বন্দর থেকে উধাও পণ্যগুলো ছিল নিলামের অপেক্ষায়, ঘটনা তদন্তে কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কৌশলে বের করে নিয়ে যাওয়া পণ্যগুলো বছরাধিককাল ধরে নিলামের অপেক্ষায় ছিল। বন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের জাল কাগজপত্র দেখিয়ে একটি বৈধ চালানের সঙ্গে কৌশলে খালাস করা হয়েছে সেই পণ্য।  পণ্য খালাসের পর কনটেইনারটি সিলগালা করা হয় খায়েজ আহমেদ নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে। এমন তথ্যই জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। 

সেই সঙ্গে নিরাপত্তা বিভাগের উপপরিচালক মেজর মো. রেজাউল হককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যদের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশে দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর এবং চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, চীন থেকে গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি এক কনটেইনার কাপড়ের চালান আমদানি করে ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডার আমদানিকারক কেমস ফ্যাশন লিমিটেড। নথিপত্রে গড়মিল থাকায় চালানটি খালাস করা হয়নি। পরে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিলামে তোলার জন্য কাস্টমসের কাছে হস্তান্তর করে।  কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেটি সময়মতো নিলামে তোলেনি । এটিই উধাও হয়ে যাওয়া পণ্যের কন্টেইনার।

এক বছর তিন মাস আগে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করে বেশ কিছু চালান আমদানি হয়েছিল যার একটি হলো এই উধাও হয়ে যাওয়া চালানটি । পরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে নতুন কমিশনার যোগদানের পর অনিয়মের ব্যপারে কঠোর হলে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও খালাস নিতে পারছিল না সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট।

ঘটনার আরো অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২২ এপ্রিল রাতে এই চালানটি জাল কাগজপত্র দেখিয়ে খালাস করে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ঠিকানার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আরএম অ্যাসোসিয়েটস । অন্য এক আমদানিকারকের বৈধ চালানের সঙ্গে কৌশলে কাপড়ের চালানটি দুটি কাভার্ডভ্যানে করে খালাস নেয় তারা। এই একই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কেমস ফ্যাশন লিমিটেডের আমদানি করা ওই কাপড়ের চালানটি খালাসের দায়িত্বেও ছিল। 

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আরএম অ্যাসোসিয়েটস গত ২২ এপ্রিল ছয়টি কাভার্ডভ্যান নিয়ে বন্দরে প্রবেশ করে। এর মধ্যে চারটি কাভার্ডভ্যানে নেয়া পণ্যের আমদানিকারক লুক্রেটিভ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সল্যুশন। এই বৈধ আমদানিকারকের আনা পণ্য চারটি কাভার্ডভ্যানে সব নিয়ম মেনেই নেয়া হয়েছে । বাকি দুটি কাভার্ডভ্যানে তারা তুলেছে নিলামের অপেক্ষায় থাকা সেই ৪০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনারের (এমএসকেইউ-০১০৮৫৭৮) মালামাল। এরপর খালি কনটেইনারটি সিলগালা করে রেখে যায়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো.ওমর ফারুক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, খালি কনটেইনার সিলগালা দেখে বন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের সন্দেহ হয়েছিল । বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নিরাপত্তা বিভাগ থেকে দুটি গাড়ির চালককে ফোন করে বন্দরে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকেও জানানো হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ কৌশলে যোগাযোগ করে চান্দিনা থেকে একটি গাড়ির চালককে ফিরিয়ে আনলেও অন্য গাড়ির চালক পণ্য নিয়ে পালিয়ে যায়। ফিরে আসা গাড়ির চালক পণ্যসহ বন্দর থানায় হেফাজতে রয়েছে । এরপরই বন্দর থেকে পণ্য খালাস নেয়ার বিষয়টি কাস্টমসকে জানানো হয়েছে । এ ঘটনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানায়, খালাসের জন্য সারিবদ্ধ লাইন থেকে কনটেইনার খুঁজে বের করে নামায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। তখন কাস্টমসের উপস্থিতি থাকতে হয়, যেটি এক্ষেত্রে ছিল না । কনটেইনারটিতে আমদানি করা পণ্যের বিপরীতে কাস্টম হাউসে কোনো শুল্ক পরিশোধ করা হয়নি। আর শুল্ক পরিশোধ ছাড়া পণ্যের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পণ্য খালাসের উদ্দেশ্যে কনটেইনার নামানোর অনুমতি দেয়ার বিধান নেই । নিয়ম অনুযায়ী বন্দর থেকে পণ্য বের হওয়ার আগে অনেকগুলো নিরাপত্তা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় । 

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার (এআইআর) নূর এ হাসনা সানজিদা অনসূয়া বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতারক চক্রটি আরেকটি বৈধ চালানের সঙ্গে এই চালানটি অবৈধভাবে খালাস করে নেয়। আমরা জালিয়তিটি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি । শুল্ক-কর পরিশোধ ছাড়া খালাসের উদ্দেশ্যে কনটেইনারবাহী পণ্য নামানোর কোনো বিধান নেই, যেটা এক্ষেত্রে করা হয়েছে । প্রাথমিকভাবে প্রতারক চক্রের সঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা পেয়েছি । সার্বিক তদন্ত করে রাজস্ব ফাঁকি ও চোরাচালানের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে । থানায় আটক থাকা গাড়িটিও আমরা ইনভেন্ট্রি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

তবে পণ্য খালাসের সময় কাস্টমস প্রতিনিধির উপস্থিত না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমদানি রফতানি পণ্য নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষের ।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, যে পণ্যটি বন্দর থেকে প্রতারণা করে খালাস করা হয়েছে সেটির আমদানি নথিতে শতভাগ রফতানির উদ্দেশ্যে কাঁচামাল হিসেবে ফেব্রিক্স আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়েছে । গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় ।  ঢাকার সবুজবাগে ৩৭৬, দক্ষিন বাড্ডা (লেভেল-৭) ঠিকানার কেমস ফ্যাশন লিমিটেড ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ৮/৫০৫০, লাকি প্লাজা (৫মতলা) ঠিকানার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আরএম অ্যাসোসিয়েটস এই পণ্য আমদানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রায় দেড় বছর পর প্রতারণা করে ওই পণ্য খালাস করে নিয়ে গেছে। এ কারণে  এই দুই প্রতিষ্ঠান এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বলে মনে করছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

>> চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা পণ্য উধাও


>> চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য উধাও, দুই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন