নকবা দিবস: আরবরাই আজ ইসরায়েলের নিকট বন্ধু!

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

নভেল করোনাভাইরাসে পৃথিবীর বিপর্যয়ের মধ্যে গত ১৫ মে পালিত হয়েছে মজলুম ফিলিস্তিনিদের ৭২তম নকবা দিবস বা মহাবিপর্যয়ের দিন। ফিলিস্তিনিদের কাছে ১৫ মে শুধু একটি দিবস নয় জন্মভূমি হারানো বেদনার দিন। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশদের দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে এই দিনে শুরু হয় ইসরায়েলি নতুন আগ্রাসন। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের এই আগ্রাসন হঠাৎ করে ছিল না বরং ছিল সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা। ১৮৮২ সালে রাশিয়ায় ইহুদিদের জায়ন আন্দোলন এবং ১৮৯৭ সালে ‘জায়নিস্ট’ নামক সংগঠন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তারা ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে আসা এসব ইহুদিরা উচ্ছেদ করে ফিলিস্তিনিদের। সেদিনই শরণার্থী হতে হয় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে। মাত্র দেড় লাখ ফিলিস্তিনি থেকে যেতে পেরেছিল নিজভূমে।

১৯৪৮সালে ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত চারবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু প্রতিবার বেড়েছে ইসরায়েলের ভূমি, জোরদার হয়েছে দখলদারিত্ব। দীর্ঘ ৭২ বছরের এই সংগ্রামে পারস্য সাগর আর ভূমধ্যসাগরে বহুজল গড়িয়েছে। শর্তের বেড়াজাল আর কথিত শান্তি আলোচনার আড়ালে ইঞ্চি ইঞ্চি করে কমেছে ফিলিস্তিনি ভূমি। বদল ঘটেছে শত্রু-মিত্রের। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে অনেক আরব দেশ আজ ফিলিস্তিনিদের পাশে নেই। রাজনীতি, ব্যবসা ও ক্ষমতার মোহে আরব রাষ্ট্রগুলোই হয়ে উঠেছে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভূমধ্যসাগরের পাড়ের তিন মহাদেশের মিলনস্থল ও তিন ধর্মের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম আজ আরও ক্ষত-বিক্ষত ইসরায়েলি আগ্রাসনে।

ফিলিস্তিনবাসী যখন ৭২তম নকবা দিবস পালন করছে সে সময়ে তাদের মাথার উপর ঝুঁলছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথিত ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’। অসলো চুক্তি ভঙ্গ করে, বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেরুজালেম হতে যাচ্ছে দখলদার ইসরায়েলের রাজধানী। অন্যদিকে কথিত এই চুক্তির আওতায় জুলাই থেকে পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণের হুমকি দিচ্ছে ইসরায়েল। কথিত ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’র আওতায় ফিলিস্তিন হতে যাচ্ছে ঢাল-তলোয়ার বিহীন ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড। ফিলিস্তিনের অমতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর এই চুক্তিতে সমর্থন দিয়েছে শক্তিধর আরব রাষ্ট্রগুলো। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানের রাষ্ট্রদূত সেই চুক্তি প্রকাশের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে চুক্তির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে এসেছে। সৌদি যুবরাজ বিন সালমান ফিলিস্তিনকে আত্মসমর্পণের এই চুক্তি মেনে নেয়ার জন্য ২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। ইসরায়েলের কাছে ফিলিস্তিনকে বিক্রি করে দেয়ার এই প্রক্রিয়া হঠাৎ করে নয়। বরং গত দুই দশক ধরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েল গোপন ও প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাদের এই ঘনিষ্ঠতা জনমতের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে কথিত এই চুক্তি চাপিয়ে দিচ্ছে মার্কিন- ইসরায়েল ও তাদের ঘনিষ্ঠ আরব রাষ্ট্রগুলো। এর পেছনে রয়েছে বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি। 

একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের মিত্রতা ছিল। কিন্তু ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর আঞ্চলিক ক্ষমতা চর্চায় তেহরান রিয়াদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। হিজবুল্লাহ ও হামাসসহ বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠনকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ইরান। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও পারস্য সাগরে প্রভাব বিস্তার নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে জোট দাঁড়াতে শুরু করে।

তবে এই সম্পর্কে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে আল কায়েদা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান। আল কায়েদা ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মানে না অন্যদিকে সৌদি রাজতান্ত্রিক শাসনের বিরোধী। মুসলিম ব্রাদারহুডের ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ মতবাদ সৌদি রাজতন্ত্র ও ইসরায়েলি রাষ্ট্র দুইটির জন্য হুমকি স্বরূপ। আরব বসন্তের প্রাক্কালে মার্কিন বিরোধী আরব দেশগুলোর বিক্ষোভে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকার গঠন করলে তারা ‘আধুনিক ইসলামী’ দল হিসেবে পশ্চিমা সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করে। ইরান, সৌদি আরব ও তুরস্কের সঙ্গে ভারসাম্য সম্পর্ক তৈরি করে। কিন্তু ব্রাদারহুড সরকারের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ও সৌদি মতে ‘সন্ত্রাসী’ হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্টতা ইসরায়েল ও সৌদি আরবকে ভাবনায় ফেলে দেয়। প্রতিবেশী মিসরের কেমন সরকার আছে তা ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৬ সালের হামাসের কাছে ইসরায়েল পরাজিত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি অবরোধে মানবেতর জীবন যাপন করছে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার মানুষ। ব্রাদারহুড সরকার গঠন করলে গাজার জন্য মিসরের সীমান্ত খুলে দেয়। হামাসকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার ঘোষণা দেয়। ব্রাদারহুডকে সীমান্তের কাছে এইরূপে মানতে নারাজ সৌদি-ইসরায়েল-আমিরাত বলয়। ফলে সৌদি আরব ও আমিরাতের অর্থায়নে, ইসরায়েলের পরিকল্পনায় ব্রাদারহুডের সরকারের পতন ঘটায় এই অপ্রকাশ্য জোট। আরব বসন্ত সংঘটিত হওয়া অন্যান্য দেশেও ব্রাদারহুড ও ইরানপন্থি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তারা। সিরিয়ায়ও এই তিন দেশ একই সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও অস্ত্র সরবরাহ করে লড়ছে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। লিবিয়ায় ব্রাদারহুড সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে সৌদি অর্থায়ন ও আমিরাতের বিমান হামলা অব্যাহত আছে। 

এই অলিখিত জোটের পরিকল্পনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের জামাতা জেরাড কুশনার ও তারই বন্ধু সৌদি যুবরাজ বিন সালমান। ২০১৭ সালে সৌদি সফরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, মার্কিন সামরিক শক্তির ওপর ভরসা না করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উচিত নিজেদেরই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ করা। তার ব্যক্তব্যের সারমর্ম  ছিল যে, আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েল জোটবদ্ধ হয়ে তাদের অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করুক। নতুন এই জোটের কথা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী স্বীকারও করেছেন। তিনি লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ইরানের আগ্রাসন’ মোকাবেলার জন্য ‘মধ্যপন্থি সুন্নি’ দেশগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। ইসরায়েল- সৌদি সম্পর্ক প্রকাশ্যে আনতে ইসরায়েলের যোগাযোগ মন্ত্রী সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতিকে সেদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইরানের ব্যাপারে সৌদি আরবকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের ঘোষণাও দেন। তাদের অভিন্ন শত্রু ইরান, ইরানপন্থি সশস্ত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক ইসলাম।

ফলে জোট গঠনের জন্য ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা থাকা প্রয়োজন। মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত ইরানি জেনারেল সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে আলোচনার বার্তা নিয়ে ইরাকে গিয়েছিলেন বলে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন। এত বড় হাই প্রোফাইল সফরে হামলা এটা প্রমাণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি-ইরান উত্তেজনা কমতে দিতে চায় না।  জোট গঠনের লক্ষ্যেই ইরান ও ‘রাজনৈতিক ইসলাম’কে কাতার ব্যতিত মিসর, জর্ডানসহ পারস্য সাগরের দেশসমূহের শত্রু বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে। 

ফলে জিসিসি ভেঙে নতুন আদলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যবসায়িক ও সামরিক জোট গঠন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র । সে জোটের অংশীদার হবে ইসরায়েল, সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। কুয়েত ও ওমান নিরপেক্ষ থাকলেও জোটের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হবে।  মিসরের প্রেসিডেন্ট জেনারেল সিসি ইসরায়েলের প্রতি নিজের আনুগত্যের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। দুবাইয়ের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জিয়াদ ২০১৬ সালেই বলেছিলেন, ইসরায়েল শান্তি প্রক্রিয়া মেনে নিলে তাদের সঙ্গে ব্যবসা করবে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তিনি জানেন তাদের গোপন সম্পর্কের জনমত তৈরি করতে ও স্থায়িত্ব দিতে ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন’ শান্তি প্রক্রিয়ার নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে। বিন জায়েদ শান্তি প্রক্রিয়া বলতে মার্কিন সমর্থিত বিতর্কিত চুক্তিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন। বর্তমানে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও গবেষণায় একসঙ্গে প্রকাশ্যে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে আরব আমিরাত ও ইসরায়েল। বাহরাইনও ইসরায়েলের সঙ্গে মেডিকেল সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছে। সন্দেহ নেই করোনা পরিস্থিতি পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্ক প্রকাশ্যে আসবে। যার বিনিময়ে আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের ভূমির অধিকারকে বিক্রি করে দেবে নতুন বন্ধু ইসরায়েলের কাছে। 

তবে শক্তিধর আরব রাষ্ট্রসমূহ  পাশে না থাকলেও সৌদি চাপ সত্ত্বেও হামাসকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে কাতার। তুরস্ক, ইরানসহ অনারব মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিচ্ছে। জর্ডানও বুঝছে মন্দির পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। 

জর্ডানে ইসরায়েলি এজেন্ট এত শক্তিশালী যে যেকোনো মুহূর্তে সরকার পতন ঘটিয়ে দিতে পারে। জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ভীষণ ভয়ে ভয়ে পশ্চিম তীরের বসতি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি বসতিই মূলত জর্ডানের রক্ষাকবচ। পশ্চিম তীর ইসরায়েলের দখলে গেলে ইসরায়েল নিজেদের জর্ডান অভিমুখেও সম্প্রসারিত করে ফেলতে পারে যেকোন মুহূর্তে। ইহুদিদের দাবি পবিত্র তাওরাতের বর্ণনা অনুযায়ী ফিলিস্তিন, জর্ডান, মিসর ও সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ে ‘কেনান’ বা প্রতিশ্রুত ভূমির মালিক তারা। ডোনাল্ট ট্রাম্পের সেই কথিত চুক্তিতেও পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের অংশ হয়ে জর্ডান সীমান্ত পর্যন্ত অন্যদিকে সিরিয়ার গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ দেখানো হয়েছে। ফলে আজ যেসব আরব রাষ্ট্র্র ফিলিস্তিনকে একা করে দিচ্ছে তাদের ওপরই একদিন আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে তাদেরই বন্ধু ইসরায়েল। 

আরবদের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন মুছে যাওয়ার নয়। স্বাধীন ফিলিস্তিনের বড় শক্তি ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মশক্তি। করোনা মহামারীর দুর্দিনেও ভার্চুয়ালি আরো দৃঢ় প্রত্যয়ে নকবা দিবস পালন করেছে ফিলিস্তিনের জনগণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ অবিচ্ছিন্ন ফিলিস্তিন লিখে নিজেদের ভূমি উদ্ধারে প্রতিজ্ঞা করে। ভিআর নামক একটি অ্যাপসের মাধ্যমে বিদেশ থাকা ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে যাদের ফেরার অনুমতি নেই তাদেরকে নিজ গ্রাম ও শহরের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্যোগে যুক্ত হয়ে প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী ফিলিস্তিনি নিজেদের মাতৃভূমির প্রতি অঙ্গীকারকে আরো দৃঢ় করে। আবু দালফা নামে এক ফিলিস্তিনি সাংবাদিক টুইট করেন, আমরা এটা বিশ্বাস করি ইসরায়েলি দখলদারিত্বই শেষ কথা নয়। জনগণের এই আত্মবিশ্বাসই জাগিয়ে রাখবে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বপ্ন।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন