১৬ মের ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল ও মওলানা ভাসানী

বি.ডি. রহমতউল্লাহ্

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ১৯৭৬ সালের ১৬ মের ফারাক্কা লং মার্চের রাজনৈতিক গুরুত্ব আজও এত প্রাসঙ্গিক, যা বিশ্লেষণ করলে এ দেশ, এ দেশের কিষাণ-মজুর-মেহনতি জনগণের এক বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির নতুন আহ্বান, এক নতুন উদ্দামতার ডাক শুনতে পাওয়া যায়। 

মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চ শুধু জলপ্রাপ্তির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়া অবৈধ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধেই ছিল না, এই ঐতিহাসিক লং মার্চ ছিল এ দেশের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সব ধরনের অন্যায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, নতুন করে বাঁচার, মুক্তির লড়াই শুরু করার এক বিপ্লবী হুঙ্কার।

ভারত সরকার এ অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইনকানুন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে প্রবহমান আন্তর্জাতিক নদীগুলোর গতিপথ বন্ধ করে দিচ্ছে। পানি প্রত্যাহার, বাঁধ নির্মাণ, প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন করে এ এলাকার নদী-খাল-বিল-হাওড় নিশ্চিহ্ন করে অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের উজানে পানি আগ্রাসনের কারণে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটছে এবং বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে, তা আমাদের সবারই জানা দরকার। আমরা জানি, শত শত বছর ধরে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং এদের উপনদীগুলো চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারত থেকে পানি বয়ে নিয়ে এসে বাংলাদেশের পানির প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ভারত উজানে একতরফাভাবে বাংলাদেশের পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহ মারাÍকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পাতাল পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে নলক‚পে পানি উঠছে না। সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরীণ নদী, উপনদীগুলোয় প্রবেশ করছে। ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এটা স্বতঃসিদ্ধ যে বাংলাদেশ বাঁচবে নদী-জল বাঁচলেই।

প্রধানত নিম্নলিখিত দুটো কারণে বাংলাদেশের পানির প্রয়োজন:

১. জোয়ারের পানি দিনে দুবার বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। নদীর প্রবাহ বেশি থাকলে নদীর পানি সমুদ্রের লোনা পানিকে বাধা দেয় এবং সে কারণে সমুদ্রের লোনা পানি বেশি ভেতরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু নদীর পানি কমে গেলে সমুদ্রের লোনা পানিকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে সমুদ্রের লোনা পানি আরো বেশি নদীর উজানে ঢুকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কৃষিজমি, নিম্নাঞ্চল ও জলাভ‚মিকে প্লাবিত করে। লবণাক্ততার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের কৃষিজমি, জলাভ‚মিতে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

২. বাংলাদেশের লাখ লাখ নলক‚পের মাধ্যমে আমরা খাবার পানি, ধান চাষের জন্য সেচের পানি ও নানা কাজের জন্য পাতালের পানি ব্যবহার করে থাকি, যাতে এ পানি গড়ে প্রতি বছর পাঁচ মিটার করে নিচে নেমে যায়। আবার প্রতি বছর বৃষ্টিপাতের জন্য গড়ে এক মিটার চার্জ হয় ও বর্ষাকালে বন্যার কারণে নিম্নাঞ্চল ও জলাভ‚মি প্লাবিত হওয়ায় চার মিটার চার্জ হয়। ফলে পরের বছর আমরা নলকূপের মাধ্যমে পাতালের পানি তুলে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু মূল পানিপ্রবাহ কমে গেলে কৃষিজমি, নিম্নাঞ্চল ও  জলাভ‚মি প্লাবিত হবে না বিধায় ভ‚-অভ্যন্তরস্থ ঘাটতি পানি রিচার্জ হবে না। পাতালের পানির স্তর নলক‚পের চেয়ে আট মিটারের বেশি নিচে নেমে গেলে নলক‚পে পানি উঠবে না এবং এতে সেচের পানি, খাবারের পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে।

ভারত এরই মধ্যে অনেক প্রকল্পের মাধ্যমে উজানে ড্যাম ও ব্যারেজ তৈরি করে বাংলাদেশের পানি ভারতের মরু অঞ্চল হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, দাক্ষিণাত্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সরিয়ে নিচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে এবং প্রাপ্ত পানি নদীর তলানি হিসেবে থাকছে বিধায় অনুপ্রবেশকারী সমুদ্রের লোনা পানিকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এতে নিচু জমিকে স্বাভাবিক প্লাবনের মাধ্যমে রিচার্জ করে পাতালের পানির চাহিদা  মেটানো যাচ্ছে না। ফলে লবণাক্ততা ও মিঠা পানির প্রবাহের অভাবে বাংলাদেশে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। ভারতের এমন কাজের ফলে জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ কঠিন ও নির্মম দারিদ্র্যে নিপতিত হবে। প্রসঙ্গত এটা উলে­খ করা যেতে পারে যে বর্তমান সাহারা মরুভূমি একসময় রোম সাম্রাজ্যের শস্যভাণ্ডার ছিল। কিন্তু লবণাক্ততার কারণে সেই শস্যভাণ্ডার এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে; যা পানি, গাছপালা, পশু-পাখি, বন-জঙ্গল, মনুষ্য বসবাসহীন এক বিরান ধূলিবালিময় উৎপাদনহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এই সেদিনও বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল নদীমাতৃক, শস্য-শ্যামল প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সবুজ প্রান্তরের একটি দেশ। যেখানে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেতে কিংবা পণ্য পরিবহনে সব ধরনের নৌকা ব্যবহার হতো; যা ছিল সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। আজ উজানে পানি অন্যায়ভাবে সরিয়ে নেয়ার ফলে ১৯৭১ সালে মোট নৌপথ যেখানে ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার, যা দিয়ে দেশের ৩২ শতাংশ যাত্রী ও ৪০ শতাংশ পণ্য পরিবহন হতো, ২০১২ সালে সেখানে নৌপথ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার; যাত্রী চলাচল কমে দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশ এবং পণ্য পরিবহন  ১০ শতাংশ। ২০২০ সালের কথা তো না বলাই ভালো!!

এবার আমরা হিসাব করে দেখি ভাটিতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং এদের উপনদীগুলো থেকে চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারতের ওপর দিয়ে কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে আর যাবতীয় কার্য সম্পাদন করতে ভারতেরই বা কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন। এ বিষয়ে ‘Water Perspectives, Issue and Concerns-by Ramaswamy R. Iyer, SAGE Publication, New Delhi’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ভারতে পানির সম্ভাব্য প্রাপ্যতা মোট দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫১৫ বিসিএম (বিলিয়ন কিউবিক মিটার), যেখানে নদীর পানি থেকে ১ হাজার ৯৫৩ বিসিএম, বৃষ্টি ও তুষার গলা পানি থেকে ৪ হাজার বিসিএম, রিচার্জযোগ্য পাতালের পানি থেকে ৪২০ বিসিএম, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির পানি হারভেস্টিং থেকে আসে ১৪২ বিসিএম।

এখন দেখি ভারতের কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন। একই তথ্যসূত্র অনুযায়ী, সেচকাজের জন্য ৬৭৭ বিসিএম, খাওয়া ও গৃহস্থালি কাজের জন্য ৬৭ বিসিএম, শিল্প-কারখানার কাজের জন্য ২৮ বিসিএম, পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য শূন্য ৮ বিসিএম আর ব্যবহারজনিত অপচয় ১৫ শতাংশ হিসাবে ১২০ বিসিএম অর্থাৎ ভারতের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে মোট ৯০০ বিসিএম। যেখানে প্রাপ্যতা হচ্ছে ৬ হাজার ৫১৫ বিসিএম, যা সাত গুণেরও বেশি!! অর্থাৎ ভারত তাদের দেশে প্রাপ্ত পানির সামান্য অংশ মাত্র ১৫ শতাংশ ব্যবহার করলেই চলে। ড্যাম, ব্যারেজ দিয়ে এভাবে প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ ধ্বংস করতে হয় না। তাতে বাংলাদেশকেও পানিশূন্য করে বিরান ভ‚মিতে পরিণত করতে হয় না। অর্থাৎ ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা ৫৪টি নদীর একটিতেও ড্যাম বা ব্যারেজ দিয়ে পানি সরানোর কোনো প্রয়োজনই নেই।

ভারত যা করছে তা বাংলাদেশের সঙ্গে তার নিজের করা চুক্তি ভঙ্গ করেই করছে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি এক চুক্তি হয়। ওই চুক্তির ৬ নং ধারায় বর্ণিত ছিল, ‘উভয় পক্ষই আরো সম্মত হচ্ছে যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকা উন্নয়ন, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ সম্পর্কিত বিষয়ে যৈাথ সমীক্ষা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’ ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানিপ্রবাহ কমে গেলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২Ñএই পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশকে সর্বনিম্ন পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ক্লজ ও মতবিরোধ হলে আরবিট্রেশনের ব্যবস্থা রেখে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮২ সালে চুক্তি শেষ হওয়ার পরই ভারত গঙ্গার পানি ও নেপাল থেকে আসা গঙ্গার উপনদীর পানি আন্তঃনদী সংযোগ খাল ও অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে সরাতে শুরু করলে বাংলাদেশ জাতিসংঘে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন ভারত বাধ্য হয়ে ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি করে। কিন্তু মানছে কই? তিস্তা নদীর ভাটিতে নিজ ভূখণ্ডে বাংলাদেশ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯৩ সালে তিস্তা ব্যারেজ চালু করে। এজন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্ত ভারতকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ভারত সরকার বাংলাদেশকে না জানিয়ে তিস্তার উজান থেকে বাঁধ দিয়ে সব পানি অবৈধভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে তিস্তা সেচ প্রকল্পসহ এ ব্যারেজের ভাটির জমিগুলো মরুময় হয়ে উঠেছে। ভারত এজন্য একটি রাজ্য সরকারের আপত্তির কথা বলছে। অথচ ভারতের সংবিধানের ২৫৩ নং ধারায় স্পষ্ট উলে­খ আছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করার বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, কোনো রাজ্যের ওজর আপত্তি আমলে নেয়ার কথা নয়। অথচ উল্টোটাই হচ্ছে।

আমরা দেখলাম আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার, বাংলাদেশ-ভারতের সমুদ্রসীমার সংকট সমাধান হয়েছে। একইভাবে জাতিসংঘের মাধ্যমে উজানে পানিসম্পদ ব্যবহারের বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। কারণ গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, বরাক-মেঘনাÑএগুলো কোনোটাই দেশীয় নদী নয়, সবগুলোই বহুদেশীয় তথা আন্তর্জাতিক নদী।

তিস্তা নদীসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ভারত নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। কাজেই এটা গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির ও আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারসংক্রান্ত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারত এটা কিছুতেই করতে পারে না। হয়তো আমাদের নির্লিপ্ততা ভারতকে এই অন্যায় করতে সাহস জুগিয়েছে। আমরা নদী ব্যবহারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালাগুলো দেখলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এগুলো হলো হেলসিংকি নীতিমালা ১৯৬৬-এর অনুচ্ছেদ ৪, ৫ ও ২৯; জাতিসংঘ নীতিমালা ১৯৯৭ ‘Convention on the Law of the Non-gravitational uses of International Water Courses’- এর ৭.১ অনুচ্ছেদ; UNEP-Convention on the Biological Diversities,1992; Ramsar Convention on Wet Lands 1971 Arranged by UNESCO; Helsinki Agreement 1992: Convention on the Protection and Use of Transboundary Water Courses and International Lakes- এর অনুচ্ছেদ (২গ)। এছাড়া World Commission on Dams [WCD] 1998, Established by World Bank an IUCN-সহ বিপুল নীতিমালা রয়েছে; যা দিয়ে ভারতের এ অন্যায্য আচরণকে সংযত করা যেতে পারে। আমরা যেমনটি পেরেছিলাম সমুদ্রসীমা সংকট সমাধান করতে।

ফারাক্কা বাঁধ তেমনি একটি পরিকল্পনার অংশ, যা ভারতের গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা নামক স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। গঙ্গা নদী থেকে যে জল বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে প্রবাহিত হয়ে আরো শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে এ দেশের জমিকে আরো উর্বর করত, আরো সুফলা করত, এ দেশের সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জলপথ চালু রাখত, মাছের অঢেল জোগান দিত, ভ‚পৃষ্ঠের পানির স্তর ঠিক রেখে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশকে জিইয়ে রাখত, এসব কর্মযজ্ঞকে স্তব্ধ করে দিয়ে আমাদের দেশকে মরুভূমি বানানোর এক পৈশাচিক ও দেশবিনাশী প্রকল্প। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী দেশকে বাঁচাতে, এ দেশের কিষাণ-মজুর-মেহনতি জনগণকে বাঁচানোর জন্যই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লং মার্চের মাধ্যমে এ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা লং মার্চে অংশগ্রহণের জন্য জনগণকে রাজশাহীতে জড়ো হতে আহ্বান জানান। মজলুম জননেতার এ আহ্বানে লাখো মানুষ সেদিন সমবেত হয়েছিল। মওলানা সেদিন রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানের ভাষণে ভারতকে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে পানিশূন্য মরুভূমি বানিয়ে ধ্বংস করতে বারণ করেন এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশকে প্রাপ্য ন্যায্য পানির হিস্যা দিতে আহ্বান করেন। ওই সভায় তিনি এ প্রকৃতিবিনাশী ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলারও দাবি করেন। মজলুম জননেতা কর্মসূচি অনুযায়ী সভা শেষে হাজার হাজার লোক নিয়ে ১০০ কিলোমিটার লং মার্চ করে ফারাক্কা বরাবর ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের  কানসাটে  পৌঁছেন এবং লং মার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

মজলুম জননেতার এ লং মার্চ আমাদের রাজনীতিকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল, যা তার মৃত্যুর পরে চর্চার অভাবে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ভারত শুধু ফারাক্কা বানিয়েই তাদের আগ্রাসন বন্ধ রাখেনি। আমাদের অন্যায্য নীরবতা তাদের আগ্রাসী সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত আরো এগিয়ে বাংলাদেশের নতুন মরণফাঁদ তিস্তা নদীর ওপর গজলডোবায় নির্মিতব্য নতুন বাঁধসহ আরো বেশ কয়েকটি বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাংশের জল-জমি-জনগোষ্ঠীকে নিঃস্ব, সর্বহারা করে ফেলেছে।  তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে উত্তরবঙ্গ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। 

এ পর্যন্ত করেই কিন্তু ভারত থেমে থাকেনি। ভারত সীমান্তে আজ বাংলাদেশের মানুষকে অবাধে খুন করছে। ভারত তার সুবিধে মতো স্থল ট্রানজিট, নৌ ট্রানজিট চালু করছে, অসম শুল্কহারে পণ্য আমদানি-রফতানির চুক্তি করছে, পণ্য রফতানিতে অশুল্ক বাধা বাড়িয়ে আমাদের বাণিজ্য বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, আন্তঃদেশীয় বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়ে ভারত একচেটিয়াভাবে ট্যারিফ নির্ধারণ করছে। এতসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে মওলানার ১৯৭৬ সালের ১৬ মের ফারাক্কা লং মার্চ ছিল এক প্রবল প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদ ছিল আধিপত্যের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, দখলের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে সে লং মার্চ ছিল প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। 

মওলানা ভাসানীর লং মার্চে ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নই এ দেশের কিষাণ-মজুর-মেহনতি জনগণের মুক্তি এনে দিতে পারে; এনে দিতে পারে এক গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন শাসন ব্যবস্থা।

তথ্যসূত্র: উজানে পানি আগ্রাসন ও বাংলাদেশের বিপর্যয়Ñড. এস আই খান. সাবেক পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘ

লেখক: বি.ডি. রহমতউল্লাহ্, সাবেক মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়

খণ্ডকালীন শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন