পঙ্গপাল ভীতি এবং বাস্তবতা

অধ্যাপক ড. গোপাল দাস

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পর্যুদস্ত বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই মানসিকভাবে ভালো নেই। তারপর আবার টেকনাফে পঙ্গপাল-সদৃশ কিছু পোকার আগমন আমাদেরকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। তবে সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বিশেষজ্ঞগণ নিশ্চিত করেন-“পঙ্গপাল-সদৃশ” হলেও সেগুলো প্রকৃতপক্ষে বিধ্বংসী পঙ্গপাল নয়।ঘাসফড়িংয়ের একটি প্রজাতি। আমাদের কৃষির জন্য নিশ্চিতভাবেই একটি স্বস্তিকর সংবাদ। কিন্ত “পঙ্গপাল” শব্দটি শুনলেই আমরা কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। জানার চেষ্টা করি না- সকল পঙ্গপালই বিধ্বংসী পঙ্গপাল কিনা? তাই আতঙ্কিত না হয়ে জানতে হবে আক্রমণ করা পতঙ্গটি ঘাসফড়িং না পঙ্গপাল। আবার পঙ্গপাল হলেও সেটি বিধ্বংসী  কিনা। আসুন নিচের আলোচনায় এসব পার্থক্য ছাড়াও বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী পঙ্গপালের আক্রমণের সম্ভাবনা কতটুকু-এসব বিষয় নিয়েই আজকের এই লেখাটি। 

ঘাসফড়িং বনাম  পঙ্গপাল

অর্থোপ্টেরা (Orthoptera) বর্গের অন্তর্গত চেলিফেরা উপ-বর্গের (Suborder: Caelifera) একটি বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিবার হলো অ্যাক্রিডিডি (Acrididae)।এই পরিবারে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির ঘাসফড়িং (Grasshopper) রয়েছে। ঘাসফড়িং আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি পতঙ্গ। এই বিশাল ঘাসফড়িং পরিবারের কিছুসংখ্যক প্রজাতি বিভিন্ন দিক থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে যাদেরকে আমরা পঙ্গপাল (Locust) বলি। এর অর্থ হল পঙ্গপাল বা লোকাস্ট বিশাল ঘাসফড়িং পরিবারের খুব সামান্য সংখ্যক সদস্য মাত্র। কিছু বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে পঙ্গপালকে ঘাসফড়িং থেকে আলাদা করা যায়। ঘাসফড়িংগুলো তাদের জীবদ্দশায়  বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একাকী থাকে। একে সলিটারিয়াস (Solitarious) পর্যায় বলে। এরা সাধারণত নিরীহ, ভূমির কাছাকাছি বিচরণ করে (Ground-dwelling), অর্থনৈতিকভাবে কম ক্ষতিকর এবং বড় ধরনের কোনো ঝাঁক বা গ্রুপ গঠন করে না। অপরদিকে, পঙ্গপাল বা লোকাষ্ট হলো এক ধরনের ঘাসফড়িং যাদের জীবদ্দশায় সলিটারিয়াস ছাড়াও গ্রেগারিয়াস পর্যায় থাকে (Gregarious)। এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে রূপান্তরিত হওয়ার সময় এদের আচরণ, শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও রঙের পরিবর্তন হয়। গ্রেগারিয়াস পর্যায়ে এরা অধিক প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন হয় এবং অনেক বড় সোয়ার্ম বা ঝাঁক তৈরি করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। সেজন্য পঙ্গপালকে অনেক সময় বলা হয় “Swarming grasshopper”।

তাহলে এটি স্পষ্ট যে, সোয়ার্ম বা ঝাঁক তৈরি করা পঙ্গপালের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। পঙ্গপালের একটি ঝাঁকে ঠিক কতসংখ্যক পঙ্গপাল থাকতে পারে সেটি প্রজাতিভেদে ভিন্ন হয়।পঙ্গপাল সাধারণত সলিটারি পর্যায়েই থাকে, কেবল উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই তারা সোয়ার্ম বা ঝাঁক গঠন করে।তবে ব্যতিক্রম হল, ঘাসফড়িংয়ের কিছু প্রজাতি রয়েছে যেগুলো বড় ধরনের ব্যান্ড বা গ্রুপ তৈরি করে থাকে। যেমন Aularches miliaris নামের ঘাসফড়িং প্রজাতিটি অনেক বড় হপার ব্যান্ড তৈরি করে (প্রায় ৩ লাখ )এবং পরবর্তীতে সোয়ার্ম বা ঝাঁক তৈরি করে কম দূরত্বে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয় বা মাইগ্রেট করে। এত বড় ব্যান্ড বা সোয়ার্ম তৈরি করা সত্ত্বেও এটি একটি ঘাসফড়িং (যদিও এটি কফি পঙ্গপাল নামেও পরিচিত)। ঘাসফড়িংয়ের আরো কিছু প্রজাতি রয়েছে যেগুলো ফেজ-সদৃশ (বড় গ্রুপ)বৈশিষ্ট্য তৈরি করে কিন্ত সোয়ার্ম বা ঝাঁক তৈরি করে না। তাহলে এটি পরিস্কার যে, কেবলমাত্র সংখ্যা বা পপুলেশনের ঘনত্বই ঘাসফড়িং এর কোণো প্রজাতিকে পঙ্গপাল বলার একমাত্র নিয়ামক নয়। আবার ব্যবহার বা আচরণগত দিক থেকে ও ঘাসফড়িং এবং পঙ্গপালকে আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হয়।

টেকনাফে পঙ্গপাল-সদৃশ যে পোকাটি দেখা গিয়েছিল সেটিকে বিভিন্নজন বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। কেউ বলেছেন এটি সাধারণ ঘাসফড়িংয়ের একটি প্রজাতি, কেউ বলেছেন কফি পঙ্গপাল বা কফি ঘাসফড়িং। আবার কেউ কেউ দাবি করেছেন এটি সেই মরুভূমির পঙ্গপাল। তবে পরবর্তী সময়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো বিশেষজ্ঞ দল সরেজমিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করে যে এটি সেই বিধ্বংসী পঙ্গপাল নয়। এটি Orthoptera বর্গের Pyrgomorphidae পরিবারের এক শ্রেণির ঘাসফড়িং। বৈজ্ঞানিক নাম-Aularches miliaris Linn.। এই প্রজাতিটিই আবার কফি পঙ্গপাল বা কফি ঘাসফড়িং বা হলুদ দাগযুক্ত ঘাসফড়িং নামে ও পরিচিত। এ পরিবারে প্রায় ৪৮৭টি প্রজাতি রয়েছে। এদের কিছু প্রজাতি রঙিন ও আকর্ষণীয় হয়।  দেখতে অনেকটাই কাছাকাছি। এ কারণে শুধু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে রঙিন এসব প্রজাতিকে সঠিকভাবে শনাক্তকরণ অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে।

মরুভূমির পঙ্গপাল বনাম অন্যান্য পঙ্গপাল    

অ্যাক্রিডিডি পরিবারে প্রায় ২০টির অধিক পঙ্গপালের প্রজাতি রয়েছে। যেমন-মরুভূমির পঙ্গপাল, মাইগ্রেটরি পঙ্গপাল, বোম্বে পঙ্গপাল, বাদামি পঙ্গপাল, লাল পঙ্গপাল, দক্ষিণ আমেরিকান পঙ্গপাল, হলুদ কণ্টকযুক্ত (Spined) বেম্বু পঙ্গপাল ইত্যাদি। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বিধ্বংসী হচ্ছে মরুভূমির পঙ্গপাল (Desert locust)। বৈজ্ঞানিক নাম Schistocerca gregaria । নাম থেকেই প্রতীয়মান যে মরুর পরিবেশের সঙ্গে এই পতঙ্গের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মরুভূমির পঙ্গপাল কোথায় ডিম পাড়ে, কীভাবে ডিম পাড়ে, হপার ব্যান্ড এবং সোয়ার্ম কীভাবে তৈরি হয়, একটি সোয়ার্মে কতটি পঙ্গপাল থাকতে পারে এবং কীভাবে ফসলের ক্ষতি করে সেই বিষয়ে অনেক গবেষনামূলক তথ্য রয়েছে।

তবে সংক্ষেপে বলা যায়, এদের একটি সোয়ার্ম বা ঝাঁকে কয়েক কোটি পঙ্গপাল থাকতে পারে। মুহূর্তেই একটি বিশাল এলাকার ফসল বা গাছপালা খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলতে পারে এবং একস্থানের ফসল শেষ করে অন্যত্র গমন করে। এদের দমন করাও রীতিমতো দুরূহ কাজ। পঙ্গপালের অন্যান্য যেসব প্রজাতি রয়েছে সেগুলোকে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। এরা মরুভূমির পঙ্গপালের মত বিধ্বংসী নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বোম্বে পঙ্গপাল কেবল ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেই দেখা যায় এবং ১৯০১-১৯০৮ সালের মধ্যে এটি বড় ধরনের সোয়ার্ম বা ঝাঁক তৈরি করে ফসলের অনেক ক্ষতিসাধন করেছিল। সম্প্রতি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ যেমন লাওস, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে হলুদ কণ্টকযুক্ত বেম্বু পঙ্গপালের আক্রমণ দেখা গেছে। এই অঞ্চলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পঙ্গপাল হলো-ওরিয়েন্টাল মাইগ্রেটরি পঙ্গপাল। তবে স্বস্তির বিষয় হলো –এগুলো স্থানীয়ভাবেই সাধারণত থাকে। ওতটা বিধ্বংসী নয়।  

বাংলাদেশে মরুভুমির পঙ্গপাল আসার সম্ভাবনা কতটুকু?

বাংলাদেশে মরুভূমির পঙ্গপাল আসার এখনো পর্যন্ত কোনও ইতিহাস নেই।ভারতীয় উপমহাদেশের থর মরুভূমি বিশ্বের ১৭ম বৃহত্তম মরুভূমি যার আয়তন ২ লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি। মরুভূমির বেশিরভাগ অংশ ভারতের রাজস্থান ও গুজরাট রাজ্য। কিছু অংশ পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঙ্গরাজ্যে পড়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে বর্তমানে মরুভূমির পঙ্গপাল হানা দিয়েছে। বাংলাদেশে কোনো মরুভূমি নেই, ভূমির গঠন ও জলবায়ুগত অবস্থার কারণে এখানে মরুভূমির পঙ্গপাল আসার সম্ভাবনা কম। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সম্প্রতি বেসরকারি একটি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থার (এফএও) একজন পঙ্গপাল পূর্বাভাস বিশেষজ্ঞ পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, এ দেশে মরুভূমির পঙ্গপাল আসার সম্ভাবনা নেই। তিনি এও বলেছেন, টেকনাফে প্রাপ্ত পোকাটি মরুভূমির পঙ্গপাল নয়। এটি ঘাসফড়িংয়ের একটি প্রজাতি যা হলুদ কণ্টকযুক্ত (Spined) বেম্বু পঙ্গপাল হতে পারে। পঙ্গপালের এই প্রজাতিটি বিধ্বংসী নয়। অথচ “পঙ্গপাল” শব্দটি শুনলেই আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। মনে রাখতে হবে পঙ্গপাল মানেই মরুভূমির পঙ্গপাল নয়। পঙ্গপালের আরো প্রজাতি রয়েছে যেগুলো মরুভূমির পঙ্গপালের মতো ভয়ংকর ও বিধ্বংসী নয়। 

বিশ্বব্যাপী জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে অনেক পোকামাকড় তাদের বাসস্থান পরিবর্তন করছে এবং অনেক কম ক্ষতিকর পোকা অথনৈতিকভাবে ক্ষতিকর পোকায় রূপান্তরিত হচ্ছে। তাই বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পোকার মনিটরিং জোরদারকরণ, সঠিকভাবে শনাক্তকরণ ও দমনের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। তবেই ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। 

লেখক: অধ্যাপক ড. গোপাল দাস, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: [email protected] 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন