরে শ্রমিকরা বাড়ি যাওয়ার সময় বাড়তি ১/২ হাজার টাকা মালিকদের নিকট হতে নিতে থাকে। দুই ঈদ, সবে বরাত, পহেলা বৈশাখসহ বছরে ৫/৬ বার বাড়ি যায়। পিছ রেট হিসেবে শ্রমিকরা প্রতি মাসে ১২-১৫ হাজার টাকা রোজগার করতে পারে। এই টাকা থেকে প্রতি মাসে খাওয়ার বিলসহ অন্যান্য খরচ ৫ হাজার টাকা বাদ দিলে থাকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। বছরে ৫/৬ বার বাড়ি গেলে আরও ৬-৯ হাজার টাকা খরচ হয়। ৮-১০ হাজার টাকা থেকে এই টাকা বাদ দিলে প্রতি মাসে গড় মজুরি হয় ৭,২৫০ টাকা। কারখানা ১২ মাস খোলা থাকলেও কাজ হয় মূলত ৯ মাস। প্রতি বছর শ্রমিকরা অধির আগ্রহে থাকে রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় বকেয়া সকল পাওনা পাবে। এক সাথে পাওয়া এই টাকার সাথে জড়িয়ে থাকে শ্রমিকদের নানা স্বপ্ন। কিন্তু এবারের করোনা পরিস্থিতি এমন এক সময়ে আসলো যা লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনে তা যেন ঘোর অন্ধকারের মত। এমনিতেই জীবন চলতে চায় না। রোজার সময় অতিরিক্ত পরিশ্রম করে যে বাড়তি রোজগার করে তা দিয়ে সারা বছর কোন রকম চলে। কাজ থাকলে অমানষিক পরিশ্রম আর না থাকলে বেঁচে থাকার চরম অনিশ্চয়তা। করোনা ভাইরাস তাদের কাজও কেড়ে নিয়েছে, ভাতও কেড়ে নিয়েছে। যদিও শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকদের জীবন সব সময় থাকে অনিশ্চয়তায়। রপ্তানিমূখী গার্মেন্টস শিল্পের জন্য সরকার ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা এবং কর্মহীন শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ৭৬০ কোটি টাকার আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিলেও লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য সরকারের কোন সহযোগিতাই নেই। তারপরও শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মাঝে মাঝে জীবন যেন হেসে উঠতে চায়। করোনা ভাইরাসের মহামারীর কারণে লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন ও তাদের পরিবার এবার কিভাবে চলবে তা সহজেই বোঝা যায়। শ্রমিকদের এই জীবনকে বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ বা পরিসংখ্যানবিদ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। তারপরও প্রচলিত সমাজে পরিসংখ্যানের মারপ্যাচে জীবনের কত প্রয়োজনকে যে আড়াল করা হচ্ছে তার খবর কে রাখে? এই সত্য কতটাই বা আমরা জানতে পারি। লোকাল গার্মেন্টসের মালিকরা শ্রমিকদের যেমন খোঁজ রাখছে না। একই সাথে শ্রমিকরা বকেয়া মজুরির জন্য মালিকদের মোবাইল করলেও রিসিভ করে না। এই দুরবস্থায় মালিকরা তাদের বকেয়া ৬ মাসের পাওনা মজুরি দিলে তারা কোন রকমে বেঁচে থাকতে পারতো। কে নেবে এই দায়িত্ব? সরকার সকল সময় থাকে মালিকের সাথে।

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে লগ্নিপুঁজি ও দালালপুঁজির স্বার্থে উৎপাদনের চাকা সচল রাখার নামে শ্রমিক তথা শ্রমজীবী মানুষকে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়ে তাদের জীবন প্রদীপ নেভানোর ব্যবস্থা করা হলো। লোকাল গার্মেন্টস নয় সমাজের সামগ্রিক বাস্তবতা সামনে আনছে নতুন কর্তব্য। লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তা জীবনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে নিরাপদ সমাজ তথা শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। করোনা ভাইরাস চোঁখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও ব্যবস্থার অসারতা। আজ তাই বেঁচে থাকার জন্য শ্রমিক কৃষক তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন করণীয় একই সুতায় গাথা। লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিকদের বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দায়িত্ব হচ্ছে হাত পেতে মর্যাদাহীন হয়ে বেঁচে থাকাকে অস্বীকার করে মানুষের মত অধিকার নিয়ে বাঁচার লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হওয়া।

লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন