২০২০-২১ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট

বাস্তবায়ন সক্ষমতা নেই স্বাস্থ্য খাতে কমছে বরাদ্দ

সাইদ শাহীন

নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক-নার্স-টেকনিশিয়ান সংকট ছাড়াও অবকাঠামো প্রযুক্তিগত নানা দুর্বলতা উঠে এসেছে। রয়েছে কারিগরি অদক্ষতা পরীক্ষাগারের অপ্রতুলতা। এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে দরকার বড় বিনিয়োগ। কিন্তু নিয়ে যৌক্তিক পরিকল্পনা না থাকায় ঠিক কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে তা চাইতেই পারে না সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। আবার বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা ব্যয়ও করতে পারে না তারা। কারণে প্রয়োজন হলেও বাস্তবায়ন সক্ষমতা থাকায় আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ কিছুটা কমছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। স্বাস্থ্য সেবা খাতের বিভাগ মন্ত্রণালয় নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলাকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ হাজার ৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল। তাদের প্রত্যাশিত অর্থের পরিমাণ সংকটকালীন আগের সময়ের বরাদ্দের চেয়েও অনেক কম। সংকটে কী ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটি হয়তো সঠিকভাবে অ্যাসেসমেন্ট করতে পারেনি স্বাস্থ্য খাত। তার পরও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কিছুটা উদার হয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রেখেছে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। এতে আগের তুলনায় বরাদ্দ কমছে ২২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। -সংক্রান্ত একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় কমিটিতে সেটির প্রাথমিক অনুমোদন পেতে পারে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সেটি সঠিক সময়ে ব্যয় হয় না। এডিপির জাতীয় বাস্তবায়ন হারে বেশ নিচের দিকে থাকে স্বাস্থ্য খাত। গত তিন অর্থবছরে প্রায় হাজার ২৮১ কোটি টাকার প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারেনি খাত। স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগটি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে একসঙ্গে ছিল। সেই বছরে বাস্তবায়নহীন ছিল ৯৩৯ কোটি টাকা। ৬১টি প্রকল্পে হাজার ১২১ কোটি টাকার বিপরীতে ব্যয় হয়েছিল হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। দেশের সার্বিক অর্জন প্রায় ৯৩ শতাংশ হলেও স্বাস্থ্য খাতে অর্থবছরে অর্জন ছিল ৮১ দশমিক শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অব্যয়িত ছিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ৭১১ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগে ২৫৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অব্যয়িত ছিল ৯৬৮ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর জাতীয়ভাবে ৯৪ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হলেও স্বাস্থ্য খাতে বাস্তবায়ন ছিল ৯০ শতাংশের নিচে। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে অব্যয়িত ছিল হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ৯২৭ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের ৪৪৭ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন হয়নি। ওই অর্থবছর জাতীয় বাস্তবায়ন হার ৯৫ শতাংশ হলেও স্বাস্থ্য খাতে তা ছিল ৮৬ শতাংশ।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আগের চেয়ে আরো বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের দুটি বিভাগে এডিপি বাস্তবায়ন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৬ দশমিক ৭১ শতাংশ, যেখানে জাতীয় বাস্তবায়ন হার প্রায় ৪৫ দশমিক শূন্য শতাংশ। চলতি অর্থবছর স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট ৪৩টি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। সেখানে নয় মাসে ব্যয় হয়েছে হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বিভাগে ১৪টি প্রকল্প বরাদ্দ ছিল হাজার ৩৩০ কোটি টাকা, তবে ব্যয় করতে পেরেছে ৫৮১ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের পরামর্শক সাবেক লিড ইকোনমিস্ট . জাহিদ হোসেন বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকলে বরাদ্দ দিলে সেটার অপচয় অপব্যয় হবে। আবার এটাও সত্য, স্বাস্থ্য খাতের যে কী ধরনের ভঙ্গুর অবস্থা রয়েছে, সেটি করোনা পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়ে গেছে। তাই শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে বরাদ্দ বাড়ালে হবে না। একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। সেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে লিড দিয়ে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এবং বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে দুই ধরনের বিনিয়োগ এখনই বাড়াতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানের করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে চলতি বিনিয়োগ ব্যয় এবং কাঠামোগত সংস্কারের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ব্যয় বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য খাতের মাধ্যমে দেশের অবস্থার উন্নতি হলেই কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পর্যটন রেমিট্যান্সের সুযোগগুলো দ্রুত কার্যকর করার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ।

পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে জাতীয় বাজেটে দেশের মোট জিডিপির শূন্য দশমিক শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তা জিডিপির দশমিক শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব ছিল। করোনার কারণে খাতে বরাদ্দ জিডিপির দেড় থেকে শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হচ্ছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) যদিও চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা পরিবার কল্যাণ খাতে ৭৮টি প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ১০৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে হাজার ৯২৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তবে গত অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় বরাদ্দ কমেছে।

পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. নূরুল আমিন বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, এখনো এডিপি চূড়ান্ত করা হয়নি। মঙ্গলবার (আজ) বিষয়ে একটি জাতীয় মিটিং করা হবে। পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে সেখানে সব মন্ত্রণালয় বিভাগের বরাদ্দের খসড়া চূড়ান্ত হবে। আমরা এডিপি যখন সংশোধন করি, তখন এটিই মূল এডিপি হিসেবে বিবেচিত হয়। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বেশ বাড়ছে। এমনকি মন্ত্রণালয় যা চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেয়া হচ্ছে। কেননা করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য কৃষি খাত বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রয়োজনে সেটিও আরো বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিত বরাদ্দ রাখা হয়েছে লাখ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত মূল এডিপির আকার লাখ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। ফলে আগামী অর্থবছরে মূল এডিপির আকার বাড়ছে মাত্র দশমিক শতাংশ।

 

 এডিবি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের দক্ষতা

বিভাগ/মন্ত্রণালয়                    ২০১৯-২০ ( মাস)               ২০১৮-১৯              ২০১৭-১৮             

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ  বাস্তবায়নের হার (%)            ২৬.৭১   ৮৮.৭৮  ৮৯.৬৬

                জাতীয় অগ্রগতি (%)             ৪৫.০৮   ৯৪.৬৬  ৯৪.০২  

                প্রকল্প সংখ্যা          ৪৩ টি     ৫০          ৪৭          

                বরাদ্দ (কোটি টাকা)               ,৯৩৬  ,২৬১   ,৮৭১  

                ব্যয় (কোটি টাকা,৩৩৪   ,৩৩৪   ,১৬০ 

স্বাস্থ্য শিক্ষা

পরিবার কল্যাণ

বিভাগ     বাস্তবায়নের হার (%)            ২৪.৯৪    ৭৫.৫১   ৮৫.৮৬

                জাতীয় অগ্রগতি (%)             ৪৫.০৮   ৯৪.৬৬  ৯৪.০২  

                প্রকল্প সংখ্যা          ১৪           ১৫          ১৫         

                বরাদ্দ (কোটি টাকা)               ,৩৩০  ,৮২৪    ,৮১৯   

                ব্যয় (কোটি টাকা৫৮১       ,৩৭৭    ,৫৬২  

                 মোট অব্যয়িত (কোটি টাকা)                               ১৩৭৪     ৯৬৮     

 

সূত্র: আইএমইডি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন