আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান

ড. মুহাম্মদ আলমগীর

আনিসুজ্জামান স্যার আর নেই। ১৪ মে বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। বয়স হয়েছিল মাত্র ৮৩ বছর।  চির নতুন, তরুণ ও সজীব মানুষটির জন্য এ এমন কোনো বেশি বয়স নয়। বাংলাদেশের অসীম আকাশ থেকে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি সারাজীবনের জন্য হারিয়ে গেলো। সমগ্র বিশ্বে করোনা মহামারীর এই ক্রান্তিকালীন আমাদের সকল আশা-ভরসার বাতিঘরটি নিভে গেল। তার মতো এমন নির্মোহ, নিরহংকার ও বিদ্বান মানুষের আবির্ভাব এই বাংলায় আর হয়তো কখনও ঘটবে না। তিনি আনিস থেকে প্রফেসর আনিসুজ্জামান হয়েছেন, ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়, শ্রদ্ধাভাজন ও ভরসার আশ্রয়স্থল “আনিস স্যার”।

আনিস স্যার আমাদের সকলের শিক্ষক ছিলেন। যদিও আমরা অনেকেই তার ক্লাসরুমের ছাত্র ছিলাম না, এমনকি তার দু’টো বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশুনা করিনি। তবু কেমন করে জানি স্বমহিমায় তিনি আমাদের সকলকে তার ছাত্র করে নিয়েছিলেন। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন বা ছাত্রজীবনে তার সান্নিধ্যে আসতে পেরেছেন তারা সৌভাগ্যবান। 

আমি পাশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার করার সময়ই তার নাম শুনেছি। কিংবদন্তীতূল্য ছিলেন তিনি। তবে ক্লাসে না হোক অন্যান্য সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে স্যারের সরব উপস্থিতি ও ভূমিকা দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছি এবং তার কর্মস্পৃহা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। 

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটি ছিল এক উত্তাল সময়ে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কেটেছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন। সে সময়ে ও পরবর্তীতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের উত্থান রোধ থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্যারকে দেখেছি প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে। 

তিনি সবসময়ে ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন, মানুষের কল্যাণের পক্ষে ছিলেন। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ষাটের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং সর্বশেষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিল তার সরব উপস্থিতি। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। তাই এদেশের  মাটি ও মানুষের  প্রতি তার ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা। 

তিনি কখনও আপোষ করেননি। সময়মতো সঠিক ভূমিকা রাখতে কখনো দ্বিধা করেননি। তাইতো তার চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধ ও ভালোবাসার জায়গাটি প্রকাশে তাকে কখনও দ্বিধায় পড়তে হয়নি। সকল পরিবেশে তিনি নির্দ্বিধায় সত্য ও সুন্দরের সঙ্গে ছিলেন। তার দৃঢ়তা ছিল হিমালয়ের মতো অবিচল। যা সবাইকে সাহস যুগিয়েছে। তাইতো তিনি দুঃসময়ে এ জাতির বিবেকে পরিণত হয়ে সবার আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। 

একটা সময়ে এসে তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘বিপুলা পৃথিবী’ পড়ার সুযোগ পেয়ে অনেক অজানা তথ্য পেয়ে আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছি। কোনো বাড়তি কাহন নয়, অত্যন্ত পরিমিত বোধ রক্ষা করে তিনি নির্লিপ্তভাবে বলে গিয়েছেন অনেক না জানা কথা ও বিষয়। তার দক্ষ লেখনীর এই বইটি পড়ে একটি বিষয় উপলব্ধি হয়েছে সাহিত্যের ছাত্র না হওয়ার কারণে, স্যারের লেখা মৌলিক বইগুলো না পড়তে পেরে, অনেক কিছু থেকেই আমি বঞ্চিত হয়েছি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা, কাজের ধরন, পরিধি ও সীমাবদ্ধতার একটি অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে এই বইতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় অর্জনের পর কলকাতা থেকে স্যারের দেশে ফিরে আসা, বাংলায় সংবিধান লেখার কাজে সংম্পৃক্ত থাকা, শিক্ষা কমিশনের কাজে সম্পৃক্ত থাকা, উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন চলে যাওয়া, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চলে যাওয়ার আগে কথাবার্তা, সবকিছুই অনেক সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে তার অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে । বাংলাদেশের সংবিধানটি বাংলায় লিখতে গিয়ে কি নিদারুণ শ্রমই না তিনি দিয়েছিলেন। জাতি তার অবদান সবসময় স্মরণ করবে।

আনিস স্যার ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয়। তিনি ছিলেন সবার আপনজন। তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বত্র। সকল ভালো কাজে তাকে সহজে পাওয়া যেত। সময় ও শারীরিক সমস্যা না থাকলে তিনি কাউকে ফেরাতেন না। সত্যভাষণে তার কোনো দ্বিধা ছিল না। তিনি ছিলেন জাতির বিবেক ও বাতিঘর। বিভিন্ন সময়ে, সংকটকালে মানুষ তার কাছে গিয়ে আলোর সন্ধান পেতেন। তার মতামত ও বিবৃতি দিশাহীন দেশ, জাতি, সমাজ বা ব্যক্তিকে সঠিক পথটি দেখতো। তিনি ছিলেন ধ্রুবতারা। সবাইকে তিনি আলোর পথে চালিত করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতকি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশর।  এটাই ছিল তার একমাত্র ব্রত। 

এমন আধুনিক মানুষ পাওয়া সত্যিই এই জাতির জন্য ছিল একটি বিরল ঘটনা। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি লালনে তার ভূমিকা তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আধুনিকতার আড়ালে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কারণে আমরা লালন করতে পেরেছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে। বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির তিনি ছিলেন একজন ভ্যানগার্ড।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য এবং এর আগে টানা আট বছর দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সুবাদে স্যারের কর্মকাণ্ড ও ব্যক্তিত্ব অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে মানুষ ছিলেন এবং যেকোনো পরিবেশে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। যেমন ছিলেন মৃদুভাষী তেমনি ছিল তার পরিমিতি বোধ। তার জীবনে বাহুল্যের কোনও স্থান ছিল না। কথা বলার চাইতে, শুনতে বেশি পছন্দ করতেন। সবাইকে সম্মান করতেন। যেকোনো আসরে তার কথাবার্তা, পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্বে একটি চমৎকার আবহ তৈরি হতো। তিনি হয়ে উঠতেন সবার আস্থার প্রতীক। আমরা সবসময় চাইতাম তিনি আরও কিছু কথা বলুক, মন দিয়ে শুনি, অজানা বিষয়ে জানতে পেরে আলোকিত হই। 

আনিসুজ্জামান স্যার জাতীয় অধ্যাপক হয়েছিলেন এক বছরও হয়নি। এই জাতি সবচেয়ে বড় আলোর মশালটি তার হাতে তুলে দিয়েছিল, আমরা তাকে হারালেও তার কর্ম সেই মশালটিকে সবসময়ে প্রজ্জ্বলিত করে রাখবে এবং অবিরতভাবে আলোকিত করে যাবে আমাদেরকে। এতো মৃত্যু নয়, প্রস্থান মাত্র।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন