কভিড-১৯ বিশ্বকে এখন নতুন এক পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। এর আগে কখনই আমরা অন্যের স্পর্শে আসার আগে এতগুলো উপায়ের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম না। এখন আমাদের চিরচেনা অভ্যাসগুলোর ব্যাপারেও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। যেমন হাত মেলানো কিংবা দরজা খোলা।
এটা করতে হয়েছে কারণ শারীরিক নৈকট্য ভাইরাসের বিস্তার ঘটাতে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে হাত মেলানো কিংবা জড়িয়ে ধরার মতো সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে এটি হয়ে থাকে। এছাড়া কাশি এবং কোনো বস্তু যদি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত থাকে, সেটি স্পর্শের মাধ্যমেও হতে পারে।
এখনই এসব যোগাযোগের ফলাফল হচ্ছে বৃহৎ ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। অনেকটা ফেসবুক যেভাবে আমাদের সামাজিক যোগাযোগগুলো ম্যাপ করে সে রকম। এখন সেই ব্যাপক নেটওয়ার্ককে বন্ধ করে দেয়া কিংবা দুর্বল করে দেয়া হতে পারে শারীরিক দূরত্বের বিধি বজায় রাখার মূল চাবিকাঠি। যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এখন সারা দুনিয়া যাচ্ছে।
এখন আমাদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে আমরা লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসব সেটি। এখন যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে গিয়ে ভাইরাসের পুনরুত্থান ঠেকানো। অনেক প্রস্তাব বলছে, হার্ড ইমিউনিটির জন্য লকডাউন অব্যাহত রাখা যতক্ষণ পর্যন্ত না চিকিৎসা অথবা ভ্যাকসিন না আসে।
আমরা একদল গণিতবিদ ও অর্থনীতিবিদের অংশ, যারা কিনা এলোমেলো ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির মডেলিংয়ে বিশেষজ্ঞ। আমরা এমন একটি কৌশল প্রস্তাব করেছি, যেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো যাবে এবং পরবর্তী সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কমানো যাবে। এটা মূলত উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন দলকে সীমাবদ্ধ রাখার অন্যান্য ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
আমাদের সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া প্রস্তাব দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত সবুজ জোন খুঁজে বের করা। অর্থাৎ যেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নীতি কার্যকর, সংক্রমণের হার কম এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকিও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। দ্বিতীয়ত, নিরাপদ হওয়ার পর ধীরে ধীরে একযোগে এখানে যোগ দেয়া।
জোনিং
লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানুষকে আলাদা করে সাব-নেটওয়ার্কগুলোতে ভাগ করা। যার মাঝে চলাফেরা থাকবে সীমায়িত। যদিও এ জাতীয় বিভাজন বেশ দূরে।
ফ্রান্সে সবাইকে বলা হয়েছে নিজেদের ঘরের এক কিলোমিটারের
মধ্যে থাকতে। যদিও এ ধরনের নিয়ম ভাইরাসকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে। কিন্তু এ ভাইরাস নেটওয়ার্কের মধ্যে ঠিকই পরিভ্রমণ করতে পারে। প্যারিসে দুজন ব্যক্তি দুই কিলোমিটার দূরত্বে থাকলেও দুজন ব্যক্তির একই মুদি দোকানে কেনাকাটা করার সম্ভাবনা আছে।
ফ্রান্সের মতো প্রত্যেকের জন্য গতিবিধির ব্যাসার্ধের এ নিয়ম কার্যকর না করে, আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে মানুষকে যেন সংযোগবিচ্ছিন্ন অঞ্চলে যাতায়াতের অনুমতি দেয়া হয়। তখন এটা আরো ভালো কাজ করবে। অবশ্যই এ ধরনের বিভাজন একই শহরের পৌরসভার মাঝে আরোপ করার চেয়ে দুটি আলাদা শহরের মাঝে করা অনেক বেশি সহজ। কিছু জোনের মধ্যে এ বিভাজন নীতি আইনগতভাবে প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে।
এ ধরনের জোনিংয়ের নীতি সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারছে চীনের অনেকগুলো অঞ্চল। যেখানে আলাদাভাবে উহানের নাম বলতে হয়। এটা বিভিন্ন অঞ্চলের মাঝে যোগাযোগ হ্রাস করে এবং অঞ্চলগুলোর মাঝে ভাইরাসের বিস্তার লাভ করাকে প্রতিহত করে। যদিও সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বন্ধ করা সম্ভব নয়, কারণ অনেক প্রয়োজনীয় কর্মীকে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতে হয়। আবার অনেকেই নিয়ম মানতে চায় না।
সবুজ জোন তৈরি করা
সবুজ জোনিংয়ের এ প্রক্রিয়া আমাদের জীবনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। এখন ভাইরাসের অনিবার্য আংশিক পুনরুত্থান নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত স্প্যানিশ অর্থনীতিবিদ জোয়ান মোনারসের একটি পদ্ধতির কথা বলছি। যেখানে প্রথমে তিনি স্থানীয় শ্রমবাজার খোলার কথা বলেছেন। যে অঞ্চলে উচ্চ পর্যায়ের যাতায়াত রয়েছে। কিন্তু নিজেদের অঞ্চলের বাইরে খুব কম।
আমরা পরামর্শ দিয়েছি প্রত্যেক দেশকে ৫ হাজার থেকে ১ লাখ বাসিন্দাসহ ভৌগোলিকভাবে ভাগ করা উচিত। অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানোর জন্য এটাকে ‘যাতায়াত অঞ্চল’
হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ জোনগুলো অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ভাগ করে দেবে।
প্রতিটি সেল হয় সবুজ অথবা লাল চিহ্নিত করা থাকবে। যা করা হবে মূলত কভিড-১৯-এ তাদের বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে। লাল সেলে পরিস্থিতি হবে লকডাউনের মতোই। স্বাস্থ্য সুরক্ষার নীতি, দোকান খোলার বিধিনিষেধ, বাসা ছাড়ার যেসব বিধিনিষেধ তা বলবৎ থাকবে। কেউ যদি এক জোন থেকে অন্য জোনে যেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই বিশেষ সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হবে। এটা কেবল গুরুত্বপূর্ণ কর্মী ও জরুরি কারণে দেয়া হবে। বিপরীতে সবুজ জোনের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকবে।
ধরা যাক ১০ হাজার জনগোষ্ঠীর একটি অঞ্চল। যেখানে অনেক মানুষ স্থানীয় ফ্যাক্টরিতে কাজ করে অথবা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত। একবার যদি ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং কোনো নতুন আক্রান্তের খবর না আসে তবে নোবেল লরিয়েট পল রোমার বলেছেন সেটিকে সবুজ করে দেয়া যাবে। তখন এর জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। কেবল ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। এক সপ্তাহ পর যখন আর ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকবে না তখন ছোট অংশের সেই বাসিন্দারা সবুজ জোনের অংশ হতে পারবে। এভাবে বড় ধরনের সবুজ জোন তৈরি করা সম্ভব।
পদ্ধতির গভীরতা
সবুজ জোনের আকার কখনো বাড়বে, আবার কখনো কমবে যার ফলে পুনর্মিলনের এ পদ্ধতি কিছুটা ক্লান্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের গবেষণা বলছে, যখন নতুন সংক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তখন এ এ প্রক্রিয়াও দ্রুত স্বাভাবিক হতে থাকবে। আমাদের পদ্ধতি অনুসারে যুক্তরাজ্যের মতো দেশ দুই থেকে চার মাসের মাঝে পুনঃসংযুক্ত হতে পারে। সবুজ জোন তৈরির এ প্রক্রিয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাস করে যত দ্রুত সম্ভব সমাজকে পুনঃসংযুক্ত করবে। এছাড়া এটি আরো কিছু ইতিবাচক সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করবে।
স্ক্রলডটইন থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ