রাজনীতিবিদদের ঈদ বিবর্ণ করোনায়

তানিম আহমেদ

অন্য সবার মতো রাজনীতিবিদরাও এবার বিবর্ণ ঈদ উদযাপন করবেন। প্রতিবার কর্মী-সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষী-জনগণের সঙ্গে রাজনীতিবিদরা বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ঈদ উদযাপন করলেও এবারই প্রথম এর ব্যতিক্রম ঘটতে যাচ্ছে; যার মূল কারণ হলো কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে আসন্ন ঈদুল ফিতর উদযাপন হতে যাচ্ছে কোনো ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা ছাড়াই। এবারের মতো উচ্ছ্বাসহীন ঈদ আর কখনই আসেনি। এর আগে অতীতে যেকোনো দুর্যোগের মধ্যে আনন্দ উৎসব হিসেবেই উদযাপন হয়েছে ঈদ। এমনকি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বা পরবর্তীতে নানা রাজনৈতিক দুর্বিপাকের কালেও এতটা বিবর্ণ ছিল না ঈদ উদযাপন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে গিয়ে সাধারণ কোলাকুলিটুকুও সম্ভব হচ্ছে না এবার। ফলে আনন্দ বা উৎসবের ছিটেফোঁটাও থাকছে না এবারের ঈদে। রকম আমেজহীন ঈদ ইতিহাসে বিরল

প্রবীণ রাজনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও মোটামুটি একটা ঈদ উদযাপন হয়েছিল। প্রবাসী সরকারের উদ্যোগে কলকাতার থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী সচিবালয় প্রাঙ্গণে ঈদ নামাজের আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর থেকে রাজনীতিবিদদের প্রতিটি ঈদই পালন হয়েছে কর্মী-সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষী-জনগণকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এবার ধর্মীয় উৎসব এসেছে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে।

তারা বলছেন, রাজনীতিবিদদের ঈদ হলো দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক সাধারণ জনগণের সঙ্গে ভাগাভাগি করার। বিভিন্ন কারণে রাজধানীতে থাকলেও ঈদের আগে তারা সবাই ছুটে যেতেন নিজ নিজ গ্রামে। কিন্তু এবার কেউ কেউ নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করলেও সামাজিক দূরত্বের কারণে আগের সে আমেজে উদযাপন করতে পারবেন না।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, এমন পরিস্থিতিতে ঈদ উদযাপন আমরা কখনই দেখিনি। এবারের ঈদটা মানুষের দুর্বিষহ জীবনের মধ্য দিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে উদযাপিত হতে যাচ্ছে। ঈদের জামাতে দাঁড়ানোটাও হবে একটা ভীতিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে। কখনো চিন্তা করা বা ভাবাও যায়নি এমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু এটা আজ বাস্তবে দেখলাম।

দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আমরা শুধু নয়, সারা দুনিয়ার মুসলমানরা ধরনের ঈদ শত বছরে বা হাজার বছরেও পালন করেছে কিনা জানা নেই। এবারের ঈদ তো উৎসব নয়, শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা। ঈদটা সবার জন্যই নিরানন্দের, যেখানে লাখ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত বা নিয়ে আতঙ্কিত।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক ঈদের দিন সকালে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে দলীয় নেতা-কর্মী, বিচারক, বিদেশী কূটনীতিকসহ সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর তেমন কোনো শিডিউলের কথা জানা যায়নি। বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতে সব সময় সাধারণ জনগণ, নেতাকর্মী, সামাজিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কূটনীতিকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। কিন্তু এবারের করোনা পরিস্থিতিতে আপাতত প্রধানমন্ত্রীর কোনো শিডিউল এখন পর্যন্ত নেই। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকুই হবে।

চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সাধারণ ছুটি ঘোষণার শুরু থেকেই দলীয় সভাপতির নির্দেশে নিজ বাসভবনেই অবস্থান করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রতিবার ঈদের আগে নির্বাচনী এলাকায় গেলেও এবার সেটা সম্ভব হচ্ছে না। নিজ সরকারি বাসভবনেই কাটবে তার ঈদ। সেখান থেকেই নেতাকর্মীদের নিয়মিত খোঁজ রাখছেন তিনি। নির্বাচনী এলাকার মানুষের জন্য ঈদের উপহারও পাঠিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে না পারলেও তারা মানুষের সঙ্গে আছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে তারা নির্বাচনী এলাকার জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, নানাভাবে সহযোগিতাও করছেন। অনেকেই এরই মধ্যে কয়েকবার এলাকায়ও গিয়েছিলেন। সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে নানা সহযোগিতাও করেছেন। আবার যারা যেতে পারছেন না, তারা বিভিন্ন মাধ্যমে ঈদের উপহারও পাঠাচ্ছেন।

বিষয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা জনপ্রতিনিধিরা কখনই জনগণ থেকে আলাদা না। জনগণের সঙ্গেই আছি। আমাদের হয়তো শারীরিক দূরত্ব আছে, কিন্তু মানসিক কোনো দূরত্ব নেই। আমরা সবসময় জনগণের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে কাজগুলো করে যাচ্ছি। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের শারীরিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে আমরা আরো কাছাকাছি চলে গিয়েছি।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বণিক বার্তাকে বলেন, রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের বাইরে নন। যেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ করতে পারছেন না, সেখানে রাজনীতিবিদদেরও স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ করার সুযোগ নেই। আমরা বরাবরই মানুষের পাশে থাকি। এখনো মানুষের সঙ্গে আছি বিভিন্নভাবে। হয়তো ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে শারীরিকভাবে মানুষের সঙ্গে থাকতে পারছি না। কিন্তু সহযোগিতা সেবা নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা মানুষের সঙ্গে আছি। এবারের ঈদে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, কোলাকুলি করা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটি একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট। কষ্ট হলেও আমাদের সবাইকে তা বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হবে।

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বণিক বার্তাকে বলেন, এবারের ঈদে উৎসবমুখর পরিবেশ নেই। এটা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছুই হবে না। সারা বিশ্বে কভিড-১৯-এর কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের মানুষও একই ভাবে একটা বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। এখানে সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে, যাতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন না হয়। সে কারণে আমাদের দেশের চিরাচরিত সংস্কৃতি অনুযায়ী আমরা যেকোনো উৎসব পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে করে থাকি। সে কারণে বেশির ভাগ মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু এবার সেটা সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না শারীরিক দূরত্ব মানার জন্য।

এবার ঈদ ম্লান হয়ে গেছে উল্লেখ করে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ধর্মীয় অনুশীলন যতটুকুই না করলেই নয়, ততটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। তাই এবার আসলেই ঈদের কোনো অনুভূতিই নেই। ঈদের যে আনন্দ, যে পরিবেশ তৈরি হয়, সবার সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দ উৎসব ভাগাভাগি করা হয় বা ঈদ উৎসব পালন করার যে শর্তগুলো থাকে, করোনার কারণে সেগুলো এবার অনুপস্থিত, এটাই বাস্তবতা। সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বাস্তবতা নেতাকর্মীরা মেনে নিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন