করোনাকালে বাংলার কৃষক ও কৃষির সম্ভাবনা

নাজমে সাবিনা ও মো. আমিনুর রহমান

করোনাকালে কৃষকের অকৃষি-ক্ষতি
কৃষকদের নিয়ে ডেভরেসোন্যান্সের এ গবেষণায় দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশের বেশি (৬৭%) কৃষক পরিবার মূলত অকৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত। কৃষি পরিবারের আয়ের ৪৩% আসে বিভিন্ন ধরনের অকৃষি খাত থেকে। এ অকৃষি-আয়ের ওপর করোনার প্রভাব পড়েছে তীব্রভাবে।

এ কৃষি পরিবারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবার (২৭%) নানারকম ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যায় বেসরকারি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে যুক্ত আছেন ১৯%, আর তৃতীয় সর্বোচ্চ সেক্টর হিসেবে পরিবহনকেন্দ্রিক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত আছে ১৬% পরিবার। এছাড়া অকৃষি শ্রমিক, শিক্ষকতা, প্রবাসী আয় ও অন্যান্য পেশার আয় দিয়ে পরিবারের খরচ নির্বাহ হয়।

গবেষণাভুক্ত কৃষক পরিবারের ১৩% পরিবারের কেউ না কেউ দেশের রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে অকৃষি কাজ করে পারিবারিক আয়ে ভূমিকা রাখছে। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৮%) নানা রকম ক্ষুদ্র ব্যবসা যেমন- চায়ের দোকান, মুদি দোকান, হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এক-তৃতীয়াংশের কম (৩১%) বিভিন্ন বেসরকারি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, সিএনজি অটোরিকশা বা এ ধরনের পরিবহন চালক আছেন ১৫%। এছাড়া বাকিরা গার্মেন্টস কর্মী বা নির্মাণকাজে সাব-ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে জড়িত।

পরিবারের অকৃষির সঙ্গে যুক্ত সদস্যরা বেশির ভাগই কর্মস্থলে যেতে পারছে না। সিএনজি অটোরিকশা, ভ্যান-রিকশাচালকরা রাস্তায় বের হতে পারছেন না। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক রকম বেচা-কেনা নেই। গ্রামে টিউশনি বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি পরিবারের প্রবাসী সদস্যরাও দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। এ অবস্থায় কেউ কেউ সঞ্চয় ভেঙেছেন, কেউবা নির্ভর করছেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধার-দেনার ওপর।

এ গবেষণায় কৃষকের সম্ভাব্য অকৃষি-ক্ষতির ক্ষেত্রগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত কৃষক পরিবারের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী গড় অকৃষি ক্ষতির পরিমাণ, পরিবার প্রতি ৭ হাজার ৩০০ টাকা। এটাকে যদি শুধু অকৃষির সঙ্গে যুক্ত কৃষি-পরিবারগুলোর মধ্যে বিবেচনা করি তাহলে দাঁড়ায় পরিবার প্রতি গড় অকৃষি-ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার ৪০০ টাকা।

যদি দেশের অর্থনীতির গতি পূর্ণরূপে সচল হতে আরো তিন-চার মাস সময় লাগে, তাহলে পরিবারপ্রতি অকৃষির সম্ভাব্য ক্ষতি হবে ২০ হাজার ৪০০ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ১৯%। এটাকে যদি শুধু অকৃষির সঙ্গে যুক্ত কৃষি-পরিবারগুলোর মধ্যে বিবেচনা করি, তাহলে পরিবারপ্রতি গড় অকৃষি-ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া ফসলের বীজ, সার, শ্রমিকের জোগানের মতো বিষয়গুলোতে নগদ টাকার যে চাহিদা, তা পূরণ হয় কৃষক পরিবারের সদস্যদের অকৃষি আয় থেকে। তাই কৃষকদের অকৃষি উৎস থেকে আয় না হওয়ার প্রভাব মধ্য-মেয়াদে কৃষকের ফসলের মাঠে পড়তে বাধ্য। করোনার কারণে কৃষি ও অকৃষি মিলে এরই মধ্যে কৃষক পরিবারের মোট বার্ষিক আয়ের ১৪% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারপ্রতি গড় ক্ষতির পরিমাণ ২৬ হাজার ৭০০ টাকা। আর করোনাকাল শেষে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে যদি আরো চার-পাঁচ মাস লাগে, তাহলে এ ক্ষতির সম্ভাব্য হার দাঁড়াবে বার্ষিক পারিবারিক আয়ের ৪৭%। পরিবারপ্রতি সম্ভাব্য গড় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৯ হাজার ১০০ টাকা।

করোনাকালে কৃষকের খোরাকি
কৃষকের ভাষায় খোরাকি হচ্ছে, ভাত ও ভাতের সঙ্গে খাওয়ার জন্য ন্যূনতম মাছ-তরকারি। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রতিদিন মাথাপিছু ৪০০ গ্রাম পরিমাণ ভাত খেয়ে থাকে। এ গবেষণার আওতাভুক্ত কৃষকরা প্রায় সবাই নিজেদের খোরাকির ধান বা চাল নিজেরাই আংশিক বা পূর্ণভাবে উৎপাদন করেন। এ বছরের (২০২০ সালের) এপ্রিলের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময়ে কৃষকের খোরাকির মজুদ, বিশেষ করে খোরাকির ধান বা চালের মজুদ কতটুকু আছে, এ গবেষণায় তা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখা গেছে, এক-চতুর্থাংশের বেশি (২৬%) কৃষক পরিবারে ৩০ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত তাদের খোরাকির কোনো মজুদ নেই, প্রায় সমপরিমাণ (২৭%) পরিবারে মে মাসের (মাত্র এক মাসের) খোরাকি মজুদ আছে, ১৮% পরিবারে জুন পর্যন্ত (দুই মাসের), ১ দশমাংশ (১০%) পরিবারে জুলাই পর্যন্ত (তিন মাসের), প্রায় সমপরিমাণ (১১%) পরিবারে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (চার-পাঁচ মাসের) এবং বাকি এক-দশমাংশ কৃষক পরিবারে ছয় মাসের বেশি সময়ের জন্য খোরাকির ধান বা চালের মজুদ আছে।

এ কৃষক পরিবারগুলোকে বেশির ভাগই ধান ছাড়া নিত্যদিনের অন্যান্য খাবার বিশেষ করে মাংস, মাছ, ডিম, দুধ ইত্যাদি কিনতে হয়। এ খাবারগুলো খোরাকি উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি এবং অকৃষি খাতের আয় থেকে আসে। এটা অনুমান করা যায়, খোরাকির সংকটের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে কৃষক পরিবারে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি অবস্থারও অবনতি ঘটবে।

কৃষকের চাওয়া
কৃষকের চাওয়া বিশাল কিছু নয়। সে দান বা অনুগ্রহ চায় না, চায় ন্যায্যতা। রাষ্ট্রের কাছে তার চাওয়াটা খুবই সাধারণ, এমন একটা বাজার ব্যবস্থা যেখানে সে তার ফসলের লাভজনক মূল্য পাবে, পাবে ভালো মানের বীজ, কম মূল্যে সার ও কীটনাশকের জোগান। কৃষকদের অনেকেই বলেছেন, ত্রাণ বা সহায়তা হিসেবে খাবার নয়, বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে ভালো বীজ চাই। কৃষির সিজনগুলোতে যখন কৃষি উপকরণ ও শ্রমের জোগান দরকার, তখন নগদ টাকার সহায়তা প্রয়োজন হয়, এ সময়গুলোতে বিনা সুদে ঋণ দরকার। আর দরকার উৎপাদিত পণ্যের সমতাভিত্তিক বাজার, যেখানে লোকসান গুনতে হবে না। পরিবহন ও সংরক্ষণের এমন পরিবেশ থাকতে হবে, যাতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য নষ্ট না হয়।

গত ৩০ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত কোনো কৃষক পরিবারে করোনা রোগী শনাক্তে এখনো কোনো পরীক্ষা করা হয়নি। এটা সুখবর যে, করোনার লক্ষণ আছে এমন কেউ নেই। কোনো কারণে এ সময়ে পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে বা করোনায় আক্রান্ত হলে কৃষক পরিবারে আরো বিপন্নতা বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষকের চাওয়া, তার পরিবারের যে কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজ গ্রামে না হলেও তার কাছাকাছি কোথাও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগটুকু যেন থাকে।

করোনাকালে কৃষকের জন্য রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও তার বাস্তবায়ন
সরকার করোনাকালে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও অন্যান্য আর্থিক খাতে প্রণোদনা হিসেবে অবমুক্ত করেছেন। নগদ প্রাপ্তির সম্ভাবনায় সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ আশ্বস্ত হয়েছেন, মনে হচ্ছে। অকৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত দুই-তৃতীয়াংশ কৃষক যদি এ সহায়তায় অভিগম্যতা পায়, তাহলে তারা হয়তো কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারে। যদিও গবেষণাভুক্ত কৃষকরা তাদের অকৃষি-আয়ের ক্ষেত্রের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখনো কোনো সরকারি সহায়তা পাননি বা পাবেন এমনটাও নিশ্চিত করতে পারেননি।

কৃষকের চাওয়া পূরণ -কম সুদে কৃষিঋণ। সরকার প্রণোদনা হিসেবে ৪% সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণের ঘোষণা দিয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ। এ রকম উদ্যোগ সাম্প্রতিককালে আরো নেয়া হয়েছে, যেমন ২০১৯-২০ রোপা আমন মৌসুমে বন্যার জন্য কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের ১০টি জেলার ৩২ হাজার ১২১ জন কৃষককে কমিউনিটিভিত্তিক রোপা আমন চারা রোপণ ও বিতরণে ২ কোটি ১২ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা সহায়তা দিয়েছে।

যদিও এসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বা আর্থিক প্রণোদনার মতো উদ্যোগগুলোর সুফল প্রকৃত প্রাপ্যজনের কাছে কতটুকু পৌঁছতে পারে, সে ব্যাপারে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। যেমন-এ গবেষণাভুক্ত কৃষকরা কেউই সরকারি এসব সহায়তার আওতায় আসেননি। কৃষিতে সরকারের বরাদ্দ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। যেখানে সরকার শিল্প মালিকদের ২% সুদে ৭২ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছেন, সেখানে কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ সেক্টরের বড়-মাঝারি-প্রান্তিক সব কৃষকের জন্য, প্রায় তিন গুণ কম বরাদ্দ খুবই অস্বাভাবিক ও বৈষম্যমূলক-এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।

করোনাকালে বিশেষ ব্যবস্থায় মৌসুমি শ্রমিক যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে, হাওড়ের বোরো ধান কাটার ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। এটার সঙ্গে সঙ্গে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আধা-সামরিক বা সামরিক বাহিনীর ব্যারাকে থাকা সদস্যদের করোনাযুদ্ধে রাস্তায় টহলে না রেখে, গ্রামে ধান কাটা এবং ধান লাগানোর মৌসুমে কৃষককে সহায়তা করতে উদ্যোগী করা যেতে পারে।

সরকার আকস্মিক বন্যাপ্রবণ হাওড় ও নিচু জমির এলাকাগুলোতে শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় এবং কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের অংশ হিসেবে ১০ কোটি টাকার ১২০০ ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্র কৃষকদের কাছে বিতরণ করেছেন। যার ক্রয়মূল্যের ৭০% কৃষকরা পরিশোধ করবেন। প্রথমত, প্রয়োজনের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই কম। দ্বিতীয়ত, যেখানে দেশের বেশির ভাগ কৃষক কম পুঁজি নিয়েই কৃষিকাজ করেন, সেখানে যন্ত্র কেনার ৭০% টাকা জোগাড় করার সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে এ ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতির সুফল দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের হাতের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে।

অপরদিকে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের নামে বিদেশ থেকে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করার প্রবণতাও কমাতে হবে। আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের দেশে ভূমিতে উপস্থিত ছোট জোত বা জমির কৃষকরাই কৃষিকে আগলে রেখেছেন। জমিতে কৃষকের উপস্থিতিই আমাদের কৃষির প্রাণশক্তি। এ ছোট জোতগুলো বড় ও ভারী কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী। এটা দেশীয় কৃষির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না বরং তা ক্রয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ঘটবে। যান্ত্রিকীকরণের জন্য তাই প্রয়োজন হাতে বহনযোগ্য বা ছোট আকারের যন্ত্রপাতি। আমাদের দেশেই সেটা বানানো সম্ভব। এক্ষেত্রে দেশীয় নতুন উদ্ভাবনীকে স্বাগত জানাতে সরকারি বিনিয়োগ বা বরাদ্দ দরকার।

কৃষকের জন্য সিজনের শুরুতেই উন্নতমানের বীজ ও সার সরবরাহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অংশ হলে কিছু প্রান্তিক কৃষক এ সময় হালে পানি পেতে পারেন। ভালো মানের বীজের জন্য প্রয়োজনে গ্রামে গ্রামে বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যেখানে কৃষকরা উন্নত মানের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবে এবং বীজ ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ভালো মানের বীজ সহায়তাও পাবে।

করোনা মোকাবেলায় রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতের প্রস্তুতিহীনতা ও সমন্বয়হীনতা পুরো জাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখনই স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে কৃষি ও কৃষকের ঘনত্ব বিবেচনায় কৃষিগ্রামচিহ্নিত ও অগ্রাধিকার তালিকা করা দরকার। সংশ্লিষ্ট কৃষিগ্রামগুলোতে দ্রুত করোনা পরীক্ষা করতে স্বাস্থ্য বিভাগকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। এরপর করোনা মোকাবেলায় গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, গ্রামভিত্তিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করা যেতে পারে। লকডাউন অবস্থার পর সমাজভিত্তিক স্বাস্থ্য ও কৃষি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হলে তা হবে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত।

ধানছাড়া অন্যান্য কৃষিপণ্য বিশেষ করে পচনশীল কৃষিপণ্য বিশেষ করে সবজির সংরক্ষণ ব্যবস্থার অতি দ্রুত উন্নত করতে হবে। খাদ্য বিশেষ করে ফল ও সবজি প্রক্রিয়াকরণেও বিশেষ নজর দিতে হবে। এজন্য নতুন প্রযুক্তি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

সবজি, ফলসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনপরবর্তী বাজারজাত ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দেশীয় বাজার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে হবে। এজন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে নীতি-কাঠামোগত সংস্কারও জরুরি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারীর কারণে আগামী এক বছরের মতো বিশ্বব্যাপী এক ধরনের অথনৈতিক অচলাবস্থা বিরাজ করবে। এ সময় বিদেশী ক্রয়াদেশ পাওয়ার ওপর নির্ভরশীল পোশাক এবং অন্যান্য রফতানিযোগ্য শিল্প বা পণ্যের কী অবস্থা হবে, তা এখনো আমরা জানি না। কিন্তু আমরা এটা জানি, আমাদের কৃষক ঠিকই উৎপাদনে যাবে। তার উৎপাদন বন্ধ থাকবে না।

এ মুহূর্তে বিদেশের বাজারে আমাদের কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে রফতানিযোগ্য কৃষিপণ্যের বৈশ্বিক সম্ভাবনার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রচিহ্নিত করতে দ্রুততম সময়ে ব্যাপকভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ দরকার। দেশব্যাপী বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উৎপাদনকারী পর্যাপ্তসংখ্যক কৃষককে এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনকে এমনভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ঘাটতি ও এর অতিচাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারি। তাহলে করোনাকালে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের যে ব্যাপক ব্যয়, তার অনেকটাই কৃষি যেমন পুষিয়ে দিতে সক্ষম হবে, তেমনি কৃষি অর্থনীতির এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচিত হবে।

পরিশেষ
কৃষক শুধু জমিতে ধান রোপণ করে না, সে বপন করে তার স্বপ্ন। সে শুধু ফসল তুলে গুছিয়ে রাখে না, সে আসলে থরে-থরে সাজায় তার সফলতাকে। কৃষাণী নতুন ধানের চাল যখন রান্না করে, তখন সে শুধু রাঁধুনি নয়, সে তখন পরম মমতায় উপভোগ করে সংসারের সুখ। পরিবার খুঁজে পায় নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা ও শক্তি। এগুলোর আর্থিক মূল্য বিশ্লেষণ করার সাধ্য আমাদের নেই। করোনাকালের যুদ্ধে কৃষকের খুব সচেতন স্বাস্থ্য চিন্তা নেই, নেই মৃত্যুভয়। এমনই চিন্তা, ব্রিটিশপূর্ব উপমহাদেশেও তা লক্ষণীয় ছিল। তখন রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে। পাশের ময়দানে চলছে রণসজ্জা আর কৃষক জমি চাষ করার জন্য সাজাচ্ছেন তার লাঙল। জয়ী ও পরাজিতপক্ষ কেউ কৃষকের লাঙল চালনায় হস্তক্ষেপ করেনি। নির্ভয় কৃষক তখনো ছিল, আজো সে তার উত্তরাধিকার বহন করছে। এদেশের কৃষি আর কৃষক, পৃথিবীর অন্যরাষ্ট্র ও সমাজ থেকে ভিন্নতর। করোনাযুদ্ধ তাই যতটা না বাংলার কৃষকের, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি রাষ্ট্রের। কৃষকের ফসল ফলানোর নিরন্তর যুদ্ধে, রাষ্ট্রকেই নিজ দায়িত্বে কৃষকের সঙ্গে শরিক হতে হবে। কৃষকের যুদ্ধকে নিরাপদ ও লাভজনক করার উপায় বের করতে হবে।

করোনা সারা বিশ্বের জন্য এক লম্বা দুঃসময় বয়ে নিয়ে এসেছে ঠিকই, তবে বাংলার প্রাচীনতম কৃষি সমাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর মাধ্যমে কৃষি-রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের উপস্থিতি জানান দেয়ার এক বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতীয় নেতৃত্ব যদি কৃষি বিষয়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন, তাহলে করোনাপরবর্তী পৃথিবীতে বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনেতিক অবস্থান তৈরি যে সময়ের ব্যাপার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। (সমাপ্ত)

প্রথম পর্ব পড়ুন:

করোনাকালে বাংলার কৃষক এবং কৃষির সম্ভাবনা


গবেষণা উপদেষ্টা: আফসান চৌধুরী -গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক

লেখক:

নাজমে সাবিনা -উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ও প্রধান নির্বাহী, ডেভরেসোন্যান্স এবং
মো. আমিনুর রহমান -সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, কৃষি-ভূমি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন বিশ্লেষক
Email: [email protected]; [email protected]



এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন