মহাকাশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের প্রতিযোগিতা, ভূরাজনৈতিক দখলদারিত্বের লড়াই, প্রতিরক্ষা ও সমরকৌশলে অগ্রসরতার দাম্ভিক প্রকাশ, অর্থনীতি ও বাণিজ্যে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ে কতই না দ্বন্দ্ব দেখল বিশ্ব। এবার কভিড-১৯ মহামারীর ক্রান্তিকালে নতুন এক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে প্রযুক্তি ও গবেষণায় এগিয়ে থাকা দেশগুলো। আর তা হলো নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির অস্থির প্রতিযোগিতা।
করোনার প্রতিষেধক তৈরি নিয়ে বৃহস্পতিবার তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। অন্যদিকে ফ্রান্স তো ওষুধ প্রস্তুতকারক সানোফিকে হালকা করে বকুনিই দিয়েছে। কত বড় সাহস! নিজের খেয়ে আবার পরের গুণগান গায়! ফরাসি কোম্পানি হয়েও বলে কিনা প্রতিষেধক তৈরি করতে পারলে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম চালান সরবরাহ করবে।
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। জনস্বাস্থ্যের এ অপূরণীয় ক্ষতি তো রয়েছেই, মহামারীটি আরেক দিক থেকে আমাদের পঙ্গু করে দিচ্ছে। আর তা হলো অর্থনীতির ভিতকে দুর্বল করে দেয়া। করোনার অর্থনৈতিক প্রভাবটি একটি চক্রাকার শৃঙ্খল। ভাইরাসটির সামাজিক সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন জারি করা হয়েছে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে। এতে প্রায় পুরো বিশ্বই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমেছে। ব্যয় সংকোচনের নীতির কারণে কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে কোটি কোটি। ফলে মানুষও আয়হীন হয়ে পড়ছে। আর আয় না থাকার অর্থ চাহিদারও পতন, যা ব্যবসা-বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এ স্থবিরতা যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সে লক্ষ্যে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন বিজ্ঞানীরা। তা না করে উপায়ও নেই। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ কিংবা এশিয়া—দেশে দেশে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনগুলো লকডাউন প্রত্যাহার ও শিথিল করে নিচ্ছে, যেন মানুষ আবার কাজে ফিরতে পারে। কিন্তু বিধিনিষেধ শিথিল করা কিংবা মানুষজনের চলাচল বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো সংক্রমণের দ্বিতীয় জোয়ার তৈরির ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণাগার ও বেসরকারি বায়োপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে, যেন প্রতিষেধকের সঠিক ফর্মুলা খুঁজে বের করা যায়।
ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ) কিছুটা আশার বাণী শুনিয়েছে বটে। তারা বলেছে, এক বছরের মধ্যেই একটি প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব হবে। অবশ্য তা চলমান মেডিকেল ট্রায়ালের সফলতার ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে। ইএমএর ভ্যাকসিন স্ট্র্যাটেজির প্রধান মার্কো ক্যাভালেরি বলেছেন, তারা যে সময়সীমার কথা বলছেন, তা পরিস্থিতি অনুকূলে থাকার ওপর নির্ভরশীল। যদি পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়, তবে প্রতিষেধক পেতে আরো দেরি হবে বলে জানান তিনি।
প্রতিষেধক তৈরির প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আরো রসদ জুগিয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের উত্পত্তি চীনে। বুধবার দুই মার্কিন সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, চীনা হ্যাকাররা কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণার ফলাফল চুরির চেষ্টা করছে। এর জবাবে বেইজিং বলছে, এ দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। এতে তাদের সম্মানহানি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন অভিযোগের কারণে চীনের আঁতে ঘা লাগাটাই স্বাভাবিক। এমনিতেই করোনার উত্পত্তি ও তা বৈশ্বিক রূপ ধারণের পেছনে চীনকেই দায়ী করছে মার্কিনরা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো শপথই নিয়ে ফেলেছেন, যে করেই হোক চীনকে শায়েস্তা করা হবে। এতে বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ আরো জটিল আকার দারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র না হয় একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। কিন্তু ফ্রান্স তো নিজেদের কোম্পানিকেই খুব করে বকে দিয়েছে। বিষয়টা একটু খোলাসা করা যাক:
বৃহস্পতিবার একটি স্মারক প্রকাশ করা হয়, যাতে স্বাক্ষর করেছেন ১৪০ জন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বৈশ্বিক প্রভাবশালী নেতাও রয়েছেন। তারা সবাই মনে করছেন, করোনার প্রতিষেধকে নির্দিষ্ট কারো স্বত্ব থাকা উচিত নয়। এছাড়া প্রতিষেধক তৈরির বিজ্ঞানও সবার মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার সুযোগ থাকা উচিত।
আর এমন এক সময়ে সানোফি ঘোষণা দিয়েছে, তারা প্রতিষেধক আবিষ্কারের পর প্রথম চালানটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ রাখবে। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী পল হাডসন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কার্যকর রিস্ক শেয়ারিং মডেল। এর ফলে ওষুধ প্রশাসনের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা যায়। কিন্তু ইউরোপে এ সুবিধা নেই। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রেই প্রথম চালান সরবরাহের কথা বলেছে সানোফি।
কিন্তু এ ঘোষণায় চটেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও তার প্রশাসন। প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, যেই কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করুক না কেন, তা বিশ্বজনীন ব্যবহার্য হতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো বাজার ব্যবস্থার চাপের কাছে মাথা নত করা চলবে না।
