প্রযুক্তিনির্ভরতা ব্যবসায় নতুন সুযোগ তৈরি করবে

দেশের অন্যতম কনগ্লোমারেট ইউনাইটেড গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। বিদ্যুৎ, রিয়েল স্টেট, কনস্ট্রাকশন, হাসপাতাল, ফার্মেসি, ম্যানুফ্যাকচারিং, পোর্ট, টার্মিনাল, শিপিং, সুপারশপ, ফুড কোর্ট, ট্রেডিং, ট্র্যাভেল, ব্রোকারেজ ব্যবসা ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে গ্রুপটি। নভেল করোনাভাইরাসের এ পরিস্থিতিতে গ্রুপটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম কেমন চলছে, তা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ইউনাইটেড প্রপার্টি সলিয়েশন্স লিমিটেডের (ইউপিএসএল) পরিচালক (বিপণন) শেখ মো. ফারুক হোসেন, ইউনাইটেড গ্রুপের সহযোগী পরিচালক খন্দকার জায়েদ আহসানকুতুবউদ্দিন আখতার রশীদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ইউনাইটেড গ্রুপের কার্যক্রম কেমন চলছে?

ইউনাইটেড গ্রুপের ব্যবসা বেশ ডাইভারসিফায়েড। আমাদের অনেক ব্যবসা যেমন—বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, ফার্মেসি, সুপারশপ, পোর্ট এগুলো জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত। ফলে এগুলোর কার্যক্রম আগের মতোই পুরোদমে চালু রয়েছে। আর আমরা প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রুপের কার্যক্রম সচল রাখার জন্য সহায়তা করছি। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু কর্মী ঘরে থেকেই ডিজিটাল মাধ্যমে অফিস করছেন। আর কিছু কর্মী যথাযথ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অফিস করছেন। অফিসে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে আমাদের কর্মীরা রোস্টার ভিত্তিতে অফিস করছেন। তাছাড়া কর্মীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা করেছি। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে রিয়েল স্টেট ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে। রিয়েল স্টেটের ক্ষেত্রে গ্রাহকের ব্যক্তিগত উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে, যা কভিড-১৯-এর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়। তবে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছি। গ্রাহকদের আমরা এ বার্তা দিতে চাই, যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা তাদের পাশে আছি। আমরা শুধু ব্যবসাই করছি না, বরং ইউনাইটেড ট্রাস্টের মাধ্যমে সমাজের অনগ্রসর মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে সামাজিক দায়িত্বও পালন করছি। আমরা ইউএনডিপির সঙ্গেও কাজ করছি। মুন্সীগঞ্জে আমরা একটি কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালও করেছি। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে এর পরিসর আরো বাড়ানো সম্ভব। আমাদের সে ধরনের প্রস্তুতিও রয়েছে।

ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালু রাখতে গিয়ে আপনারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন?

এক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। যেমন সুপারশপ চালু রাখার ক্ষেত্রে কর্মী ও গ্রাহকদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুসারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কর্মীদের পরিবহনের ব্যবস্থা করাটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, সেটি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। তাছাড়া মহামারীর এ সময়ে স্বাভাবিকভাবেই সবার মধ্যে নিজের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাজ করে। এক্ষেত্রে আমাদের কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে আমরা নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যারা বাসায় বসে কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি কীভাবে সবার সহযোগিতায় ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়া যায়। গত দুই মাসে প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা কর্মীদের স্বাভাবিক সময়ের মতোই বেতন-ভাতা ও বোনাস প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া আমাদের হাসপাতালের কেয়ার গিভার যারা রয়েছেন, তাদের জন্য যথাযথ আইসোলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের অন্য কর্মীদের জন্যও একই ব্যবস্থা রয়েছে। কর্মীদের যে কোনো বিপদে আমরা তাদের পাশে রয়েছি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা সামনের দিনগুলোতে কেমন সহায়ক হবে?

এটি একেবারে নতুন একটি অভিজ্ঞতা। এমন পরিস্থিতি আমাদের জীবদ্দশায় কেউ প্রত্যক্ষ করিনি। কভিড-১৯-এর মহামারীতে মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ার কারণে সবাই কিন্তু ঘরে বসেই যথাসম্ভব নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে চাইছে। এই যেমন, আমরা ইউনাইটেড হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেছি। এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আগে হয়তো মানুষ প্রয়োজন না থাকলেও সামান্য অসুস্থতায়ও হাসপাতালে ছুটে আসত। কিন্তু এখন ছোটখাটো সমস্যায় মানুষ টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। তারপর সুপারশপ ইউনিমার্টের কথাই ধরুন। আগে যেসব গ্রাহক প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রয়োজনে সুপারশপে আসতেন, তিনি এখন এক সপ্তাহ কিংবা ১০ দিনের বাজার একবারেই করছেন। তাছাড়া আমরা হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু করেছি। ফলে সুপারশপে না এসেও মানুষ ঘরে বসে অনলাইনে অর্ডার দিলেও পণ্য বাসায় চলে আসছে। এতে অপ্রয়োজনীয় উপস্থিতি এড়িয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রয়োজন মেটানোর বিষয়ে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও মানুষের মধ্যে এ অভ্যাস থেকে যাবে। আমরাও গ্রাহকের আচরণগত এসব বৈশিষ্ট্য গবেষণা করে ভবিষ্যতে ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণ করব। এটি আমাদের জন্য একটি নতুন সুযোগও বটে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে...

পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ার বিকল্প নেই। আগেই বলেছি, আমরা ইউনাইটেড হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেছি। এর পাশাপাশি আমরা একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি, আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যেই এটি চলে আসবে। এর মাধ্যমে ঘরে বসে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট থেকে শুরু করে আমাদের ওয়েলবিং ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা সবকিছুই করা সম্ভব। এর মাধ্যমে আমরা একটি পরিপূর্ণ ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। আমরা মাইক্রোসফট টিম, গুগলের জুম ব্যবহার করে বাসায় বসে অফিসের কাজ করছি। আমরা আমাদের ইআরপি সিস্টেমটিকে আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি, যাতে পুরোপুরি অটোমেটেড সিস্টেমে ব্যাংকের মাধ্যমে সাপ্লাইয়ার পেমেন্ট করা যায়। আমরা সবকিছুতে প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সামনের দিনগুলোতে এর ব্যবহার আরো বাড়বে।

কভিড-১৯-এর কারণে মানুষের মধ্যে সুপারশপনির্ভরতা অনেক বেড়েছে। ইউনিমার্টের ব্যবসা কেমন চলছে?

এতদিন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর গ্রাহককে কেন্দ্র করেই ইউনিমার্টের ব্যবসা ফোকাস করা হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব শ্রেণীর গ্রাহকের কথা মাথায় রেখেই আমরা সার্ভিস দিচ্ছি। এক্ষেত্রে আমাদের সাপ্লাইয়ার যারা রয়েছেন, তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রাহকের চাহিদা পূরণে তারা নিয়মিতভাবে আমাদের পণ্য সরবরাহ করে যাচ্ছেন। ঢাকায় আমাদের গুলশান ও ধানমন্ডিতে ইউনিমার্টের শাখা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা হোম ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে কিন্তু পুরো রাজধানীতেই ইউনিমার্টের পণ্য সরবরাহ করছি। এজন্য আমাদের ইনভেন্টরি সিস্টেমের সক্ষমতাকে বাড়াতে হয়েছে। আগে সুপারশপের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন জায়গায় শাখা খুলতে হতো। এতে কিন্তু ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন কোনো শাখা না খুলেই বাড়তি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এতে ব্যবসা বাড়ার পাশাপাশি ব্যয়ও সাশ্রয় হচ্ছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের মনস্তত্ত্বে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে?

রিটেইল ব্যবসা হওয়ায় আমাদের গ্রাহকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিক সময় আর কভিড-১৯-এর সময়ের তুলনা করলে দেখা যায়, গ্রাহকদের মনস্তত্ত্বে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন এখন বিলাসবহুল পণ্য কেনার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে। মানুষ যেটা প্রয়োজন সেটাই কিনছে। অতিরিক্ত কেনার প্রবণতাও কমেছে। আর সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রযুক্তিকে দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগানোর প্রবণতা অনেক বেড়েছে। মানুষ বর্তমানে প্রযুক্তির সুফলের বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তির বিষয়টি মানুষের লাইফস্টাইলের সঙ্গে আরো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন