ঋণের বোঝা উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জন্য বরাবরই মাথাব্যথার প্রধান কারণ। নভেল করোনাভাইরাস এ পীড়া আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মহামারীটির কারণে স্থবিরতা নেমে এসেছে ছোট-বড় সব অর্থনীতিতেই। তবে সবচেয়ে সংবেদনশীল অবস্থায় রয়েছে উদীয়মান দেশগুলো। এ অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে গৃহীত ঋণ ফেরত দেয়াটা তাদের জন্য পাহাড়সম বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর ব্লুমবার্গ।
অবকাঠামোসহ বেশির ভাগ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্যই অগ্রসরমাণ অর্থনীতিগুলোকে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেটি হোক সরকারি অথবা বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও ভালো মুনাফার লোভে এসব দেশের সরকারি বন্ড কিনতে আগ্রহী হয়। বন্ড বিক্রি করলে তার বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এ বিষয়টাই বর্তমানে উদীয়মান দেশগুলোর জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদীয়মান বাজারগুলোর কাছে বর্তমানে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের পাওনা ৮ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে এসব দেশের জেরবার অবস্থা। মহামারীটির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্থবিরতার আঁচ তাদের ওপর ভালোভাবেই পড়েছে। অভ্যন্তরীণ জরুরি ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে এসব দেশের সরকার রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় ঋণ পরিশোধের চাপ তাদের জন্য বাড়তি সংকটের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেসরকারি ঋণদাতারা ভালো করেই জানে উন্নয়নশীল বাজারে বিনিয়োগ করাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তার পরও উচ্চহারে সুদের লোভে তারা সেখানেই অর্থ ঢালে। সিটিগ্রুপ ইনকরপোরেশনের সাবেক নির্বাহী বিল রোডস দীর্ঘদিন উদীয়মান বাজারগুলোর ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে কাজ করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ‘অগ্রসরমাণ দেশগুলোয় বেসরকারি ঋণদাতারা বিনিয়োগ করলে সেটি ফেরত পাওয়াটা খুবই কঠিন কাজ। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে। মহামারীটির কারণে অনেক বিনিয়োগকারীকেই ধরা খেতে হতে পারে।’
একথা ঠিক যে মহামারীর সংকটকালে অগ্রসরমাণ অর্থনীতিগুলোকে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে ছাড় দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন রয়েছে। সেগুলো হলো, কী পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে, আর কারা দেবে?
বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতিকে নিয়ে গঠিত ফোরাম গ্রুপ অব টুয়েন্টি বা জি২০ এরই মধ্যে কিছু দরিদ্র দেশের জন্য চলতি বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উদ্যোগে সমন্বয়কারীর ভূমিকায় রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেড গ্রুপ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স (আইআইএফ)। সংস্থাটি বলছে, সংকটে থাকা ক্ষুদ্র অর্থনীতিগুলোকে ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় দেয়া দরকার, সেকথা ঠিক। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি সমস্যা রয়েছে। যেসব তহবিল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান উদীয়মান দেশগুলোর সার্বভৌম বন্ডে বিনিয়োগ করে, খুবই স্বাভাবিক যে তারা সবার আগে তাদের ক্লায়েন্টদের স্বার্থটাই দেখবে।
নিউইয়র্কে শ্রোডার ইনভেস্টমেন্টের হেড অব ইমার্জিং মার্কেট ডেট জেমস বেরিনু বলেছেন, ‘বেসরকারি খাতের ঋণ মওকুফ অথবা তা পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় ছাড় দেয়ার চিন্তা করা আমি মনে করি বাস্তবসম্মত নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে ঐকমত্যে আনার চেষ্টা করাটাও রীতিমতো দুঃস্বপ্নের বিষয়।’
এ অবস্থায় উন্নয়নশীল বেশির ভাগ দেশকেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়া এড়াতে ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। কিন্তু সে কাজটি সহজ হবে না। কারণ তাদের বন্ডের ক্রেতার তালিকায় থাকা তহবিল ও সম্পদ ব্যবস্থাপকের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
এর অর্থ, বেসরকারি ঋণদাতারা খুব সহজে উদীয়মান দেশগুলোর ঋণ পরিশোধে ছাড় দেবে না। আবার ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর মতো সুবিধা পেতে বেসরকারি ঋণদাতাদের সঙ্গে যে দরকষাকষি করাটাও বেশ কঠিন কাজ। মোদ্দাকথা হলো, বেসরকারি খাত থেকে গৃহীত ঋণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে রয়েছে। এর যন্ত্রণা থেকে বাঁচাটা তাদের জন্য খুব একটা সহজ হবে না।