করোনার কার্যকর ওষুধ বা ভ্যাকসিন না পেলে বিকল্প কী?

জাহাঙ্গীর আলম

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, করোনার ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক পেতে এক বছর অপেক্ষা করতেই হবে। এমনকি ‘অব্যর্থ প্রতিষেধক’ না-ও পাওয়া যেতে পারে। করোনা থেকে সেরে ওঠা বরিস এর আগে ‘হার্ড ইমিউনিটি’-র পক্ষেও কথা বলেছিলেন। এই মুহূর্তে ধাপে ধাপে লকডাউন তোলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে বলে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।

যাইহোক বরিস জনসনের বক্তব্যে হতাশা স্পষ্ট। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে তারা আশাব্যঞ্জক অনেক তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছে। 

করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও সংক্রমণ বিস্তার অনেক দেশেই কমে গেছে। এমনকি সংক্রমণ লেখ আনুভূমিক হয়ে গেছে অনেকেরই। এই সফলতা কিন্তু কার্যকর ওষুধ বা ভ্যাকসিনের কল্যাণে আসেনি। অবশ্য আসলে কীভাবে এ সাফল্য এসেছে সেটিও সুনির্দিষ্ট করে বলার মতো কোনো গবেষণা নেই। 

তারপরও বলা যায়, এটি হয়েছে ওষুধের কার্যকারিতার কারণে নয় বরং ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেমন কোয়ারেন্টিন, সামাজিক দূরত্ব, হাত ধোয়া, এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের বাধ্যতামূলক মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করার মাধ্যমে।

আমরা আশা করছি, ২০২১ সালের মধ্যে ভ্যাকসিন আসবে। ভ্যাকসিন না আসার মাঝখানের সময়টা আমরা কী করছি, এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো দুর্ভাগ্যবশত কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার চেষ্টা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা কী করবো? এর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা।

বলতে গেলে গোটা বিশ্বই কার্যকর ওষুধ এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ওপর বাজি ধরেছে। এইটা জরুরি তবে সেই সঙ্গে ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থা (নন-ড্রাগ ইন্টারভেনশন) আরো কীভাবে লক্ষ্য নির্দিষ্ট এবং উন্নত করা যায় সেদিকেও গবেষণা বাড়ানো উচিত। কারণ এখন পর্যন্ত এই ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থাই কাজের বলে প্রমাণিত। 

কিন্তু এসব নিয়ে এখনও কিছু মৌলিক প্রশ্নে বিতর্ক বরং বাড়ছে, ঐকমত্যে কেউ আসতে পারছে না। বিশেষ করে ফেস মাস্ক সর্বসাধারণকে পরতে হবে কিনা; শারীরিক দূরত্ব (যদিও ভুলভাবে সামাজিক দূরত্ব বলা হচ্ছে) ১, ২ নাকি ৪ মিটার হবে; সাবান নাকি স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে হবে এসব নিয়ে তর্কের শেষই হচ্ছে না।

এদিকে ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণেই সংক্রমণ কার্ভ ফ্ল্যাট করা সম্ভব হচ্ছে এমন দাবি করা হলেও এ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা কিন্তু খুব অল্পই হয়েছে। 

সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য নিয়ে এখন পর্যন্ত যতো গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাত্র ৪০ শতাংশের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব গবেষণাও কিন্তু ওধুষ তৈরি ও পরীক্ষার চেয়ে খুব কম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে।

চলমান কভিড-১৯ মহামারীকালেও এই দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়নি। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সরকার, সংস্থা ও কোম্পানি করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং সম্ভাব্য ওষুধ পরীক্ষার পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। ওষুধ ও ভ্যাকসিন নিয়ে কয়েকশ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলমান। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থার হাতেগোনা কয়েকটি পরীক্ষা হয়েছে। আর এগুলোর উন্নয়ন নিয়ে একটিও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনো চোখে পড়েনি।

সবাই বিশ্বাস করছে যে, ভ্যাকসিনের পেছনে ব্যাপকভিত্তিক প্রচেষ্টা চালালে সাফল্য আসবেই। কিন্তু বহু বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার এইচপিভি ভ্যাকসিনের আবিষ্কারক আইয়ান ফ্রেজার বলছেন, ভ্যাকসিন তৈরি সহজ হবে না, আর এটি যতোটা ভাবা হচ্ছে অতো দ্রুত আসার সম্ভাবনাও কম।

কার্যকর ওষুধ ও ভ্যাকসিন যদি না পাওয়া যায় তাহলে কিন্তু আমাদের ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপরভিত্তি করে ‘প্ল্যা বি’ বা বিকল্প পরিকল্পনা করে রাখতেই হবে। এ কারণেই এ বিষয়টির ওপর অধিকতর গবেষণা করা দরকার। এটির প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে এখই রূপরেখা তৈরি করে রাখাটা জরুরি।

অবশ্য ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থা সরল নয়। এটি বেশ জটিল। হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ বিষয় এবং এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই এমন মনে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ব্যবস্থাই বেশি জটিল হয়। 

ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলোর অ্যাকটিভ কমপোনেন্ট (যেমন হাতধোয়া) ভালোমতো বোঝার পাশাপাশি এটি কতোটা প্রয়োজন সেই মাত্রা সম্পর্কেও সবার পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি। এছাড়া কীভাবে সাধারণ মানুষকে এতে অভ্যস্ত করে তোলা যায় এবং বার্তাটি সহজবোধ্য করে মানুষের কাছে পৌঁছানোর কৌশল নির্ধারণও খুব দরকারি কাজ। 

ভ্যাকসিন বা ওষুধ তৈরির চেয়ে একটি কার্যকর ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থা দাঁড় করানো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়, এমনকি এটি আরো বেশি জটিল।

উদাহরণস্বরূপ সবার জন্য মাস্ক (#Masks4All) ক্যাম্পেইনের কথা বলা হয়। সোজা কথায় সবাইকে মাস্ক পরতে বলা হচ্ছে। কিন্তু এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন উহ্য রয়ে গেছে। যেমন: কোন ধরনের মাস্ক, এটি কী দিয়ে তৈরি, কাদের পরা উচিত- যারা অসুস্থ, অসুস্থদের সেবা করছেন যারা নাকি সবার জন্য? তাছাড়া কখন এবং কোথায় মাস্ক পরতে হবে। এসব বিস্তারিত বিষয় নিয়ে কিন্তু এখনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি।

একইভাবে হাত ধোয়ার বিষয়টিও খুব সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু তা নয়।  কতোবার হাত ধুতে হবে? দিনে ১০ বার অথবা কী কাজ করার পর হাত ধোয়া জরুরি? সাধারণ মানুষকে সঠিকভাবে হাত ধোয়া শেখানোর সবচেয়ে কার্যকর কৌশল কী? মানুষ যদি সঠিকভাবে হাত ধুতে না জানে তাহলে কি তাদের জন্য সাবান-পানির চেয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ভালো? মাস্ক পরা আর হাত ধোয়াই কি করোনা থেকে বাঁচার অধিকতর কার্যকর উপায়?

এরকম আরো অনেক বিষয় আছে। এক কথায় ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা এখনো খুব কমই জানি।

এছাড়া শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় এমন ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে মাস্ক, হাত জীবাণুমুক্তকরণ, চোখের সুরক্ষা, শারীরিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টিন এবং এগুলোর যেকোনো সমন্বিত ব্যবস্থা নিয়ে যতোগুলো গবেষণা এ পর্যন্ত হয়েছে সবকটি বেশ দুর্বল। বেশিরভাগেরই নমুনার মান খুব নিম্ন এবং নমুনার আকার অত্যন্ত ছোট। অনেক ক্ষেত্রে কোনো দৈবচয়ন পরীক্ষাই করা হয়নি।

অন্যান্য ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে যেকটি গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো, তাপমাত্রা, ভেন্টিলেশন, এয়ার কন্ডিশনিং সার্কুলেশন (আবদ্ধ বায়ু প্রবাহ) এবং বস্তুর পৃষ্ঠতল। এর মধ্যে দেখা গেছে, সার্স-কভ-২ ভাইরাস (কভিড-১৯ এর জন্য দায়ী) তামার পৃষ্ঠে অন্যান্য কঠিন বস্তুর পৃষ্ঠের চেয়ে দ্রুত মারা যায়। 

এখন পর্যন্ত জানা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কোনটি কার্যকর আর কোনটি অকার্যকর এটি কিন্তু আমরা জানি না। এট এখন জানা জরুরি কারণ আমাদের হাতে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই।

সংক্রামক ব্যাধির মহামারীর মতো সময় যখন মানুষের আচরণ পরিবর্তনটা খুব দ্রুত ও ব্যাপকভিত্তিক দরকারি হয়ে ওঠে তখন অসঙ্গতিপূর্ণ ও বিরোধপূর্ণ বার্তা সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং এই আচরণগত পরিবর্তন আনার চ্যালেঞ্জকে আরো কঠিন করে তোলে।

আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। এই মহামারীই তো শেষ নয়। কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন না হয় আবিষ্কার হলো কিন্তু আবার কোনো ভাইরাসজনিত মহামারী এলে কী হবে? ভ্যাকসিন খুবই ভাইরাস-নির্দিষ্ট। কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন অন্য কোনো রেসপিরটেরি ভাইরাসে কাজ করবে না। তার মানে নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে আবার একই পরিস্থিতি তৈরি হবে। এখানেই ওষুধবিহীন প্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরুত্ব। কারণ এখন এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা সম্পর্কে যদি আমরা পরিষ্কার প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান পাই তাহলে তা অন্য সব ধরনের ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে বলেই আশা করা যায়। তখন নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা করার মূল্য এতোটা দিতে হবে না। ২০০৩ সালের সার্স এবং ২০০৯ সালের সোয়াইল ফ্লু থেকে শিক্ষা নিলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

অবশ্য অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এরই মধ্যে কিছু বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়া চীন এরই মধ্যে চালু করেছে। তারা রঙিন কিউআর কোডের প্রচলন করেছে। লাল, হলুদ আর সবুজ এই তিন রঙের কিউআর কোড ব্যবহার করা হচ্ছে। যাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে, সন্দেহভাজন বা জীবাণু থাকলেও উপসর্গ নেই অথবা জ্বর আছে তাদের দেয়া হচ্ছে লাল কোড। এদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের হলুদ আর এই ডাটাবেজের বাইরে যারা তারা পাচ্ছেন সবুজ কোড। প্রত্যেকের সেলফোনে থাকছে এই কোড। সবুজ কোডধারীরা ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারছেন।

 ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানককও যেসব ব্রিটিশ করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে গেছেন তাদের ইমিউনিটি সার্টিফিকেট বা রোগ প্রতিরোধ সনদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর ওদিকে চিলি এই সনদ দেয়া শুরুই করেছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের সনদ না দিতে সতর্ক করছে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম

আরো পড়ুন:

করোনা ‘ইমিউনিটি পাসপোর্ট’ নিয়ে কাজে ফিরবে মানুষ!

নতুন ঝড়ের প্রস্তুতি না নিলে বিপদ


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন