থমকে আসা খেলার মাঠে ফিরে আসুক প্রাণের স্পন্দন

অনজন কুমার রায়

সেদিন ফেসবুকে  চোখ বুলাতেই হঠাৎ দেখতে পেলাম, সহকর্মী তুলসী দা নিজের ছেলের ছবি পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, "Come Back Freedom"। ভাবি, শিশুদের সাথে বন্দিত্বের শিকল বেমানানই বটে।

আমরা না হয় মোবাইল কিংবা টিভি সার্ফিং করে অবসর সময়ুকু পার করি, কিন্তু ছোট খোকা বা কিশোর ছেলেরা অবসর সময়ে প্রিয় খেলা উপভোগ না করে কিভাবে সীমাবদ্ধতার মাঝে দিনগুলো অতিবাহিত করবে।

পাড়ার যে ছেলেগুলো এতদিন হৈ-হুল্লোড় করে এ পাড়া থেকে ও পাড়া দাপিয়ে বেড়াতো আজ তারাই ঘরের কোণে বন্দি দশায় দিন পার করছে। অথচ খেলা ধূলার মাঝেই খোঁজে পাওয়া যায় নিরাপদ জীবন বিকাশের উন্মুক্ত বিশালতার স্থান।

আট নয় বছরের শিশুটি সকাল বেলা আধো আধো ঘুম চোখে নিয়ে স্কুলে গেলেও বন্ধু বান্ধবদের দেখে ঘুমের চটকা কেটে যায় এক নিমিষেই। কিন্তু; এখন স্কুল বন্ধ, কোন বন্ধু -বান্ধবের দেখা পাওয়াও ভার। আগমনী বসন্তের বিচিত্রতা কোন দিকে যেন হারিয়ে গেল ক্ষণকালের জন্যও বুঝতে পারছে না সীমাবদ্ধতার কতকথায়। সেজন্যই হয়তো অবারিত আনন্দের ধারায় ছেদ পড়ে আছে। আনন্দের বিহ্বলেই তারা ছাড়িয়ে যেত সীমানার ওপাড়ে। এখন যে আর আনন্দটুকু তাড়া করে না। মাঠ থাকলেও খেলার কোন আভাস নেই, নেই কোন উচ্ছ্বাসের ঘনঘটা। শুধু প্রাণোচ্ছ্বল মনটাকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখা হয়েছে। নির্মল বিনোদনের মাঠটি কেমন যেন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। তাই বয়স্কদের মাঝেও আজ মলিনতার ছাপ।

যে ছেলে গুলো সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে সারা পাড়া মাতিয়ে রাখতো, তারাও আজ কেমন যেন নি:সঙ্গতায় হারিয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকেই শুনতে পেতাম শিশুদের খেলার ছন্দ:

ইচিং বিচিং চিচিং ছা, প্রজাপতি উড়ে যা।

কিংবা-

লাইলি লুইলি বাঁশের চোঙ, বাঁশ কাটলে টাকা থোং।

এত টাকা নেবো না, লাইলির বিয়া দিব না।

মাঠ থেকে কানে আসে না ফুটবল খেলায় রেফারির বাঁশি। যে ছেলেগুলো খেলার জন্য মাঠে দৌঁড়ে আসতো এখন ফুটবলের শব্দ শুনে তাদের আর বিকালে ঘুম ভাঙে না। নিস্তব্ধতায় বারবার ফিরে আসে সীমাবদ্ধতার মাঝে বন্দি জীবন। নির্ভীকতায় সাহস যুগিয়ে পাড়ার যে ছেলেটি দাপিয়ে মাঠ বেড়াতো, সেই মাঠেও অনুপ্রাণিত করার জন্য কেউ ছুটে আসে না। প্রতিবছর একটি টুর্নামেন্টের কত-শত আয়োজন করে মাঠ উজ্জ্বীবিত করে রাখতো বালকেরা। কয়েকটি ক্লাবও প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু এ বছর বল আর মাঠে গড়ায় না। সেখানে কেউ খেলার অনুভব করে না।

এক সময়ের হৈ-হুল্লোরে মাঠটি যেন ঝিমিয়ে পড়েছে, মনে হয় বয়সের ভাড়ে আজ ন্যুব্জ। কেউ হয়তো অন্য গ্রামের সাথে খেলায় জিতে নিজ গ্রামে ট্রফিটা নিয়ে আসে না।

তড়িঘড়ি করে কেউ হয়তো এখন আর এক্কা-দোক্কা খেলার জন্য দাগ টানে না কিংবা কপালে একটি ছোট গুটি ধরে চোখ বুজে হেঁটে হেঁটে দাগানো ঘরগুলো পার হওয়ার চেষ্টা করে না। খেলায় জয়ের ভাগ নিতেও ঝগড়ায় মেতে উঠে না। মনে হয় নিজেই গুটি নিয়ে পুরনো দাগের উপর নতুন দাগ টেনে পাড়ার সকলকে খেলার জন্য একবার আহ্বান করি।

পাড়ার যে ছেলেগুলো ক্রিকেট খেলায় মত্ত থাকতো; স্ট্যাম্প, ব্যাট, বল হাতে তাদের আর দেখা যায় না মাঠে যেতে। যে "How's that" শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করতো অনেকদিন যাবৎ আর ধ্বনিত হয় না। চার ছক্কা হাকিয়ে কেউ দলকে জেতাতেও মাঠে আসে না।  ক্রিকেট মাঠের পিচটি কেমন যেন মনের কোণে একরাশ অভিমান নিয়ে কয়েকটা ঘাসের সাথে আলিঙ্গনে লিপ্ত হয়ে আছে। ঘরের মাঝে রাখা ক্রিকেট স্ট্যাম্পগুলোয় ধূলো জমে ময়লা হয়ে আছে। হয়তো মাকড়সার জালের মলিনতার ছাপ নিয়ে পড়ে আছে দরজার ও পাশে ক্রিকেট ব্যাটটি।

বসন্তের বাতাবরণে পাতা ঝরা শব্দ দু একবার প্রকৃতির হেয়ালীপনায় জেগে উঠলেও কেমন যেন নি:সঙ্গতার আঁধারেই পতিত হয়। ঝিঁ ঝিঁ পোকাও কেমন যেন স্তিমিত হয়ে আছে। তাদের শব্দটুকুও আর ছন্দ জাগিয়ে আসে না। চৈত্রের খরতপ্ত দুপুরটা কেমন জানি নিজেকেই নিজে সামলিয়ে রেখে এক নিস্তব্ধতায় নেমে এসেছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলোকে নিয়ে দিয়াশলাইয়ের মাঝে রেখে কতনা গান শুনতে দেখেছি পাড়ার ছেলেগুলোকে । এখন আর তারা গান শুনতে গাছের মাঝে ঝিঁ ঝিঁ পোকার উপস্থিতি খোঁজে ফিরে না।

দেখেছি; শিমুল ডালে পাখির কোলহল, কৃষ্ণচূড়ার গাছে অজস্র ফুল। ডালে চড়ে ফুলের থোকাগুলো ভেঙ্গে নিয়ে ছোট বোনকে দেয়ার জন্য কলরবে কেউ মেতে উঠে না। ফুলগুলো শুকিয়ে নিচেই পড়ে থাকে।

মনের মাঝে ছন্দটুকু আর ফিরে আসে না। যেন স্নিগ্ধ পরশের আভাসটুকু থেকে সবাই দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।

মনে হয় হা ডু ডু খেলায় দাগ টেনে দিয়ে বলছে, ওদিকে আসতে মানা। মনের অজান্ততেই সবাইকে ব্যবচ্ছেদ করে দিয়েছে। তাই ঘরের বাইরে যেতে ওদের মানা। তর না সইতে পেরে  মা-বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতে আসছে দু'একজন। কিন্তু খেলোয়াড়ের অভাবে খেলা আর সরগরম হয়ে উঠে না। নিস্তব্ধতায় একাই ফিরে যাচ্ছে মাঠের কোণ থেকে। মাঝে মাঝে মাঠের ভিতর কয়েকটি গরু ছাগলকে ঘাস খেতে দেখা যায়। দু একটা পাখি কিংবা ফড়িং তাদের উপরে বসে খেলা করে।

ফাঁকা মাঠে বাতাস থাকলেও ঘুড়ি উড়ানোর শখটুকু কয়জনই বা মেটাতে পেরেছে। হয়তো কেউ কেউ ঘুড়ি বানিয়ে উড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু সীমাবদ্ধতার কণ্টকাকীর্ণ পথে কি আর কেউ দৌঁড় দেবে।কাগজের প্লেন বানিয়ে দুধের স্বাদটুকু ঘোলে মিটিয়ে ফেলার প্রয়াসে চালিয়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে বিমানের আনাগোনা খোঁজে বেড়ায়। শুধু দু'একটি পাখি দেখেই সীমাবদ্ধতার হ্রাস টেনে ধরে। মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা তারা গুলো গুনে গুনে সময় পার করে। আবার খেলার সাথী ঐশ্বর্যের আনাগোনা না পেয়ে ঘুমের মাঝে খেলার খেলার ছলে ডেকে উঠে ছোট মামমাম।

এক সময় ঘুড়ি উড়ানোর উল্লাসটুকু দেখে আমিও আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে নিতাম। এখন আর কেউ নাটাই নিয়ে দৌঁড়ে মাঠের দিকে এগিয়ে আসে না। মাঝে মাঝে নাটাই থেকে ঘুড়িটি ছিঁড়ে গেলে আনমনা হয়ে আমার কাছে ফিরে আসতো ছোট বালকদের দল। সেবার সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, আমি তোমাদের ঘুড়ি বানিয়ে দিবো। এখন আর কেউ ঘুড়ি বানাতেও বায়না ধরতে আসে না। এখানেই স্থবিরতায় মনটা যেন ছেয়ে আসে বারংবার।

অভিভাবকদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও লুকোচুরি করে মার্বেল খেলার প্রতি অদম্য আকর্ষণ ছিল গ্রামীন কিশোরদের। আজ মার্বেলের শব্দ নিরবেই অতীত হয়ে আছে। বাবা বাজারে যাওয়ার সময় ছোট ছেলেটি কানে কানে মার্বেলের কথা বলতে সাহস পায় না। 

দেখেছি পাড়ার ছেলেগুলো একসাথে  পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাতার কাটতে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ পুকুর পাড়ে এসে পদ্মপাতাগুলো দেখে আনমনা হয়ে চলে যায়। অভিমানে হয়তো পুকুরটির উপরে শ্যাওলা জমে সবুজাভ বর্ণ ধারণ করে আছে।

সন্ধ্যা হলে পাড়ার ছেলেরা একসাথে হাত-পা ধূয়ে বাড়িতে ফিরতো। হৈ-হুল্লোড়ে পাড়ার রাস্তাগুলো মাতিয়ে রাখতো। আজ কেমন যেন নিস্তব্ধতার গ্লানি এসে ভর করেছে পাড়ায় পাড়ায়। 'জিতেছি জিতেছি' বলে কেউ আর আওয়াজ তুলতে আসে না। কেউ রাঙানো মুখে হাসিটুকু দিয়ে বলতে আসে না, "আমরা জিতে গেছি"।

কলা গাছের ভেলাটি পুকুরে পানির ঢেউ লেগে এপাশ থেকে ওপাশে আসে। কিন্তু, দলবদ্ধভাবে পুকুরে পানিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে চোখ লাল করতে কাউকে দেখতে পাওয়া ভার।

গুলতি হাতেও ব্যস্ত সময় পার করতে কাউকে দেখা যায় না।

আনন্দে ছেদ পড়ে কেমন যেন তাড়া করে বেড়ায় সকালে সূর্যোদয়।

ভাবি, আবার প্রাণ ফিরে আসবে প্রাণোচ্ছ্বল ছেলেগুলোর মাঝে। ঘুড়ির নাটাই নিয়ে দৌঁড়াবে মাঠের পর মাঠ। ছেলেবেলায় মত্ত থাকবে পাশের বাড়ির ছোট ছোট বালকেরা। ভ্যাবাছ্যাকা হয়ে খেলা দেখতে থাকবে পাশের বাড়ির রুদ্দুরের  দাদু। একগুচ্ছ শাপলা ফুল কুড়িয়ে এনে ছোট বোনটিকে এক গাল মধুমাখা হাসি দিয়ে বলবে, শাপলা ফুলের বিল থেকে কুড়িয়ে এনেছি। ঝিঁঝিঁ পোকার পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে দু'একটা ঝিঁঝিঁ পোকা আধমরা করে দিয়াশলাই বাক্সের ভিতর রেখে তারা ঝিঁঝিঁ পোকার গান শুনতে থাকবে কিংবা দুটি দিয়াশলাই বাক্সের ভিতর ক্যাবল ঢুকিয়ে এক প্রান্ত থেকে একজন অপর প্রান্ত থেকে আরেকজন বলবে, হ্যালো পৃথিবীটা আগের মত সচল হয়ে আছে।

অনজন কুমার রায়

রূপালী ব্যাংক লি:
বন্দর বাজার শাখা, সিলেট। 
ই-মেইল: [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন