ঘূর্ণিঝড় আম্পান

১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বুধবার আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দেশের দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আগে আঘাত হেনে ঘূর্ণিঝড়টি অনেকটা দুর্বল হয়ে বাংলাদেশের স্থলভাগ অতিক্রম করায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা এড়ানো গেছে। তার পরও বিভিন্ন জেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে পটুয়াখালীতে দুজন, যশোরে তিনজন, চুয়াডাঙ্গায় দুজন এবং ভোলা, পিরোজপুর সাতক্ষীরায় একজন করে প্রাণ হারান।

দেশের দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪৬টি জেলার প্রায় লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ২০ ধরনের ফসল নানা মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ঝড়ে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে মৌসুমি ফল, সয়াবিন, বোরো ধান, মুগ ডাল গ্রীষ্মকালীন সবজি।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ৪৭ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান, হাজার ২৮৪ হেক্টর ভুট্টা, ৩৪ হাজার ১৩৯ হেক্টর পাট, হাজার ৩৩৩ হেক্টর পান, ৪১ হাজার ৯৬৭ হেক্টর সবজি, হাজার ৫৭৫ হেক্টর চীনা বাদাম, ১১ হাজার ৫০২ হেক্টর তিল, হাজার ৩৮৪ হেক্টর আম, ৪৭৩ হেক্টর লিচু, হাজার ৬০৪ হেক্টর কলা, হাজার ২৯৭ হেক্টর পেঁপে, হাজার ৩০৬ হেক্টর মরিচ, ৬৪০ হেক্টর সয়াবিন, হাজার ৯৭৩ হেক্টর মুগ ডাল এবং হাজার ৫২৮ হেক্টর জমির আউশ ধানের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গতকাল ডিজিটাল মাধ্যমে (জুম) সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ঘূর্ণিঝড়ে ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী . মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানেই সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। কোথাও কোথাও আক্রান্ত ফসল থেকে কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হবে। সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৬০-৭০ ভাগ আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলায় ঝরে পড়া আমগুলো ত্রাণ হিসেবে দুস্থ জনগণের মাঝে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া লিচু, কলা, সবজি, তিল অল্প কিছু বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব নিরূপণের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বীজ, সার উপকরণ দিয়ে সহায়তা করবে কৃষি মন্ত্রণালয়। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত ভর্তুকি কার্যক্রম থেকেও কৃষকদের সহায়তা দেয়া হবে।

গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বাগেরহাটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিংড়ি ঘের।

ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জেলা প্রশাসন যে প্রাথমিক তালিকা করেছে তাতে দেখা যায়, হাজার ৬৩৫টি চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার ৩৪৯টি ঘের আর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৪৭টি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান গতকাল এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে ২৬টি জেলায় প্রায় ১১০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী বরগুনা।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, এসব জেলায় ঘরবাড়ির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব ঘরবাড়ি সংস্কার নির্মাণে প্রতি জেলায় ৫০০ বান্ডিল টিন এবং ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া সাতক্ষীরা, বাগেরহাট পটুয়াখালীতে পাট, আম, লিচু মুগ ডালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানের তেমন ক্ষতি হয়নি, তবে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার আমের ক্ষতি হয়েছে। ২০০টি ব্রিজ কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার বেশির ভাগ বাগেরহাট, সাতক্ষীরা খুলনা জেলায় অবস্থিত। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৮৪টি জায়গায় বাঁধে ফাটল ধরেছে। যদিও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক দাবি করেছেন ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দেশের ১৩ জেলার মোট ৮৪টি পয়েন্টে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার বাঁধ ভেঙেছে।

প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর

সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে গাছচাপা পড়ে দেলসাত আলী নামে এক ?্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহত দেলসাত আলী কাজিপুর ইউনিয়নের প্রজার পাড়া গ্রামের মৃত আজিজল সেখের ছেলে এবং পেশায় রাজমিস্ত্রী ছিলেন।

নিহত দেলসাতের খালাতো ভাই ছালাম জানান, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার গজারিয়া পশ্চিম পাড়া থেকে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন দেলসাত। সময় ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। পথে সিরাজগঞ্জ-কাজিপুর সড়কের গজারিয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছলে একটি মরা গাছ দেলসাত আলীর মাথার ওপর ভেঙে পড়ে। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। অবস্থায় তাকে শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বগুড়া: আম্পানের প্রভাবে বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনা নদীতে ১২ যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা উল্টে গিয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন যাত্রী উদ্ধার করা হলেও দুজন নিখোঁজ হয়েছেন।

নিখোঁজ দুই নৌকা যাত্রী হলেন সারিয়াকান্দি উপজেলার নানদিয়ার চরের ওসমান ফকিরের মেয়ে মোছাম্মাৎ মীম জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার বালিজুড়ি গ্রামের খলিল মন্ডলের ছেলে ফরিদ উদ্দিন।

ঝালকাঠি: ঝালকাঠিতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বিষখালি নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সুগন্ধা বিষখালী নদীর পানি সাত থেকে আট ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনায় পানি প্রবেশ করে। পানিতে ডুবে গেছে ফসলের ক্ষেত। গাছপালা বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে বহু স্থাপনা ভেঙে গেছে।

ঝিনাইদহ: ঝিনাইদহে ঝড়ে গাছচাপা পড়ে নাদেরা বেগম নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন নিহতের স্বামী বুদোই মন্ডলসহ আরো কয়েজন। বুধবার রাতে সদর উপজেলার হলিধানী গ্রামে ঘটনা ঘটে।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক সরোজকুমার নাথ জানান, রাতে স্বামী বুদোই মন্ডল স্ত্রী নাদেরা বেগম ঘরের বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ২টার দিকে ঘরের পাশে শতবর্ষী একটি বটগাছ উপড়ে তাদের ঘরের ওপর পড়ে। এতে স্ত্রী নাদেরা বেগম ঘটনাস্থলে মারা যান। আটকা পড়ে আহত হন স্বামী বুদোই মন্ডল। খবর পেয়ে সকালে ঝিনাইদহ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে গাছ কেটে নিহতের মরদেহ আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন।

এছাড়া সাইক্লোন আম্পানে ঝিনাইদহ জেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

জেলার ছয়টি উপজেলায় রাতভর তাণ্ডব চালিয়েছে আম্পান। কৃষকরা জানান, ঝড়ে কৃষকের কলাগাছ, পাটক্ষেত, পানের বরজ, আম লিচু নষ্ট হয়েছে। বৃষ্টির কারণে তলিয়ে গেছে পুকুর-ঘাট, ঝড়ে ভেঙে গেছে গাছপালা কয়েকশ বাড়িঘর।

খুলনা: ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে খুলনার নয়টি উপজেলার ৮৩ হাজার ৫৬০টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়রা উপজেলায়।

খুলনা জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার বলেন, আম্পানের আঘাতে খুলনার নয়টি উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়ন এলাকায় কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকায় ঘর ভেঙে পড়েছে। অনেক এলাকায় ঘর আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে খুলনায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের সংখ্যা ৮৩ হাজার ৫৬০টি। কয়রায় বাঁধ ভেঙে গেছে।

নওগাঁ: ঘূর্ণিঝড় আম্পানে নওগাঁর সাপাহার পোরশাসহ নওগাঁয় আমের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমচাষীদের দাবি, আম গাছের প্রায় ৫০ শতাংশ আম ঝরে পড়েছে। যদিও কৃষি বিভাগ বলছে, জেলায় উৎপাদিত আমের শতাংশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন