আন্তর্জাতিক মানে নিতে চাই এনসিসি ব্যাংককে

মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। প্রায় তিন বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে। এর আগে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন যমুনা ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়। এনসিসি ব্যাংক ঘিরে নিজের স্বপ্ন দেশের ব্যাংকিং খাতের নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

২৮ বছরে পদার্পণ করল এনসিসি ব্যাংক। দীর্ঘ পথচলা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

ব্যাংক হিসেবে এনসিসির যাত্রা ১৯৯৩ সালের ১৭ মে। সে হিসেবে ব্যাংকের বয়স ২৭ বছর। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনার সময়টি হিসাবে ধরলে এনসিসি ব্যাংকের বয়স ৩৫ বছর। দীর্ঘ পথযাত্রা মসৃণ না হলেও ছিল গৌরবের। গত কয়েক দশকে দেশের আর্থিক খাত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনার কথাও শোনা গেছে। কিন্তু এনসিসি ব্যাংক পথ চলেছে সুনামের সঙ্গে। ব্যাংক ঘিরে বড় কোনো আর্থিক অনিয়মের ঘটনা শোনা যায়নি। এটি এনসিসি ব্যাংককে দেশের অন্য পাঁচটি ব্যাংক থেকে স্বাতন্ত্র্যতা এনে দিয়েছে।

শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে এনসিসি ব্যাংকে প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালন করছেন। সময়ে মৌলিক কী পরিবর্তন আনতে পেরেছেন? 

এনসিসি ব্যাংকের সঙ্গে আমার পথচলা পাঁচ বছরের। এর মধ্যে প্রায় তিন বছর সময় আমি শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পাঁচ বছরে এনসিসি ব্যাংক দ্বিগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে। ব্যাংকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে আমূল পরিবর্তন এসেছে।

দীর্ঘ বয়সী যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের লিগ্যাসি থাকে। গত কয়েক বছরে আমরা লিগ্যাসি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। এনসিসি ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হাজার কোটি থেকে বাড়িয়ে হাজার কোটিতে উন্নীত করা হয়েছে। পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২৭ কোটি টাকায়। ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

গত পাঁচ বছরে এনসিসি ব্যাংকের আমানত ৭৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে আমাদের কাছে জমা আছে গ্রাহকদের ২০ হাজার ৪০৯ কোটি টাকার আমানত। পাঁচ বছরে এনসিসি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ বেড়েছে ৭০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আমরা এনসিসি ব্যাংকের গ্রাহকদের ১৭ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছি। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে এনসিসি ব্যাংকের সম্পদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

গত কয়েক বছরে এনসিসি ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। ২০১৯ সালের জন্য আমরা রেকর্ড ১৭ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছি। এনসিসি ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ৮৮ পয়সা। মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধি হলেও আমাদের ব্যাংকের শেয়ারদর সব সময়ই স্থিতিশীল ছিল।

দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এনসিসি ব্যাংকের অবদান কী?

দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতিটি ধাপেই এনসিসি ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভারী শিল্প, গার্মেন্ট, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে। দেশের স্বনামধন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্ম এনসিসি ব্যাংকের হাতে। ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে বড় করপোরেটে উন্নীত হয়েও ওইসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ছেড়ে যায়নি।

ব্যাংকের বিনিয়োগের প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থ এসএমই খাতে গিয়েছে। এসএমই খাতে বিতরণকৃত ঋণে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেশি, এমন তত্ত্বকে আমরা ভুল প্রমাণ করেছি। খাতে বিতরণকৃত ঋণে আমাদের খেলাপির হার খুবই কম। দেশের প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে ঋণ বিতরণেও এনসিসি ব্যাংকের বড় ধরনের সাফল্য রয়েছে। এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের চেয়ে আমরা সরাসরি কৃষকদের হাতে ঋণ দেয়ার চেষ্টা করেছি। এজন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এনসিসি ব্যাংক শাখা খুলেছে। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে এক সময় শুধুই তামাক চাষ হতো। এনসিসি ব্যাংকের চেষ্টায় পাটগ্রাম এখন ভুট্টা চাষের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে।

গত পাঁচ বছরে এনসিসি ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি ১১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৯ সালে ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ১০ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার পণ্য। একই সময়ে এনসিসি ব্যাংকের মাধ্যমে হাজার ৮২৭ কোটি টাকার রফতানি আয় দেশে এসেছে। পাঁচ বছরে ব্যাংকের রফতানি আয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এনসিসি ব্যাংক হাজার ২৮৪ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে এনেছে। বিশ্বের ৩৩৩টি ব্যাংকের সঙ্গে এনসিসি ব্যাংক করেসপন্ডিং সম্পর্ক তৈরি করেছে।

ব্যাংক হিসেবে এনসিসির শক্তির জায়গা কোনটি?

সম্পদের গুণগতমানে এনসিসি ব্যাংক অত্যন্ত সমৃদ্ধ। গত কয়েক বছরে ব্যাংকের প্রত্যেকটি সূচক দ্বিগুণ হয়েছে। বিপরীতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ থেকেছে স্থিতিশীল। এখন পর্যন্ত এনসিসি ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ৮৬১ কোটি টাকার ঋণ। খেলাপি ঋণের হার দশমিক ৮১ শতাংশ। গত কয়েক বছরে দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। কিন্তু এনসিসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়েনি। গত তিন বছরে বিতরণকৃত একটি ঋণও খেলাপি হয়নি। খেলাপি হওয়া ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এনসিসি ব্যাংকের ঝুঁকিবারিত সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার (সিআরএআর) ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।

মুডিস’-এর রেটিং আছে, দেশে এমন বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র আটটি। এর মধ্যে ২০১৯ সালে মাত্র দুটি ব্যাংকের রেটিং অপরিবর্তিত ছিল, এনসিসি ব্যাংক তার মধ্যে একটি। ছয়টি ব্যাংকেরই রেটিং আগের বছরের চেয়ে খারাপ হয়েছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের রেটিংয়ে এনসিসি ব্যাংকের দীর্ঘ মেয়াদে ঋণমান এএ। আর স্বল্প মেয়াদে ঋণমান এসটি-১। সব মিলিয়ে রেটিংয়ের দিক থেকে এনসিসি ব্যাংক তার ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে।

ব্যাংকের সম্প্রসারণে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

গত কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে আমরা বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছি। সারা দেশে এনসিসি ব্যাংকের মোট শাখা সংখ্যা ১২১টি। এসব শাখার মধ্যে ৬০টি শাখাকে সেন্ট্রালাইজড মডেলের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে গ্রাহকদের যত ধরনের সেবা দেয়া যায়, সবই আমরা দিচ্ছি। এনসিসি ব্যাংকের এটিএম বুথ সংখ্যা ১২১। আগামী এক বছরের মধ্যে সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এনসিসি ব্যাংকের সেবা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে একটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান তৈরি করছি। সব মিলিয়ে এনসিসি ব্যাংককে গণমুখী ব্যাংকে রূপান্তরের সব উদ্যোগই নেয়া হয়েছে।

এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার শতাংশ কার্যকর করার কথা। উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবায়ন হলো?

সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মধ্যে আমরা ঋণের সুদহার শতাংশে নামিয়ে এনেছি। তবে ঘোষণা অনুযায়ী, আমানতের সুদহার শতাংশে নামেনি। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যক্তিশ্রেণীর আমানত নেই বললেই চলে। বিপদ মোকাবেলায় গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে গণহারে টাকা তুলেছে। ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। ফলে মুহূর্তে ব্যাংকের প্রধান ভরসা প্রাতিষ্ঠানিক আমানত। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই আমানতের সুদহার কমাতে রাজি নয়। বেশি সুদ না দেয়ায় গত কয়েক মাসে এনসিসি ব্যাংক থেকে ৮০০ কোটি টাকার আমানত অন্য ব্যাংকে চলে গেছে। আমানতের সুদহারে শৃঙ্খলা না এলে কমপ্লায়েন্স পরিপালন করে চলা ব্যাংকগুলো বিপদে পড়বে। এজন্য সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে আমানতের সুদ নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দেয়া দরকার। আমানতের সুদহার শতাংশ কার্যকর করা সম্ভব হলে শতাংশ সুদে ঋণ দিয়েও ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমার কথা নয়।

নভেল করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তোলার দায়িত্ব ব্যাংকিং খাতের ওপর পড়েছে। যদিও দেশের ব্যাংকিং খাত আগে থেকেই দুর্বল। অবস্থায় সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হবে?

করোনা সংক্রমণে বিশ্বব্যাপীই মানবিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আমদানি, রফতানি রেমিট্যান্স খাত বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকিং খাতকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। ব্যাংক হলো যে কোনো অর্থনীতির হূিপণ্ড। মানুষের শরীরে হূিপণ্ডের যে ভূমিকা, অর্থনীতিতেও ব্যাংকের ভূমিকা তেমনই। ব্যাংকে টাকা আসার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা সংক্রমণের আগে গ্রাহকরা যেসব চেক জমা দিয়েছিলেন, তা- বাউন্স হচ্ছে। ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থের কোনো মুভমেন্ট নেই। ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বড় অংশ ব্যাংকের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। একইভাবে মূলধনও শেষ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ব্যাংক যদি ধরা খেয়ে যায়, দেশের অর্থনীতিতে তা নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

এনসিসি ব্যাংক ঘিরে আপনার স্বপ্নের কথা বলুন

দেশে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। কিন্তু এমন একটি ব্যাংকও নেই, যাকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ধরা যায়। উন্নত বিশ্বে গেলে ব্যাংক নির্বাহী হিসেবে খুব অসহায় মনে হয়। মূলধন সক্ষমতা, প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো পিছিয়ে আছে। কেন বাংলাদেশের একটি ব্যাংকও আন্তর্জাতিক মানের হবে না, প্রশ্ন আমাকে পীড়িত করে। এজন্য আমি চাই দেশের অন্তত একটি ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানের হোক। যে ব্যাংককে বিশ্বের ৫০০টি ব্যাংকের মধ্যে স্থান দেয়া হবে। এনসিসি ব্যাংকই যেন দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক হয়, সে চেষ্টা স্বপ্ন আমাকে তাড়িত করে। আগামীর দিনগুলোতে এনসিসি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে চাই, যাতে অন্যরাও ব্যাংককে অনুসরণ করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন