তৈরি পোশাক খাত

ব্যবসা থেকে সরে যেতে চান উদ্যোক্তারা

বদরুল আলম

শিল্প এলাকা আশুলিয়ায় অন্যতম বড় পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিং গ্রুপ। গ্রুপের একটি ইউনিট স্টারলিং ক্রিয়েশনে কাজ করেন সাড়ে হাজার শ্রমিক। কভিড-১৯-এর প্রভাবে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর কারখানাটি ফের সচল হলেও  উৎপাদনে আগের গতি নেই। আগে যেখানে ৩০ হাজার উৎপাদন হতো এখন হয় ২০ হাজার পিস। কারখানা কখনো ঘণ্টা চলে, আবার কখনো চলেই না। এই যখন অবস্থা তখন সুযোগ পেলেই ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যেতে চান বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা।

শুধু স্টারলিং গ্রুপ নয়, পোশাক খাতের অনেক উদ্যোক্তাই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ব্যবসা ছাড়ার মনোভাব পোষণ করছেন। তারা বলছেন, কভিড-১৯-এর প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মূল রফতানি গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো। একের পর এক বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। যার প্রভাব সরাসরি পড়বে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে। সামনের দিনগুলোয় অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে যাবে। তুলনামূলক সক্ষম অনেক উদ্যোক্তাই পোশাক খাত ছেড়ে মনোযোগী হবেন অন্য খাতের ব্যবসায়। ভবিষ্যতের পূর্বাভাস বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই পোশাক খাতের ব্যবসা থেকে সরে যেতে চাইছেন।

যদিও পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকে এখন ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বললেও তা বলার জন্যই বলা। কারণ ব্যবসা যখন কেউ শুরু করে তখন তার শেষটাও দেখতে চায়। এখনই শেষ দেখা যায়নি, অনেক কিছু দেখার বাকি আছে। হঠাৎ করে ভালো কিছু দেখা দিতেও পারে।

বিজিএমইএর  সভাপতি . রুবানা হক প্রসঙ্গে বলেন, এক্সিট পলিসি বছর খানেক আগে থেকেই চেয়ে আসছিলাম আমরা। যারা এখন আর টিকে থাকতে পারছে না এক্সিট পলিসি তাদের জন্যই। গুরুত্বপূর্ণ কেউ খাত থেকে বের হয়ে যাচ্ছে না। এক্সিট পলিসিটা এখন বৈশ্বিক বিষয়।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বিশ্লেষকরাও। তাদের ভাষ্য, করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রেক্ষাপট কেমন হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশ্বব্যাপী চীনের ওপর নেতিবাচক একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, যেটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। দেশটিতে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের গন্তব্যগুলোয়ও পরিবর্তন আসবে। সেখানে বাংলাদেশের একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হয়ে সম্ভাবনাগুলো ধরা দিতে শুরু করতে দেড়-দুই বছর সময় লেগে যেতে পারে। তাও সঠিকভাবে প্রক্ষেপণ করা যাচ্ছে না। কারণ কেউ বলতে পারছে না বিদ্যমান প্রাদুর্ভাব কখন থামবে। এখন পর্যন্ত করোনার যে প্রভাব এবং সে কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ তার কোনোটাই সরকারগুলো নিতে পারছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত স্থিতিশীল না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুই অনিশ্চিত। যদি পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায় ততদিন টিকে থাকতে পারবে কয়জন? যে ক্রয়াদেশগুলো ছিল সেগুলো বাতিল হয়ে যাচ্ছে, অনেক ডিসকাউন্ট হচ্ছে, পণ্যের দাম পরিশোধ পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক যদি সাপোর্ট দিতে পারেও তা কতটুকু পারবে?

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরি পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে যারা টিকে থাকবে তাদের পরিপক্বতা, বিশেষত্ব কোনো কিছুই কাজে আসবে না। তারা টিকে থাকবে শুধু ভাগ্যগুণে, এটাই বাস্তবতা। এখন যে যত কম দায়গ্রস্ত সে টিকে থাকবে, যার দায়গ্রস্ততা বেশি তার টিকে থাকার সুযোগও কমে যাবে। তার হয়তো সক্ষমতা আছে কিছু কিন্তু সে তো অর্থায়ন করতে পারবে না। ব্যাংক কতটুকুই করতে পারবে অর্থায়ন। বাংলাদেশ ইউরোপের দেশগুলোর মতো না। ইউরোপে চাইলে বন্ড ইস্যু করা যায়, আমাদের দেশে বন্ড তো সেলেবল না। আমাদের ব্যাংকগুলো কভিড-১৯ আসার আগেই সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ওই পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কারণে ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ করতে পারছিল না। আর এখন ব্যাংক ব্যক্তি খাত দুটিই বিপর্যস্ত। এখন অ্যাক্ট অব গড বা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

পোশাক পণ্য রফতানির বর্তমান প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ কনসাম্পশন বা চাহিদার প্রক্ষেপণেও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনা সংকটের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হাজার ১৫০টি কারখানার ৩১৮ কোটি ডলারের রফতানি ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। এদিকে এপ্রিল মাসে পোশাক পণ্যের রফতানিও কমেছে ব্যাপক হারে। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ২৪২ কোটি ডলারের পোশাক বাংলাদেশ থেকে রফতানি হলেও চলতি বছরের এপ্রিলে রফতানি হয়েছে ৩৬ কোটি ডলারের পোশাক। অর্থাৎ রফতানি কমেছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। আবার চলতি মে মাসের প্রথম ১১ দিনে ২০১৯ সালের মে মাসের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রফতানি কমেছে ৬৫ শতাংশ।  

রফতানিমুখী পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ ব্যবসার গতিপ্রকৃতি এখনো অনিশ্চিত। পশ্চিমা অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা আগে থেকেই দুর্বল ছিল। করোনার প্রভাবে অনেকে দেউলিয়া ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সার্বিক চাহিদা ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার প্রক্ষেপণ আছে। বড় ব্র্যান্ডগুলো এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা তাদের কনসাম্পশন ৬৫ শতাংশ কমিয়েছে। পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দুর্বল উদ্যোক্তার কারখানা বসে যাবে। আর যারা তুলনামূলক সক্ষম তারা পোশাক খাত থেকে সরে অন্য খাতের ব্যবসায় মনোযোগী হবেন বলে মনে করেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, শুধু পোশাক খাত নয় অনেক খাতেই অনেকে দেউলিয়া হয়ে যাবে।  তবে পোশাক খাতটি সবচেয়ে বেশি ভঙ্গুর এই জন্য  যে  এটা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। বিশ্বব্যাপী শিল্প মানুষের অগ্রাধিকারে কম আসবে। যেহেতু এটা অপরিহার্য হিসেবে গণ্য হবে না। গোটা বিশ্বই এখন অর্থনৈতিকভাবে হতাশাগ্রস্ত, প্রত্যেকেরই অগ্রাধিকার হবে খাদ্য, আশ্রয়, চাকরি। অনেক কিছুরই এখন পট পরিবর্তন হয়ে যাবে। ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড যেহেতু অগ্রাধিকারে থাকবে না, দেখা যাবে চাহিদা কমে যাচ্ছে। আর চাহিদা কমে যাওয়া মাত্র পোশাক শিল্পে প্রভাব পড়বে। কোনো সন্দেহ নেই যে দামি পোশাকগুলোর চাহিদা যেভাবে প্রভাবিত হবে মৌলিক পোশাক পণ্যগুলোতে প্রভাব তার তুলনায় কম হবে।

পোশাক শিল্প প্রতিনিধিরা বলছেন, গার্মেন্টস শিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানে একটি প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার যখন ১০ কোটি হয়, তখন ঘাড়ে নিতে হয় কোটির। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো সম্পদ নেই, কীভাবে এই বিষয়টি অ্যাড্রেস হবে। বাড়ি বিক্রি করে তো অ্যাড্রেস হবে না। অবস্থায় উদ্যোক্তা অবশই এক্সিট খুঁজবে আর সুযোগ থাকলে অন্য কিছু নিয়ে ভাববে। অন্যান্য পুঁজিঘন শিল্পগুলোয় সম্পদ আছে, একটা টেক্সটাইল কারখানায় টার্নওভার যদি কোটি হয়, ওখানে বিনিয়োগ আছে ন্যূনতম ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু গার্মেন্টসে কোটি টার্নওভার হলে বিনিয়োগ মাত্র কোটি ৫০ লাখ। অনেকেই এখন এক্সিটের কথা ভাবছেন। আবার এটাও ঠিক যে চাইলেই তো আর এক্সিট নেয়া যায় না। তবে যথাযথ সুযোগ পেলেই এক্সিট নিয়ে নেবে অনেকেই।

এফবিসিসিআই সহসভাপতি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মানুষের চরিত্র বদলে যাচ্ছে, মহামারীর প্রভাবে শিল্পের শ্রমিকদের আচরণগত পরিবর্তনও এসেছে। এমনটা আগে দেখা যায়নি। পরিস্থিতিতে টিকে থাকা জটিল। শ্রমিককেও ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখাতে হতো বর্তমান পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। এখন কারখানায় কোনো রকমে আট ঘণ্টা কাজ চলে, আবার চলে না। যেখানে উৎপাদন হতো ৩০ হাজার সেখানে উৎপাদন হয় ২০ হাজার পিস। এভাবে টিকে থাকা অসম্ভব। শ্রমিকরা ছাড় দিয়ে এগিয়ে না এলে টিকে থাকা জটিল। এক্সিটের সুযোগ পেলে আমি বের হয়ে যেতে চাই। আমরা এক্সিট পলিসির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলে আসছিলাম। সরকারও বলছে তৈরি হচ্ছে। এখন দেখি কী হয়। কী পরিমাণ কারখানা বসে যাবে, এটা বলা জটিল। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপটেই এক্সিট প্ল্যান থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের সরকারেরও এক্সিট প্ল্যান বাস্তবায়নের সক্ষমতা কতটুকু থাকবে, সেটাও ভাববার বিষয়।

পোশাক শিল্পে নিট খাতের প্রতিনিধিরা বলছেন, প্রতি দুর্যোগের পরই দেখা গেছে কিছু উদ্যোক্তাকে খাত ছেড়ে চলে যেতে হয়, এবারো তাই হবে। বর্তমান দুর্যোগটা পুরোপুরিই বৈশ্বিক। এখন পর্যন্ত খাতের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে করোনার ধাক্কায় বেশ কিছু না হলেও কিছু কারখানা বন্ধ হবেই। কারণ অনেককে আগে থেকেই সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। কারখানা চালাতে হলে অনেক ধরনের ব্যয় বহন করতে হয়। এখন কোনো ক্রেতার পরিশোধযোগ্য দাম সময়মতো আসবে না। আর ছোট কারখানাগুলোর ব্যাংকিং সহায়তাও শক্তিশালী হয় না। বড় কারখানাগুলো কিছুটা হলেও ব্যাংকের সহযোগিতা পাবে। সংকট শেষ হয়ে গেলে শুধু বাংলাদেশে না সারা বিশ্বেই অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। করোনার ধাক্কা যেসব দেশে বড় করে লাগবে বিশেষ করে চীন, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক দেশগুলোতে অনেক কারখানা বন্ধ হবে।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে অস্থিরতা, এছাড়া সার্বিক প্রেক্ষাপটে চীনে পণ্য উৎপাদন থেকে সরে আসার একটা প্রবণতা আছে, যেটা আমাদের জন্য বড় সম্ভাবনা হয়ে ধরা দেবে। কিন্তু তার পরও সবাই তো ইতিবাচক হয়ে বসে থাকবে না। অনেকে হিসাব কষে দেখবে মার্কেট অনেক ছোট হয়ে আসছে, সে কারখানা বিক্রি বা অন্য খাতে রূপান্তরে অন্য ব্যবসায় চলে যাবে। কিন্তু ব্যবসা বড় হয়ে গেলে ইচ্ছা থাকলেও বের হয়ে আসাটাও সহজ হয় না। আসন্ন বাজেটেও তাই সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা আছে যে যারা ব্যবসায় টিকে থাকতে পারছে না তাদের জন্য একটা এক্সিট পলিসির বিষয়ে জোর দেয়ার। সার্বিক প্রেক্ষাপটে কিছুসংখ্যক কারখানা শিল্প থেকে মুছে যাবে। অর্থাৎ করোনার প্রভাবে খাতের কিছু ব্যবসায়ী হয় বসে যাবে, নয়তো সরে যাবে। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে ব্যবসায় নতুন করে কেউ আসবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন