বেখেয়ালি ঔদাসীন্যই কি বিপদে ঠেলছে ব্রাজিলকে

বণিক বার্তা ডেস্ক

রিও ডি জেনিরোর রিওসেন্ট্রো কনভেনশন সেন্টারে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি নতুন ফিল্ড হাসপাতালের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯ এপ্রিল। ব্রাজিলের উপকূলীয় প্রদেশটিতে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত ধরনের বেশ কয়েকটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। প্রদেশটিতে রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার কাঁটায় কাঁটায় ১০ শতাংশ। মঙ্গলবার পর্যন্ত শুধু এই একটি প্রদেশেই কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে হাজার ৭০০ জনের বেশি। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬৭০ জনের বেশি লোকের।

রিওসেন্ট্রো কনভেনশন সেন্টারে যেদিন ফিল্ড হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শেষ হয়, সে একই দিন অর্থাৎ ১৯ এপ্রিল ব্রাজিলের ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো রাজধানী ব্রাসিলিয়ার সেনা সদর দপ্তরের বাইরের একটি বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগ দেন। বিক্ষোভকারীরা সে সময় সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের ঘোষিত লকডাউন প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন। বোলসোনারো নিজেও লকডাউনের বিরোধী। কারণে দেশটির সর্বোচ্চ প্রশাসক হওয়ার পরও ধরনের কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন তিনি।

বিক্ষোভকারীদের ভিড় আর ঠেলাঠেলির সামনে দাঁড়িয়ে বোলসোনারো বলেন, আমি এখানে এসেছি, কারণ আমি আপনাদের বিশ্বাস করি। আপনারা এখানে এসেছেন, কারণ আপনারা ব্রাজিলে বিশ্বাস করেন। আমরা কোনো আলোচনায় যেতে ইচ্ছুক না। আমরা এখানে যেটা চাই, সেটা হলো ব্রাজিলের জন্য কাজ করা।

বোলসোনারো যখন সমর্থকদের সামনে বক্তব্য রাখছিলেন, তখন তার মুখে কোনো মাস্ক ছিল না। সে সময় তিনি কাশছিলেন।

টেলিভিশনে সম্প্রচারিত দৃশ্য ব্রাজিলের বর্তমান অদ্ভুত পরিস্থিতিরই প্রতিফলন। যেখানে প্রাদেশিক গভর্নর এবং জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মহামারীর মৃত্যুর মিছিল থামাতে প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে দেশটির নির্বাচিত সর্বোচ্চ শাসক পরিস্থিতিকে আমলেই নিতে চাইছেন না। মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পথে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করছেন তিনি। বোলসোনারোর প্রয়াসের ফলাফল হলো, ব্রাজিল এরই মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যায় সংক্রমণের উত্পত্তিস্থল চীনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল বৃহত্তম। দেশটির জনসংখ্যা ২০ কোটিরও বেশি। এরই মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ব্রাজিলেই। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে ৭৩ হাজার ২৩৫ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে হাজার ৮৩ জনের। অন্যদিকে চীনে গতকাল মৃতের সংখ্যা ছিল হাজার ৫১২ জন।

বোলসোনারো নভেল করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯-কে আখ্যা দিয়েছেন ছোটখাটো ফ্লু হিসেবে। শুরু থেকেই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে গৃহীত সামাজিক দূরত্বের নীতির সমালোচনা করে এসেছেন তিনি। মার্চের শেষ নাগাদ আমাদের সবারই একদিন মরতে হবে মন্তব্য করে ব্রাজিলীয়দের প্রতি কাজে ফেরার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। আদতে শুরু থেকেই সংক্রমণ প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের গৃহীত পদক্ষেপ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের বিপরীতে কথা বলছেন তিনি।

এখন পর্যন্ত ব্রাজিলে সংক্রমণ পরিস্থিতির যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, প্রকৃত চিত্র তার চেয়েও অনেক ভয়ংকর বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট সবার। অন্য অনেক দেশের মতো ব্রাজিলের বৃহৎ আকারে করোনার পরীক্ষা চালানোর সক্ষমতা নেই। দেশটির গবেষকদের আশঙ্কা, যে তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে ব্রাজিলে প্রকৃত সংক্রমিতের সংখ্যা তার চেয়েও কমপক্ষে ১২ গুণ বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নভেল করোনাভাইরাসের পরবর্তী হটস্পট হয়ে উঠতে পারে ব্রাজিল।

পরিস্থিতিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার বদলে আরো জটিল করে তুলছেন জাইর বোলসোনারো। কভিড-১৯ নিয়ে তার বেপরোয়া কার্যক্রম ব্রাজিলের মহামারী ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল করে তুলেছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রতিনিয়তই সক্ষমতা হারাচ্ছে দেশটি। অন্যদিকে মহামারী অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনায় ফেটে পড়েছে বিরোধী দলগুলো। উপরন্তু মহামারীর মধ্যেই বড় ধরনের এক রাজনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিল। জানা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগে বোলসোনারোর বিরুদ্ধে দেশটিতে শিগগিরই তদন্তও শুরু হতে পারে। এর ফলে মহামারী পরিস্থিতির মধ্যেই বড় ধরনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কাও এখন ব্রাজিলের সামনে।

বিষয়ে ব্রাজিলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অলিভার স্টুয়েঙ্কেলের মন্তব্য হলো, মুহূর্তে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক সংকট ব্রাজিল সরকারের মহামারী মোকাবেলার সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। একই সঙ্গে প্রদেশগুলোর গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখাটাও মুশকিল হয়ে পড়বে।

গত সপ্তাহেই ব্রাজিলে আকস্মিকভাবে সংক্রমণের শনাক্তের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু দেশটিতে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছেনি বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) ইনফেকশাস ডিজিজ বিভাগের ক্লিনিকাল পেডিয়াট্রিকস বিষয়ের অধ্যাপক কারিন নিয়েলসেন বলেন, বিষয়টি ব্রাজিলের জন্য ভয়ংকর রকমের দুর্যোগ হয়ে দেখা দিতে পারে। দেশটি এরই মধ্যে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে দেশটিতে চিকিৎসাসামগ্রীর অভাব সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে।

কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে থেকেই দেশটির স্বাস্থ্যসেবা খাত নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত ছিল। দেশটির সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে দেয়া সরকারি ভর্তুকিও এখন আগের তুলনায় অনেক কম। ২০১৫ সালের মন্দার পর দেশটি যে কৃচ্ছ তার পদক্ষেপগুলো নেয়, তার প্রথম বলি হয় দেশটির সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত। অন্যদিকে দেশটির বেসরকারি চিকিৎসাসেবায় প্রবেশাধিকার আছে শুধু সামর্থ্যবানদেরই।

বর্তমান মহামারী পরিস্থিতি দেশটির বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আরো চাপে ফেলে দিয়েছে। দেশটির সরকারি হাসপাতালগুলোয় এখন রোগীর ভিড় বেড়েই চলেছে। বড় শহরগুলোর হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) এখন আসন সংকট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোর মেডিকেল স্কুলের প্রিভেন্টেটিভ মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর হোসে রিকার্ডো আয়ারস বলেন, রক্ষণশীল ফেডারেল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এতে করে খাতটি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অবকাঠামোগত সংকটে ভুগছে বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে আঞ্চলিক বৈষম্যও।

ব্রাজিলের অ্যামাজোনাস প্রদেশের রাজধানী মানাউসে এখন করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেখানকার কবরস্থানগুলোয় এখন খোঁড়া হচ্ছে গণকবর। শহরটির মেয়র ভার্জিলো নিটো বলেছেন, মানাউস এখন আর জরুরি অবস্থায় নেই। মানাউসে এখন যা চলছে, তাকে চূড়ান্ত মাত্রার দুর্যোগ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।

দেশটির প্রাদেশিক গভর্নর মেয়ররা এখন সংক্রমণ ঠেকাতে জনগণকে ঘরে রাখার নীতির প্রয়োগ করছেন। স্বাস্থ্যসেবা খাতকে পুরোপুরি ধসে পড়া থেকে বাঁচাতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বোলসোনারো শুরু থেকেই চলাচলে সীমাবদ্ধতার নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আবার দেশটিতে ঘরে থাকার নীতিরও ঠিকঠাক প্রয়োগ করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

ব্রাজিলে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ছড়িয়েছে সেখানকার সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলো থেকেই। বিদেশে বেড়াতে গিয়ে রোগটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তারা। কিন্তু একবার এসে পৌঁছা মাত্র গোটা দেশেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটির সংক্রমণ। বর্তমানে সংক্রমণের গতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আর এর মূল বলি হচ্ছে দেশটির জনাকীর্ণ বস্তিগুলোর দরিদ্র জনসাধারণ।

ধরনের দরিদ্র জনাকীর্ণ বস্তিগুলোয় সংক্রমণ ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। যেখানে স্বল্প আয়তনের একেকটি ঘরে অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে গাদাগাদি করে বসবাস করে, সেখানে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কোনো পথ নেই। এসব বস্তির অনেকগুলোতেই সুপেয় পরিষ্কার পানির সরবরাহ নেই। নেই স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও। ফলে এসব বস্তিবাসীর কাছে হাত ধোয়ার মতো সাধারণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও বিলাসিতার নামান্তর ছাড়া আর কিছু নয়। সামাজিক দূরত্বের নীতি বা হোম অফিসের মতো বিষয়গুলো সেখানে উচ্চ মধ্যবিত্তেরই একচেটিয়া।

সূত্র: ভক্স

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন