কভিড-১৯

সংক্রমণ রোধের প্রশিক্ষণই নেই ৮৬% নার্সের

নিহাল হাসনাইন

ছোঁয়াচে কভিড-১৯ রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে তাদের সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। কিন্তু দেশের ৮৬ শতাংশ নার্সেরই নেই সংক্রমণ রোধের ইনফেকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (আইপিসি) প্রশিক্ষণ। এমনকি বেসরকারি কিছু হাসপাতালে নার্সদের আইপিসি পদ থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলোয় তা একেবারেই নেই। ফলে ক্রমেই বাড়ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, আইপিসি ট্রেনিং হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার সর্বজনীন শৃঙ্খলা, যা রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংক্রমণের শৃঙ্খল, সংক্রমণভিত্তিক সতর্কতা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও রোগীদের সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে সহায়তা করে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আইপিসি টিমে একজন আইপিসি ডাক্তার ও একাধিক আইপিসি নার্স প্র্যাকটিশনার থাকেন। কিছু দেশে শুধু আইপিসি নার্স প্র্যাকটিশনাররাই এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে আইপিসি প্রশিক্ষণে জোর দেয়া হয়। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, আইপিসির মাধ্যমে ৭০ শতাংশ সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব। তবে অনেক দেশে নিজস্ব গাইডলাইন ও পলিসি রয়েছে। এটা নির্ভর করে আইপিসি কমিটি বা আইপিসি প্র্যাকটিশনারের ওপর। 

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, ১০০ বেডের বিপরীতে প্রতি শিফটে কমপক্ষে একজন আইপিসি নার্স প্রয়োজন। সাধারণত হাসপাতালের চিকিত্সক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার থেকে শুরু করে সব কর্মীকেই আইপিসি ট্রেনিংয়ের আওতায় আনা হয়। আইপিসি টিমের প্রধান কাজগুলো হচ্ছে হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা-সম্পর্কিত সংক্রমণের নজরদারি করা এবং প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। পাশাপাশি প্রাদুর্ভাব ও মহামারীর সময় সংক্রমণের তদন্ত করা এবং একটি ক্লিনিক্যাল পরামর্শমূলক পরিষেবা সংশোধন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা।

এছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সবাইকে নিয়মিত ইন-সার্ভিস ট্রেনিং প্রদান করার কাজটিও আইপিসি টিমের দায়িত্ব। এর বাইরে হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংক্রামক ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো খুঁজে বের করা এবং জীবাণুমুক্তকরণের স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সংক্রমণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ ঝুঁকি থেকে নিরাপদ রাখা আইপিসি টিমের অন্যতম দায়িত্ব।

স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, হাসপাতাল কম্পাউন্ডে কোনো রোগী এলেই তাকে প্রথমে জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। এই কাজটি করে থাকেন ওয়ার্ড বয়রা। পরবর্তী সময়ে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিত্সক ওই রোগীকে দেখে প্রাথমিক নির্দেশনা দেন। এরপর শুরু হয় নার্সদের কাজ। ওই রোগীর পরীক্ষা করানো থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন নার্সরা। অথচ বাংলাদেশে কর্তব্যরত নার্সদের অধিকাংশেরই নেই আইপিসি প্রশিক্ষণ। এমনকি ইউনাইটেড, স্কয়ার, এভারকেয়ারের মতো বেসরকারি হাসপাতালে আইপিসি নার্সিং পোস্ট থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলোয় তা নেই। 

নার্সদের নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটি (বিবিজিএনএস) ও সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস নামের দুটি সংগঠন। চলতি মাসে সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে পরিচালিত অনলাইন জরিপে উঠে এসেছে নার্সদের আইপিসি প্রশিক্ষণের ঘাটতির চিত্রটি। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও এনজিওতে কর্মরত ৫৬৮ জন নার্স ওই জরিপে অংশ নেন। এর মধ্যে আইপিসি প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কথা জানান ৪৯০ জন নার্স, যা জরিপে অংশ নেয়া নার্সের ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ।

এর আগে গত ১৯ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছয়দিনব্যাপী আরেকটি অনলাইন জরিপ পরিচালনা করে নার্সদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন দুটি। ওই জরিপে অংশ নেন ৭০৫ জন নার্স। তাদের মধ্যে ৬১৩ জনই আইপিসি প্রশিক্ষণ পাননি বলে জানিয়েছেন, যা মোট অংশ নেয়া নার্সের ৮৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এসব নার্সের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৮ শতাংশ নার্সই পরিপূর্ণ ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ বা পিপিই সেট ব্যবহার করেন না। 

আইপিসি গাইডলাইন মতে, হ্যান্ড হাইজিনিং, রেসপিরেটরি হাইজিনিং, পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), সেফ ইনজেকশন প্র্যাকটিস, অকুপেশনাল হেলথ সেফটি, পোস্ট-এক্সপোজার ম্যানেজমেন্ট, প্যাসেন্ট কেয়ার ইকুইপমেন্ট ও এনভায়রনমেন্টাল কন্ট্রোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মাধ্যমে সার্বজনীন সতর্কতা নিশ্চিত করা। এনভায়রনমেন্টাল ক্লিনিং, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, ফিউমিগেশন, যন্ত্রপাতি পরিষ্কার পদ্ধতি এবং জীবাণুমুক্তকরণ পদ্বতির মাধ্যমে কোয়ালিটি নিশ্চিতকরণও তাদের গাইডলাইনের অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়া ফুড হ্যান্ডলিং প্র্যাকটিস, সঠিক নিয়মে খাবার তৈরি এবং বণ্টন, রান্নাঘরে কীটপতঙ্গ দূরীকরণ, খাদ্য ব্যবস্থাপনায় কোয়ালিটি নিশ্চিতকরণের বিষয়টিও রয়েছে আইপিসি গাইডলাইনে। রয়েছে বায়োমেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সঠিক নিয়মে বর্জ্য সংরক্ষণ, সঠিক নিয়মে বর্জ্য পরিবহন ও তা নিষ্পত্তির পদ্ধতিও। এর বাইরে স্বাস্থ্যসেবা-সম্পর্কিত সংক্রমণ, অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যাবহার ও লন্ড্রি ম্যানেজমেন্টও আইপিসি গাইডলাইনের অন্তর্ভুক্ত।

প্রত্যেক নার্সেরই আইপিসি প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এ জরিপের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমি মনে করি প্রত্যেক নার্সেরই আইপিসি প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। বিশেষ করে চলমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই এ প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। আশা করি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তব্যরত নার্সদের এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। 

সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের হিসাবমতে, এরই মধ্যে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৪৭২ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ৩৩২ ও বেসরকারি হাসপাতালে ১৪০ জন। ঢাকায় ৩৭৩ জন, ময়মনসিংহে ৪৪, সিলেটে ১৫, রংপুরে ১১, খুলনায় ১১, বরিশালে ৬, চট্টগ্রামে ৪ ও রাজশাহীতে ৮ জন। 

সংগঠনটির মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ তিহান বলেন, করোনার মতো সংক্রামক রোগীর সেবায় শুরু থেকেই জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সম্মুখভাগের যোদ্ধা নার্সরা। অনেক ক্ষেত্রে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংকটের কারণে নার্সদেরই কভিড-১৯ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অথচ বেশির ভাগ নার্সেরই আইপিসি ট্রেনিং নেই। এজন্য তারা দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছেন। আইপিসি ট্রেনিংয়ের অভাবে পিপিইর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এভাবে নার্সরা সংক্রমিত হতে থাকলে স্বাস্থ্য খাত ভেঙে পড়তে পারে। তাই নার্সদের সুরক্ষা ও ট্রেনিং নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। 

আইপিসি ট্রেনিং চিকিত্সকদেরও থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিত্সকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রশাসক ডা. নিরুপম দাস। তিনি জানান, চিকিত্সকদের কোনো প্রকার পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের মতো সংক্রমণ মোকাবেলার আগে চিকিত্সকদের শতভাগ আইপিসি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। কিন্তু এখন সংকটের কথা বলে কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত কভিড-১৯-এ আক্রান্ত চিকিত্সকের সংখ্যা ৬৫৪। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৪৭ জন।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন