প্রাণি ও মানুষের আহার জোগাচ্ছে ‘অবিনাশ বাঙলা’

বণিক বার্তা অনলাইন

রাত ১০টা। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড। কৃষি মার্কেটের সামনের সারাবছর রাত অব্দি ভীড় লেগে থাকা সরব এক গলি। করোনাকালে তা নিস্তরঙ্গ। সে গলিতে রাতের আলোছায়ায় সামাজিক দূরত্ব মেনে পাত্র হাতে লাইনে দাঁড়িয়েছে কিছু অসহায় মানুষ। একে একে তাদের পাত্রে তুলে দেয়া হচ্ছে খাবার। রোজার দিনে সেহরির জন্য।

যারা মোহাম্মদপুর ও আশেপাশের এলাকার বাসিন্দা তাদের কাছে প্রিয় তাজমহল রোডের একটি রেস্টুরেন্ট। নাম তার 'মজা'। ধানমন্ডি, মিরপুরসহ অন্য এলাকার অনেকেও রেস্টুরেন্টটির নাম জানেন। মজা‌'র সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাবার অনেকেরই পছন্দের। সে মজা রেস্টুরেন্ট থেকে এভাবেই প্রতিদিন তাজমহল রোড ও আশেপাশের এলাকার শতাধিক মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। রোজায় দেয়া হচ্ছে সেহরির খাবার। রোজার আগে, করোনাকাল শুরুর দিকটাতে দেয়া হতো দুপুরের খাবার। এপ্রিলের ৪ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ধারাবাহিভাবে চলছে এ কার্যক্রম।

করোনাকালে আহার জোগারের কষ্টে থাকা মানুষের জন্য এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে 'অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশন' নামের একটি সংগঠন। তাদের বিতরণ করা রান্না করা খাবার তালিকায় থাকে সবজি-খিচুড়ি বা ডাল-ভাত। ডাল-ভাতের সঙ্গে থাকে মাছ অথবা মুরগি বা সিদ্ধ ডিমের ঝোল। আবার কোনোদিন থাকে গরুর মাংসও।

এ কার্যক্রমের উপকারভোগী, স্থানীয় রাশেদা নামের একজন জানান, তিনি ফুটপাতে চা বিক্রি করতেন। দুই মাস ধরে বেচাকেনা বন্ধ। ছিলনা জমানো কোনো টাকা। ঘরে ছিলনা খাদ্য-সঞ্চয়। তাদের দেয়া এ খাদ্য-সহযোগিতা না পেলে এই সময় পরিবার নিয়ে দিন পার করা অনেক কষ্ট হতো। হয়তো না খেয়েই কাটতো তাদের দিন।

চলছে ইফতার কার্যক্রম ও প্রাণির খাবার

উদ্যোক্তারা জানানা, লকডাউনের ফলে ঘরবন্দি মানুষ। ভাসমান ব্যবসায়ী ও খেটে খাওয়া মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে । তাদের অনেকেই দৈনিক খাবারটুকুও জোগাড় করতে পারছেন না। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের আশেপাশের এরকম ৪০টি পরিবারের ১৪৪ জন সদস্যের জন্য সেহরি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অবিনাশ বাঙলা।

পরিবারের শতাধিক সদস্যদের জন্য প্রতিদিনের রান্না করা খাবার জোগাচ্ছে অবিনাশ বাঙলা। অতিরিক্ত খাবারটুকু দেয়া হয় আহারের কষ্টে থাকা পথচলতি মানুষদের। পাশাপাশি রমজানে এসব পরিবার যাতে নিজেরা ইফতার তৈরি করতে পারে, তার জন্য রোজার শুরুতেই তাদের জন্য ছোলা, পেঁয়াজ, মুড়ি, তেলসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বিতরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এর বাইরেও স্বপ্নপুরী নামে আরেকটি সংগঠনের সহযোগিতায় পাশের তিন মহল্লার আরও শতাধিক পরিবারের মধ্যে ইফতার তৈরির উপযোগী খাদ্যপণ্য দেয়া হয়েছে।

এর আগে করোনাদুর্যোগের শুরুতেই, ৪ এপ্রিল থেকে রোজা শুরু পর্যন্ত অবিনাশ বাঙলা এলাকার হতদরিদ্র ২০ পরিবারের ১০০ জনের জন্য করোনাকালের “মধ্যাহ্ন ভোজ-১০০” কার্যক্রম পরিচালনা করে।

সম্প্রতি উদ্যোগটির আশেপাশের অঞ্চলের কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্স, করোনাকালের এসব সম্মুখযোদ্ধাদের সম্মানে দেয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত ইফতার প্যাক। এ কার্যক্রমে অবিনাশ বাঙলা প্রতিদিন ১০০ জন নার্স ও ডাক্তারের জন্য এ ইফতারের আয়োজন করছে। এ ইফতার প্যাকের মধ্যে থাকে পর্যাপ্ত দুধ-চিড়া,প্যাকেট-চিনি, ২টা চাপাকলা ও ৪টা খেজুর। সঙ্গে এক বোতল পানি।

করোনাকালে মানুষের পাশাপাশি খাবারের জন্য ছটফট করছে রাজধানীর মুক্ত প্রাণিরাও। বিশেষ করে, মাঝেমধ্যই রাস্তার কুকুরগুলোর কান্না ও চিৎকার শোনা যায়। তাজমহল রোডের কয়েকটি গলির কুকুরদের জন্যও সীমিত পরিসরে খাবারের ব্যবস্থা করছে অবিনাশ বাঙলা। প্রতিদিন রাতে এলাকার কয়েকটি স্পটে এসব কুকুরদেরকে খাবার দেয়া হয়।

তবুও ঈদ হোক রঙিন

যতোই হোক করোনাকাল, ঘরে হলেওতো ঈদের দিনটা পালিত হবেই। সে হিসেবে যে পরিবারগুলোর জন্য প্রতিদিনকার খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে, ঘরবন্দি অন্যান্য মানুষের মতো তাদের পরিবারেও যেন জুটে সামান্য সেমাই বা মিষ্টান্ন, কিংবা সবাই মিলে একবেলা খেতে পারেন মাংস-পোলাও, অবিনাশ বাঙলা সে চিন্তাও করছে বলে জানান এর উদ্যোক্তারা। ঈদের আগে পরিবারগুলোর মাঝে, সেমাই, চিনি, গুড়ো দুধ, পোলাও চাল ও মুরগি দেয়ার পরিকল্পনা করছেন তারা। পরিবারের বাচ্চাদেরকে খুশির জন্য ও আনন্দিত করতে দেয়া হবে চকোলেট।

অসহায়-অবহেলিতের পাশে

এই কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করলে উদ্যোগটির প্রধান ব্যক্তি ও রেস্টুরেন্টটির স্বত্বাধিকারী কবি সাদাফ হাসনাইন মানজুর জানান, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুধু আমার পেশা নয়, নেশাও। আমার প্রতিষ্ঠান 'মজা'র মাধ্যমে মানুষকে স্বাস্থ্যকর খাবার তুলে দেয়ার এই কাজটি আমি দীর্ঘদিন যাবত করছি। শুধুমাত্র মুনাফা করা কখনোই আমার উদ্দেশ্য ছিলনা। কিন্তু যখন করোনাকাল শুরু হয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্ন বিবেচনা করে আমি কর্মচারীদের আগাম বেতন দিয়ে ছুটি দিয়ে দিই এবং রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দিই।

তিনি বলেন, আমাদের বন্ধু ও সমাজকর্মী, স্থানীয় নবোদয় সংঘের সভাপতি নুরুল ইসলাম শাহেদ, সমাজকর্মী রাসেল মাহমুদসহ, আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, এনজিও কর্মী, এমন বেশ কয়েকজন মানুষ ও বন্ধু, আমরা কয়েকজন মিলে অসহায় মানুষের জন্য কিছুটা করার পরিকল্পনা করছিলাম। একটা ফাউন্ডেশন গঠন করে কার্যক্রমটা শুরু করা ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যেই হানা দিল করোনাদুর্যোগ। দিনে আনি দিন খাই মানুষের কষ্টেরও হতে লাগলো শুরু। এই অবস্থায় আমরা দেরি না করে কাজে নেমে পড়ি। অবিনাশের কার্যক্রমে আমার রেস্টুরেন্টের অবকাঠামো ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিই। কয়েকজন কর্মীকে করোনাকালের উপযুক্ত সম্মানী দিয়ে ফিরিয়ে আনি, তারা রান্নার কাজে নিয়োজিত হয়। সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন উদ্যোগের অংশ স্বেচ্ছাকর্মীরা। 

তিনি বলেন, সীমিত সাধ্যের মধ্যে এই দুর্যোগে আমরা তিন ধরনের মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছি। এক. যারা প্রকৃত অর্থেই অভাবী, দুই. যারা অভাবের কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন এবং তিন. যারা পথের মানুষ। জানানো হয়, তাদের এ কার্যক্রমে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন দেশে-বিদেশে থাকা তাদের পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও স্বজনরাও। কেউ দিয়েছেন নগদ অর্থ, কেউ দিয়েছেন চাল কিংবা কেউ দিয়েছেন পেঁয়াজ, রসুন, তেল। তাছাড়াও নানান শ্রেণী-পেশার মানুষ উদ্যোগী হয়ে এ কার্যক্রমে আর্থিক সহযোগিতা করছেন। বিশেষ করে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের দেয়া অর্থ-সহযোগিতা এই কর্মসূচিকে আরও বেগবান করছে। তাছাড়া সহযোগিতার পরিমাণ আরো বাড়লে এ কার্যক্রমের পরিসরও আরও বড় করার পরিকল্পনা আছে বলে তারা জানান।

এ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় করোনা-উত্তর কালেও অবহেলিত ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবেন, তাদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-মানসম্মত খাবার ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে পারবেন- এমন আশাবাদ ও প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন এর উদ্যোক্তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন