সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন সম্প্রতি গতায়ু হয়েছেন। বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৪ বছর। একেবারে কম নয়। তবে তার ভালো স্বাস্থ্য ও নিরলস কর্মজীবনের বিবেচনায় খুব বেশিও নয়। সরকারি দায়িত্ব থেকে অবসর নেয়ার পরও কর্মহীন ছিলেন না। পত্রিকায় কলাম লিখতেন, ছিলেন টিভি টকশোর এক সদা পরিচিত মুখ। লিখতেন ও সম্পাদনা করতেন বিভিন্ন বই ও সাময়িকী। সমসাময়িক বিষয়ে নিয়ে আয়োজন করতেন সেমিনার। পরিচালনা করতেন প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সদা ব্যস্ত থাকতেন এসব নিয়েই। কিন্তু আকস্মিক অসুস্থতা সূচনাতেই জটিল রূপ নেয়। ১১ দিন রোগে ভোগার পর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। সুদীর্ঘ ও সফল কর্মজীবন ছিল তার। এতে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল বহুসংখ্যক মানুষ। এমনকি ছাত্রজীবনের বন্ধুদের সঙ্গেও তেমন ছাড়াছাড়ি হয়নি। এক বিরাট পরিমণ্ডলে তিনি বিরাজ করছিলেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। এটা কিছুটা দৃশ্যমান হয় তার অসুস্থতার সূচনা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গণমাধ্যমেও পড়ে এর ছাপ। তার মৃত্যুর পরে তো ঢেউ নামে। ধারণা করা হয়, মৃত্যুর পর কারো সম্পর্কে সবাই ভালো কথা বলেন। এটা সর্বত্র সত্য নয়। ড. সা’দতের প্রয়াণের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে, তাকে নিছক প্রথাসিদ্ধ স্মরণ মনে করলে ভুল হবে। সুনির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করে দু-তিনটি মন্তব্য এসেছে, তাতে বলতেই হবে তিনি জীবনে অন্যদের মাঝে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। এটা সব ক্ষেত্রে সবার জন্য সম্ভব হয় না। এটা ড. সা’দতের সাফল্য।
ড. সা’দতের নাম ও খ্যাতি সম্পর্কে অবগত থাকলেও তিনি মন্ত্রিপরিষদের সচিব হওয়ার আগে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। তিনি এই পদে যখন এলেন, তখন আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (এখনকার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) যুগ্ম সচিব। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদটি শূন্য ছিল দীর্ঘদিন। এর দায়িত্বে ছিলাম আমিই। সে সময় প্রায়ই যেতে হতো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত কোনো কোনো সভায়। এতে তার সঙ্গে পরিচয় নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়। সে সময়েই পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হই। দ্রুতই একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বও পেয়ে যাই। সে সময়কালে বিভিন্ন সচিব সভায় তার মেধা ও মননের সঙ্গেও সংযোগ ঘটে। সরকারের কাজ নির্ভুলভাবে দ্রুত করার কিছু পদ্ধতিও লক্ষ করি তার মধ্যে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচ্যসূচির ঘাটতিকে তিনি সরকারের কাজে ভাটা পড়া বলে অবহিত করতেন। সতর্ক করতেন সচিবদের। অনিষ্পত্তিকৃত বিষয়াদি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্ট সচিবদের তিনি তাগিদ দিতেন। মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা তিনি ব্যাখ্যা করতেন প্রায়ই। দুটো সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ দুজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কীভাবে একত্রে কাজ করতে পারেন, এ বিষয়ে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ভাব বিনিময় করতেন। তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব থাকাকালেই দুটো অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকারকে বিবেচনায় নিতে হয়। এতে উন্নয়ন সহযোগীদের সময়াবদ্ধতাও ছিল। এর একটা হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন, আর অন্যটি পাবলিক প্রক্রিউরমেন্ট রুলস ও পাবলিক প্রক্রিউরমেন্ট অ্যাক্ট। আইন দুটোর চূড়ান্তকরণ জাতীয় সংসদে হয়। তবে সচিব সভায় বাছাই ও মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বিশেষ ভূমিকা থাকে। ড. সা’দত সে ভূমিকা পালন করেছেন নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতা দিয়ে।
তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব থাকাকালে সহকর্মীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় দুটো বিধানও করতে সক্ষম হন। তখন সরকারের কর্মচারীদের বেতন ও সুবিধাদি ছিল নেহাত কম। তিনি উদ্যোগ নিয়ে সরকারি বিধান করেন অবসর গ্রহণের পর একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছয় মাস সরকারি বাসায় থাকতে পারবেন। প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মচারী সরকারি সুবিধাও পাবেন সে সময়কালে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার বাসার ক্ষেত্রে ঘটে তার ব্যতিক্রম। নবগঠিত মন্ত্রিসভার কোনো একজন সদস্যকে সন্তুষ্ট করতে আমারই কয়েকজন সহকর্মী অবসরের দুই মাসের মধ্যে আমাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিস দেন। অপব্যাখ্যা দেন সে বিধানের। আমি বাসাটি ছেড়ে দিই। ড. সা’দত তখন পিএসসির চেয়ারম্যান। এ ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হন। কোনো এক সুযোগে এ অনিয়মের মূল উদ্যোক্তা কর্মকর্তাকে তিনি তীব্র ভর্ত্সনা করেছিলেন। এটি ছিল আমার প্রতি তার ব্যক্তিগত স্নেহের পাশাপাশি সরকারি বাসা বরাদ্দসংক্রান্ত সরকারের নিয়মাবলির সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সরকারের নিয়ম থাকা সত্ত্বেও আমি বঞ্চিত হয়েছি। এ বিষয়ে এমন করে কর্মরত কর্মকর্তাদের খুব নগণ্যসংখ্যকের সহানুভূতি আমি পেয়েছি। ড. সা’দতের সহমর্মিতা স্মরণে থাকবে আজীবন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তার দায়িত্ব পালন আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল। সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকলে আমন্ত্রণক্রমে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সহায়ক কর্মকর্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করতে হতো। দেখেছি ড. সা’দত মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে রুলস অব বিজনেসে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। তা করতে গিয়ে তিনি ক্ষেত্রবিশেষে অনড় ভূমিকা নিতেন। তখনকার ডাকসাইটে মন্ত্রিদের কয়েকজনের বিরোধিতার মুখেও তিনি পিছু হটতেন না। বৈঠকে টিকে যেত তার বক্তব্যই। ড. সা’দতের প্রজ্ঞা ও মেধার কাছাকাছি না হলেও আমি মন্ত্রিপরিষদের সচিবের দায়িত্ব পালনকালে অনেকটা তার অনুরূপ ভূমিকা নিতে সক্রিয় ছিলাম। আর অজান্তেই ড. সা’দত ছিলেন এ বিষয়ে আমার শিক্ষক। অবশ্য দুজনের সময়কালটা ছিল সম্পূর্ণ পৃথকধর্মী। ড. সা’দতের কার্যকাল ছিল রাজনৈতিক সরকারের সময়ে। মন্ত্রিসভার কোনে কোনো সদস্য বিধিবিধান সম্পর্কে এতটা নিষ্ঠাবান হওয়ার পক্ষে ছিলেন না। এদিক দিয়ে আমার সময়কালে উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের অনেকেরই পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে এসব বিষয়ে তারা সংবেদনশীল ছিলেন। একটু ধরিয়ে দিলে সঠিক পথে কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো বৈরী পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়নি।
এক এগারোর পরিবর্তনের পর ড. সা’দতকে পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আমি তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এটা ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং সময়। পিএসসি পূর্বকালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি ছিল এর প্রধান কারণ। দেশের গণমাধ্যম সোচ্চার ছিল এর বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রতিবাদে। বিশেষ দাবি ছিল ২৭ বিসিএস পরীক্ষার বাতিল নিয়ে। পিএসসির আগের নেতৃত্ব তড়িঘড়ি ফলাফল প্রকাশ করে নিয়োগের জন্য সার্কুলার সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে সময়কালে করণীয় নির্ধারণ নিয়ে অনেক আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সভায় আমি উপস্থিত থেকেছি। তখনকার নীতিনির্ধারকদের বেশ কয়েকজন ছিলেন প্রশাসনিক কাজে অতীত অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। এর মাঝেও লক্ষ করেছি ড. সা’দত সঠিক ও সময়োচিত কার্যক্রম নির্ধারণে ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। চূড়ান্ত সুপারিশকৃত ২৭ বিসিএসের পিএসসির সুপারিশ ও মৌখিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়। নতুনভাবে নেয়া হয় মৌখিক পরীক্ষা। এতেও আইনগত ও সামাজিক জটিলতা কম হয়নি। এত কিছুর পরেও এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন ড. সা’দত। সব প্রতিবন্ধকতা উতরে নিয়োগের নতুন সুপারিশ আসে। যথানিয়মে নিয়োগও দেয়া হয়। পিএসসি নিয়ে ড. সা’দত শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। এ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে তিনি বিচক্ষণতা নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। শেষ কর্মদিন পর্যন্ত এটা ধরে রাখতে ছিলেন সক্রিয়। সফলও হয়েছেন যেকোনো বিবেচনায়। সরকার পরিবর্তনের পর একটি মহলে বৈরিতার সম্মুখীনও হন, কিন্তু পিছু হটেননি। এজন্য কৃতজ্ঞ জাতি স্মরণে রাখবে তাকে। ড. সা’দত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চাকরি করেছেন অনেকটা রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝে। তার গোছানো কাজের বিপরীতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো বিভিন্ন মহল থেকে। মাঠ প্রশাসন কিংবা সচিবালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষেত্রে তাকে জানানোও হতো না। এসব কারণে প্রশাসনের মান নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনার আধিক্য তিনি ঠেকাতে পারেননি। এজন্য তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের কাছে অপছন্দনীয় ছিলেন, এটা স্বাভাবিক। তবে সমীচীন আর সম্ভব একত্রে চলে না। কারো ক্ষেত্রেই কখনো চলেনি। ড. সা’দতের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আমাদের প্রশাসনিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে এটা অস্বাভাবিকও নয়। তবে তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সর্বোতভাবে সচেষ্ট ছিলেন। তার সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের কিছু বিচ্যুতি উপেক্ষা করা যায়। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, সুযোগ দেয়া হলে প্রসাশনকে তিনি অনেক বেশি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারতেন।
তিনি ছিলেন নিয়মাচারী ও নিষ্ঠাবান। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থ ব্যয়ে তিনি ছিলেন মিতব্যয়ী। তবে যেখানে যেটুকু প্রয়োজন, সে টাকা ব্যয়েও করতেন না কার্পণ্য। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের টাকার অতিরিক্ত খরচ পরিহার করতে তার গৃহীত পদক্ষেপ এখনো অনেকে স্মরণে রাখবে। সর্বশেষে বলতে হয়, তিনি অতিমানব ছিলেন না। তবে ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ, নিষ্ঠাবান, কৌশলী ও দক্ষ আমলা। এসব বিবেচনায় তিনি বিরলই ছিলেন। তিনি জান্নাতবাসী হোন, এ দোয়া রইল।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
