করোনাকালে বাংলার কৃষক এবং কৃষির সম্ভাবনা

নাজমে সাবিনা এবং মো. আমিনুর রহমান

এশিয়ার সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ অঞ্চল এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে কৃষির জন্য খুবই উপযোগী। কৃষিভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে একসময় এদেশ ছিল সম্পদ ও প্রাচুর্যে ভরপুর।  যুগের পর যুগ কৃষিই  আমাদের অর্থনীতির মূল উপজীব্য। নানা সময়ে কৃষকেরা নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হলেও, বাংলার কৃষক তার পেশার সফলতা অর্জনে খুব কমই পরাস্ত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বিগ্রহ, লুণ্ঠন, পোকামাকড়ের আক্রমণ ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষক তার শস্য-আবাদ ও তার ফলন নিশ্চিত করেছেন। 

একথা যখন বলছি, তখন পৃথিবীজুড়ে করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে সকল জাতি-গোষ্ঠি যুদ্ধ করছে। এ এক নতুন ধরনের যুদ্ধ। আমরা এ যুদ্ধের ভিন্ন একটি চেহারা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি, আর সেটা হলো: পৃথিবীজুড়ে মানুষের খাবারের সংস্থানের যুদ্ধ। ধনী হোক আর গরীব দেশ হোক দীর্ঘমেয়াদে খাবারের চাহিদা পূরণ কীভাবে হবে তা অনিশ্চিত। দীর্ঘ অবরুদ্ধ জীবনযাপন এবং ক্রম-অবনতিশীল স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পৃথিবীজুড়ে নতুন এক সংকটের সূচনা করবে। আর সেটি হচ্ছে প্রতিদিনের খাবার প্লেটে মৌলিক খাদ্য তালিকার খাবারের অভাব। এমন হতে পারে, অর্থ আছে, সম্পদ আছে কিন্তু খাবার নেই। 

এদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ‘ভাত’, আর যুগ যুগ ধরে বাঙালির প্রধান উৎপাদিত শস্য ‘ধান’। এখনো ধান চাষে গ্রাম বাংলার ৪৮ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের যে অংশগ্রহণ তার অর্ধেক এবং জাতীয় আয়ের ছয়-ভাগের এক-ভাগ আসে ধান থেকে। দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবার প্রতিবছর ১ কোটি ৫ লাখ  হেক্টর একর জমিতে ধান চাষ করছে।  ধান উৎপাদিত জমির এ পরিমাণ গত ৫০ বছরে সামান্য একটু কমলেও, সুখবর হচ্ছে দেশে সামগ্রিকভাবে ধান উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ০৯ লাখ টন, যা ২০০৯-১০ সালে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন, ২০১৪-১৫ সালে ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন এবং ২০১৮-১৯ সালে এসে হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন।

বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো, তিনটি সময়চক্রে এ তিন ধরনের ধানের চাষাবাদ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ সালে ২ দশমিক ৪ কোটি টন বোরো ধান, ১ দশমিক ৫৩ কোটি টন আমন ধান এবং ২৯ দশমিক ২ লাখ টন আউশ ধান উৎপাদিত হয়েছে। 

ধান ছাড়াও জমিতে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মধ্যে সবজি উৎপাদনেও কৃষকের সফলতা প্রশংসাযোগ্য। ২০০৯-১০ সালে ১ কোটি ২৫ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়েছিল, যা ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ টন। ধান এবং সবজি দুটোই দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে খাদ্য শস্য উৎপাদনের হিসাব করলে দেখা যায়, ২০০৬ সালে ২ কোটি ৬১ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল, যা ২০১৮-১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৩২ লাখ টন। ১২ বছরে প্রায় দ্বিগুণ। এ অর্জন কৃষকের, এ সফলতা কৃষির, এ বিজয় চিরায়ত কৃষি নির্ভর বাঙালি সমাজের।

ডেভরেসোন্যান্সলি- একটি জাতীয় উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা, গত এপ্রিল ২০২০ এ দেশের ৮টি বিভাগের ২৫টি জেলা থেকে একশ-একজন ধান চাষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক কৃষকদের সঙ্গে বিশদ সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। উদ্দেশ্য ছিল, কৃষি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে এবং ধানচাষীদের পারিবারিক অথনীতিতে কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব চিহ্নিত করা। এছাড়া, কৃষকদের সমস্যার ক্ষেত্রসমূহ এবং কৃষির সম্ভাবনাকে বিশ্লেষণ করাও গবেষণার আওতাভুক্ত ছিল।

গবেষণাটি মূলত গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিচালিত হয়েছে। পরিমাণগত পদ্ধতির খানা জরিপ করার ক্ষেত্রে দেশের সকল বিভাগ ছাড়াও, সকল কৃষি-পরিবেশগত অঞ্চল-যেমন, উপকূল, হাওড়, চর, পার্বত্য অঞ্চল ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে। নারী, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী, দলিতসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদ-ব্যক্তি, কোথাওবা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় উত্তরদাতা কৃষককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর চিহ্নিত কৃষকের সঙ্গে মোবাইল ফোনাালাপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।  

কৃষক পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থা

গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় এক চতুর্থাংশ কৃষক পরিবারের বার্ষিক আয় ১ লাখ টাকার নিচে, এক তৃতীয়াংশের আয় ১ থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে এবং এক চতুর্থাংশের কম কৃষক পরিবারের বার্ষিক আয় দেড় থেকে দুই লাখের মধ্যে। অর্থাৎ ৮০ ভাগ পরিবারের আয় বছরে ২ লাখ  টাকার নিচে। আওতাভুক্ত কৃষক পরিবারের পারিবারিক মাসিক গড় আয় ১৫ হাজার ৮ শত ২১ টাকা। 

কৃষিখাত হতে বছরে পরিবারের গড় নিট আয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৭ হাজার ৫ শত টাকা আর অকৃষিখাত হতে ৮২ হাজার ৯ শত টাকা।মোট পারিবারিক আয়ের ৫৬ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে (চিত্র-১) ।

জরিপকৃত কৃষক পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ৫ জন। পরিবারের মোট সদস্যদের মধ্যে উপার্জনকারী সদস্য সংখ্যা ৩০ শতাংশ ; পরিবার প্রতি গড়ে ২ জন। নারী উপার্জনকারীর সংখ্যা মোট উপাজনকারীর ১৪ শতাংশ । অকৃষি উৎসের ওপর পারিবারিক আয়ের নির্ভরশীলতা রয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ (৬৬ শতাংশ ) কৃষক পরিবারের (চিত্র-২)। উল্লেখ্য যে, ১৩ শতাংশ  পরিবারের কেউ না কেউ শহরে অ-কৃষি কাজ করে পারিবারিক আয়ে ভূমিকা রাখছে। 

কৃষিজমি ও কৃষি উৎপাদন: 

গবেষণার আওতাভুক্ত কৃষক পরিবারসমূহের মধ্যে ৫১ শতক থেকে ১ একর জমিতে এক চতুর্থাংশের বেশি (২৭ শতাংশ ) পরিবার, ১ থেকে ২ একর পর্যন্ত জমিতে এক তৃতীয়াংশ (৩২ শতাংশ ), ২ থেকে ৩ একর পর্যন্ত জমিতে ১৫ শতাংশ, ৩ থেকে ৫ একর পর্যন্ত ১৭ শতাংশ, ৫ একরের বেশি জমিতে ৮ শতাংশ  পরিবার এবং মাত্র ২ শতাংশ  কৃষক পরিবার ৫০ শতকেরও কম জমিতে কৃষি চাষাবাদ করেন। 

এ গবেষণায় দেখা গেছে যে, মোট কৃষি জমির দুই-তৃতীয়াংশ (৬৬ শতাংশ ) নিজস্ব জমি, আর বাকি এক অংশ (৩৪ শতাংশ ) জমি তারা বর্গা, লিজ বা হারি হিসেবে অন্য কারো কাছ থেকে ফসল ভাগাভাগি বা টাকার বিনিময়ে নিয়ে থাকেন। মোট কৃষকের অর্ধেকের বেশি (৫১ শতাংশ ) কৃষি উৎপাদনের জন্য অন্যের কাছ থেকে এ বর্গা/লিজ নেন। ৭ শতাংশ  পরিবারের নিজস্ব কোনো কৃষি জমি নেই, তারা পুরোটাই বর্গার ওপর নির্ভরশীল।

মোট কৃষি জমির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৫ শতাংশ ) জমিতে কৃষকরা ধান চাষ করেন। মোট কৃষকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৮ শতাংশ ) কৃষক ৫১ শতক থেকে ১ একর জমিতে ধান চাষ করে থাকেন। ১০ থেকে ৫০ শতক জমিতে ১১ শতাংশ, এক থেকে দেড় একর পর্যন্ত জমিতে ১৮ শতাংশ, দেড় থেকে ২ একর পর্যন্ত জমিতে ১৬ শতাংশ, ২ থেকে ৩ একর পর্যন্ত জমিতে ৭ শতাংশ, ৩ থেকে ৫ একর পর্যন্ত ১০ শতাংশ  এবং বাকি ৩ শতাংশ  কৃষক ৫ একরের বেশি জমিতে ধান চাষ করে থাকেন।

গত আউশ, আমন ও বোরো এ তিন মৌসুমে ধানের উৎপাদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, গত বছর (২০১৯-২০২০) কৃষকরা গড়ে প্রতি শতকে ১৭ কেজি ধান উৎপাদন করেছেন। যা হেক্টর প্রতি হিসাব করলে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ১২ টন।

এসব কৃষকের মাথাপিছু গড় ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭৯ টন। বাংলাদেশে তিন ধরনের ধানের মধ্যে বোরো ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। গবেষণাভুক্ত কৃষকদের মোট উৎপাদিত ধানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬১ শতাংশ ) বোরো, এক তৃতীয়াংশের বেশি (৩৬ শতাংশ ) আমন এবং মাত্র ৩ শতাংশ  আউশ ধান উৎপাদন করেছেন। 

ধান ছাড়া এ কৃষকরা তাদের কৃষি-জমিতে অন্যান্য ফসলও ফলিয়ে থাকেন। জমিতে কোনো না কোনো সবজির চাষ করেন ৭৮ শতাংশ  কৃষক। ২৬ শতাংশ  কৃষক জমিতে পাট চাষ করেন। ১২ শতাংশ  কৃষক জমিতে মাছের চাষ করেন, প্রায় সম-পরিমাণ কৃষক সরিষা, ডাল এবং রসুন উৎপাদন করেন। বাদাম এবং সয়াবিন উৎপাদন করেন ১০ শতাংশ ; ভুট্টা ৫ শতাংশ ; আম ৪ শতাংশ , পিয়াজ ৪ শতাংশ , তিল ৩ শতাংশ , পান উৎপাদন করেন ৩ শতাংশ  কৃষক এবং এছাড়াও কিছু কৃষক তাদের জমিতে অন্যান্য ফল ও ফুলেরও চাষ করে থাকেন। তবে ১২ শতাংশ  কৃষক ধান ছাড়া অন্য কোনো কৃষিজ কাজে তাদের জমি ব্যবহার করেন না। 

করোনাপূর্বকালে কৃষকের সমস্যা: 

যুগ যুগ ধরে কৃষকের সমস্যা কী ছিল: উৎপাদন উপকরণে মালিকানার অভাব। ভাল বীজের নিশ্চয়তা নেই, ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া আর সার, কীটনাশক, বীজের দাম বেশি। তার সঙ্গে ছিল শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির অভাব আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আজও সে সমস্যার কতটুকু সমাধান হয়েছে? এ গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষকের এ দৈনন্দিন সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। উপরন্তু, কোনো কোনো অঞ্চলে মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের অভাব দেখা দিচ্ছে। বেড়েছে ধানের বিভিন্ন রোগ। হাইব্রিড জাতের আবির্ভাবে কৃষক হারিয়েছে দেশি-জাতের বীজ। জমিদার বা গাতিদারদের স্থলে মিল-মালিক বা বাজারের বড় ব্যবসায়িরা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষক ও ক্রেতার মাঝখানে যে দেয়াল তুলে রেখেছিল তা অদ্যাবধি অবিচল। 

এ গবেষণায় দেখা গেছে যে, সচরাচর কৃষকরা তাদের কৃষিপণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত সমস্যার মোকাবিলা করে থাকেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- প্রাকৃতিক বৈরিতা। যদিও গতবছর দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ভালো আবহাওয়ার কারণে কৃষকরা অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো ফলন পেয়েছেন।  তথাপি কোনো কোনো অঞ্চলে ধান কাটার সময়ে হঠাৎ বৃষ্টি বা বন্যা হয়েছে, আর ২২ শতাংশ  কৃষক এটাকে তাদের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এদের মধ্যে ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের কৃষকদের কাছে এ সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি, যথাক্রমে ৮০ শতাংশ  ও ৫৪ শতাংশ । এছাড়া বন্যা, শিলাবৃষ্টি, অতি-কুয়াশার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোকে ১৯ শতাংশ  কৃষক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 

আবার ১২ শতাংশ  কৃষক যারা সবজি চাষী, তারা বলেছেন অতি-বৃষ্টির ফলে সবজি ক্ষেতে পানি জমে যাওয়ায় সবজি নষ্ট হয়েছে। এছাড়া ২ শতাংশ  কৃষক জানিয়েছেন, ধান শুকানোর সময় অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে তাদের ধান নষ্ট হয়েছে। 

কৃষি উপকরণের একটি গুরুত্বপূণ অনুসংগ হলো বীজ। উন্নতমানের বীজের সংকটকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ১৬ শতাংশ  কৃষক। এছাড়া, সার ও কীটনাশকের উচ্চমূল্য এবং মানসম্মত সার ও কীটনাশকের অভাব বোধ করেছেন ১২ শতাংশ  এবং সময়মতো সার ও কীটনাশক কেনার সামর্থ্য না থাকার সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন ৯ শতাংশ  কৃষক।

যথাসময়ে শ্রমিকের প্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা কৃষকের আর একটি বড় চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ধান কাটার সময়েশ্রমিক সংকটে ভুগে থাকেন; ১৩ শতাংশ  কৃষক এটিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ধানকাটার শ্রমিকের মজুরি মূল্য বেড়ে গিয়েছিল বলেছেন আরো ১১ শতাংশ  ।জমি চাষ ও ধান রোপণের সময় শ্রমিক সংকটের মোকাবেলা করেছেন ৭ শতাংশ  । এছাড়া কোনো কোনো এলাকায় সেচের পানির সংকট, জমি চাষের জন্য ট্রাক্টরের অপ্রতুলতা ইত্যাদি সমস্যাকেও তারা এ গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। 

ফসল কাটতে পারলেই কৃষকের কাজ শেষ হয় না, এরপর শুরু হয় সেই ফসল মাড়াই করা, রোদে শুকানো, সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং শেষে বাজারে তা বিক্রি করা। ১৫ শতাংশ কৃষক বলেছেন তারা গতবছর ফসলের ন্যায্যমূল্য পাননি, ১০ শতাংশ  কৃষক বলেছেন তাদের ফসল সংরক্ষণের জায়গার অভাব ছিল। 

উল্লেখিত সমস্যাগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও এসব সমস্যার গভীরতা ও ব্যাপকতা অনেক। আমাদের রয়েছে কাঠামোগত অনেক সীমাবদ্ধতা, যেমন, বর্গাচাষী যারা আছেন তাদের উৎপাদিত ফসলের বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটি, বীজের জন্য কৃষকের বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা, ফসল সংরক্ষণে প্রযুক্তির অভাব, পুঁজির সংকট ইত্যাদি। এরকম হাজারো কারণে আমাদের কৃষক দিশেহারা। আর এর সঙ্গে এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে করোনাকালীন অর্থনেতিক অচলাবস্থা। 

করোনাকালে কৃষকের কৃষি-ক্ষতি: 

এ গবেষণার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হয়েছে, করোনার লকডাউনের ফলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করণের ক্ষেত্রে তাদের কোন ধরণের ক্ষতি হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, ধানচাষী কৃষকদের একটি বড় অংশের এখন বোরো ধান কাটার মুহূর্ত এসময় ধানচাষীদের জন্য প্রয়োজন কৃষিশ্রমিকের সরবরাহ। এ মুহূর্তে কৃষক কোনো প্রাকৃতিক বৈরিতার মুখোমুখি নয়। চমৎকার আবহাওয়া, এমনকি তুলনামূলকভাবে গতবছরের তুলনায় দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। করোনার জন্য জাতীয় ছুটি ঘোষণা করায় শহরের শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ গ্রামে অবস্থান করছেন। কৃষকরা আশা করছেন, এর ফলে গ্রামের অভ্যন্তরে কৃষি শ্রমিক এবার সহজলভ্য হবে। অবশ্য কোনো কোনো জেলায় মৌসুমি শ্রমিকের সংকট তৈরি হয়েছে বলে ধানচাষীরা বলেছেন। ফলে ধানের ক্ষেতে এ মুহূর্তে করোনার প্রভাব খুব বেশি না থাকলেও কৃষির অন্য ক্ষেত্র যেমন, সবজি, ফল, ফুল, মাছ, গবাদিপশু-পাখি ইত্যাদি চাষাবাদ বা পালনে করেনাকালের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ৯০ শতাংশ  কৃষক বলেছেন করোনার কারণে তাদের কৃষি ক্ষতির মুখে পড়েছে। 

এ গবেষণায় কৃষকরা কয়েকটি তাৎক্ষণিক সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন। ৭৮ শতাংশ  কৃষক তাদের উৎপাদিত সবজি, মাছ, দুধ, ডিম, এমনকি পোল্ট্রি বাজারজাত করতে সমস্যায় পড়েছেন। পরিবহন ও হাট-বাজার সীমিত হওয়ায়, খুব কমই বাজারে নিতে পারছেন। ৩৮ শতাংশ  কৃষক বলেছেন বাজরে যতটুকু কৃষিপণ্য যাচ্ছে, তার সঠিক দামও পাচ্ছেন না এমনকি বিক্রিও হচ্ছে না। বেগুন, শসা, শিম ও আলুর মতো সবজি বিক্রিতে কৃষককে সবচেয়ে বেশি লোকসান গুণতে হয়েছে। বেগুন ও শসা ৫ টাকা কেজি দরে, টমেটো ৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক কৃষক। এমনকি বিক্রি না করতে পেরে, সজবিকে পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন অনেকে। অনেকে আবার ক্ষেতেই ফেলে এসেছেন।  

এ গবেষণায় করোনার কারণে সৃষ্ট আথিক অচলাবস্থায় কৃষকের বর্তমান আর্থিক ক্ষতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এখন পর্যন্ত পরিবার প্রতি কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮ শত ৫৩ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ১০ দশমিক ৫ শতাংশ । এছাড়া, সম্ভাব্য ক্ষতির ক্ষেত্রসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, বাজার এবং পণ্য-সরবরাহ বা যোগাযোগ ব্যবস্থা পূর্ণরূপে সচল হতে যদি আরো ৩-৪ মাস সময় লাগে, তাহলে শুধু কৃষিখাতে পরিবার প্রতি সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে গড়ে ৭৩ হাজার ১০০ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ৩৯ শতাংশ । 

হাটবাজার বন্ধ থাকায় এ মুহূর্তে কৃষি ব্যবস্থাপনা চেইন পূর্ণরূপে কাজ করছে না। এ অবস্থায় একদিকে যেমন উৎপাদিত পণ্যের বাজরজাতকরণে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, অপরদিকে উৎপাদন উপকরণ যেমন-বীজ, গো-খাদ্য, সার, কীটনাশক ইত্যাদির প্রাপ্যতাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকরা আশংকা করছেন, পণ্য পরিবহণ ও হাট-বাজার সীমিত হওয়ায়, কৃষি উপকরণসমূহের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের ক্রয় সামর্থ্য ও সুযোগও কমে যাবে। করোনাকালের প্রভাব কৃষকের সঙ্গে সঙ্গে অন্য পেশাজীবীদের জীবিকার ক্ষেত্রগুলোতে যে সংকট তৈরি করবে, তার ফলে স্থানীয় বাজারে কৃষি পণ্যের চাহিদা কমবে, ফলে দামও কমে যেতে পারে। (পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)

গবেষণা উপদেষ্টা: আফসান চৌধুরী- গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক

লেখক: 

নাজমে সাবিনা-উন্নয়ন অর্থনীতিবীদ এবং প্রধান নির্বাহী, ডেভরেসোন্যান্স

মো. আমিনুর রহমান, সামাজিক অর্ন্তভুক্তি, কৃষি-ভূমি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন বিশ্লেষক 

ইমেইল: [email protected]; [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন