সরকারি ক্রয়ে গড়িমসিতে ফড়িয়াদের উত্থান

ধানের দাম পাচ্ছেন না হাওড়ের কৃষক

সাইদ শাহীন ও আল আমিন

কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চলতি বোরো মৌসুমে প্রতি মণ ধান হাজার ৪০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। সে অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল থেকে ধান কেনার কথা থাকলেও তা এখনো শুরু হয়নি হাওড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে। সরকারের ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে এমন গড়িমসির সুযোগ নিচ্ছেন ফড়িয়ারা। অর্থের প্রয়োজনে সরকার ঘোষিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষককে।

হাওড়ের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদনকারী জেলা সুনামগঞ্জে এবার লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে মূল হাওড় বা নিচের জমিগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশের ধান কাটা হয়েছে। তবে সেই ধান ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারছেন না জেলার কৃষকরা। অঞ্চলভেদে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে ৭০০-৮৫০ টাকা খরচ হলেও ওই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ৬০০-৭৫০ টাকায়। সে হিসাবে সরকার ঘোষিত দুই-তৃতীয়াংশ দামও পাচ্ছেন না অঞ্চলের কৃষক।

সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় গতকাল বিক্রি হওয়া ধানের দামের তথ্য সংগ্রহ করেছে বণিক বার্তা। জেলায় সর্বোচ্চ দাম এখন তাহিরপুর উপজেলায়। উপজেলার শনির হাওড়ের কৃষক গোলাম সারোয়ার জানান, তাহিরপুরে গত সপ্তাহের তুলনায় ধানের দাম একটু বেড়েছে। প্রতি মণ ধানের দাম ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনার হাওরের কৃষক আকবর হোসেন জানান, সেখানে প্রতি মণ ধানের দাম এখন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওড়ের কৃষক সোহেল তালুকদার জানান, শুরুর দিকে সেখানে প্রতি মণ ধান ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হলেও চলতি সপ্তাহে তা ৭৫০ টাকা উঠেছে। অন্যদিকে ধরমপাশা উপজেলায় প্রতি মণ ধান ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কৃষকরা জানান, সরকারের ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের বিলম্বের কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। লটারি কিংবা আনুষ্ঠানিকতা মেটাতে গিয়ে জেলা ধান ক্রয় কমিটি এখনো ধান ক্রয় শুরুই করতে পারছে না। এই সুযোগে ফড়িয়ারা কম দামে ধান কিনছেন। আর কর্তন খরচ মেটানো ঋণ পরিশোধের প্রয়োজনে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক।

সুনামগঞ্জের শনির হাওড়ের কৃষক গোলাম সারোয়ার বলেন, প্রায় ১০ দিন হলো ধান কাটা শেষ করেছি। গত সপ্তাহে ধানের দাম ৫৫০ টাকা পর্যন্ত ছিল, গতকাল তা ৬৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। ঘরে  তো ধান রাখতে পারছি না। শ্রমিকের খরচ দিতে হবে। ধান কাটার ব্যাপারী খরচও মেটাতে হবে। তারা চাপ দিচ্ছে। এদিকে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেছি। তার টাকা দিতে দেরি হলে সুদ গুনতে হবে। নিজের পরিবারের খরচ চাহিদা মেটানোর কথা বাদই দিলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। এখন যে দামে ধান কেনাবেচা চলছে সে দামে বিক্রি করলে তো মহালোকসানে পড়তে হবে।

এদিকে সরকারি সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হলেও নিজেরা সরাসরি ক্রয়কেন্দ্রে ধান দিতে পারবেন কিনা নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে সুনামগঞ্জের কৃষকদের মধ্যে। কারণ এরই মধ্যে হাওড় অঞ্চলের প্রভাবশালী মধ্যস্বত্বভোগীরা নানা প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি কার্ড নিয়ে নিচ্ছেন। তারা বেশি দামে ধান কিনে নেবেন, এমন প্রলোভন দেখাচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রের অসৎ কর্মকর্তারা। কৃষকদের মধ্যে আস্থাহীনতাও তৈরি হচ্ছে সরকারের কাছে ধান দেয়া নিয়ে। গত রোববার থেকে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় ধান ক্রয় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি এবং ফড়িয়া-মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট মিল মালিকদের কম দামে ধান কেনার সুযোগ দিতেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তালিকা করতে বিলম্বে করছে বলে অভিযোগ করছেন কৃষকরা।

কৃষক সংগঠক সুনামগঞ্জ জেলা সিপিবির সভাপতি চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, এক একর জমির ধান কাটতে থেকে হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকাও কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে হাজার টাকায় দুই মণ ধান দেয়ার শর্তে এনেছেন। আবার কেউ কেউ সুদেও টাকা এনেছেন। কৃষকরা ধান চাষ করলে কী হবে, সময়মতো তারা বিক্রি করতে পারছেন না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে হাওরের ধান বৈশাখের শুরুতে কেনার দাবি জানিয়ে আসছি। বছর এখনো ধান ক্রয় করতে কৃষকের তালিকা তৈরি হয়নি, যদিও সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল থেকে ধান ক্রয়ের কথা ছিল। সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান ক্রয় বিলম্বিত হলে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। ধরনের নৈরাজ্য মেনে নেয়া যায় না। অন্যান্য বছরের মতো লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার মতো অবস্থা হবে জেলার কৃষকদের।

চলতি বোরো মৌসুমে সারা দেশ থেকে দুই কোটি মণ বা আট লাখ টন ধান কিনবে সরকার। প্রতি মণ ধানের দাম প্রায় হাজার ৪০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে চলতি বোরো মৌসুমে সরকারের কাছে প্রায় হাজার ৮০ কোটি টাকার ধান বিক্রি করবেন সারা দেশের কৃষক। সরকারের ধান কেনা কার্যক্রম ২৬ এপ্রিল রোববার থেকে শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলার কথা। তবে জেলা পর্যায়ে জটিলতার কারণে এখনো শুরু করতে পারেনি ধান সংগ্রহ কার্যক্রম।

জানতে চাইলে খাদ্য সচিব . মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম  বলেন, ধান কেনা কার্যক্রমে কৃষক নন এমন ব্যক্তি কিংবা বোরো আবাদ করেননি এমন কেউ যাতে কোনোভাবেই আসতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ধান কেনার লটারিতে কোনোভাবেই যেন মধ্যস্বত্বভোগীরা আসতে না পারেন, তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত আমন মৌসুমের মতো এবারো কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করা হবে। দ্রুত সব প্রক্রিয়া শেষ করে সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন