করোনা মহামারী কি সত্যিই পৃথিবীর ক্ষত সারিয়ে তুলছে?

বণিক বার্তা অনলাইন

মহামারী বাঁধিয়ে পৃথিবী তার ক্ষত সারিয়ে নিচ্ছে এমন একটি অনুমান বেশ জোরালো হচ্ছে। অনেকেই তা বিশ্বাসও করছেন এবং প্রকৃতির প্রতি মানুষের অবিবেচক, অবিমৃষ্য ও নির্দয় আচরণের নির্মম প্রতিশোধ বলে বর্ণনা করার চেষ্টা করছেন। এখান থেকে শিক্ষা না নিলে আগামীতে আরো ভয়ঙ্কর মহামারীর কবলে পড়তে হতে পারে বলেও তারা সতর্ক করছেন।

কিন্তু এই অনুমান কি সত্যি? প্রকৃতি কি এমন স্বজ্ঞা ও সচেতন কোনো বস্তু যে নিজে থেকেই প্রতিশোধ নেয় এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নিজের ক্ষত সারিয়ে তোলে? 

এই ক্ষত বলতে মূলত অতিমাত্রায় গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে মেরু অঞ্চলের বরফের গলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনে ঋতুচক্রে ব্যত্যয় ইত্যাদির পাশাপাশি বায়ুদূষণের ফলে মানুষ ও প্রকৃতির ওপর মারাত্মক প্রভাবের কথাই বলা হচ্ছে। 

কভিড-১৯ মহামারী শুরুর পর এই ক্ষত সেরে উঠতে শুরু করেছে। মোটাদাগে বায়ুদূষণ ব্যাপকভাবে কমে এসেছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই বাতাসের মান উন্নত হয়েছে যা গত ৫০ বছরেও হয়তো অনেকে দেখেনি।

এটার পেছনে কারণ কী? নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে দেশে চলছে লকডাউন। ভারত, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ অনেক বৃহৎ অর্থনীতির দেশে মানুষের চলাচল বন্ধ। বিমানবন্দর, সড়ক মহাসড়ক, শহর, নগর সব বন্ধ। শিল্প কারখানা, হোটেল রেস্টুরেন্ট, শপিং মল সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দরজায় তালা।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমছে। যেমন, নিউইয়র্ক শহরের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ৫-১০ শতাংশ কমেছে। আর চীনে এ বছরের শুরুতেই কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কয়লার ব্যবহারও কমেছে ব্যাপকভাবে। ইউরোপে স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যাচ্ছে, উত্তর ইতালির বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড গ্যাস ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই গ্যাস শ্বাসতন্ত্রের রোগের জন্য দায়ী এবং এটির কারণে এসিড বৃষ্টি হয়।

এখন কথা হলো, মহামারীকালে গ্রিন হাউস গ্যাসের এই অবনমন কি দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলবে? এর উত্তর পেতে চাইলে দেখতে হবে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কেন কমছে?

এর বড় কারণ হলো দেশে দেশে চলছে লকডাউন। ফলে মানুষের ভ্রমণ বন্ধ। যানবাহন চলছে না, যেখানে কার্বন নিঃসরণের এক চতুর্থাংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত যানবাহন থেকে। 

উড়ছে না উড়োজাহাজ। সুইডেনের লান্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক কিম্পারলি নিকোলাস বলেন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় উড়োজাহাজ চলাচলের কারণে সবচেয়ে দ্রুত জলবায়ুর উষ্ণতা বাড়ে। ফলে সব ধরনের ফ্লাইট ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার কারণে কার্বন নিঃসরণও কমছে।

কার্বন নিঃসরণ কমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো শিল্প কারখানা বন্ধ। বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের এক পঞ্চমাংশই আসে কলকারখানা থেকে। ফিনল্যান্ডের সেন্টার পর রিসার্চ অব এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের গবেষক লৌরি মিলিভার্টা বলেন, মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের ব্যবহার ১০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। এ কারণেই দিল্লির মতো অনেক শহরেই পরিষ্কার বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। ওইসব শহরের বাসিন্দারা এতো নির্মল বাতাস কখনো দেখেনি।

মহামারীর কারণে এই যে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির, প্রচুর মানুষ চাকরি ও পেশা হারাচ্ছে, আরো হারাবে, একই সঙ্গে ভোগ কমে যাওয়া- অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদি এবং মারাত্মক প্রভাব পড়বে। অনেকে বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নিপতিত হবে অর্থনীতি। 

ফলে সাময়িকভাবে কার্বন নিঃসরণ কমে যাওয়া নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। গবেষকরা বলছেন, মহামারীতে অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়ছে তাতে ২০২০ সালে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ কমতে পারে। সুতরাং এ বছর গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমলেও মহামারীর শেষে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ফিরলে কী অবস্থা হতে পারে সেটিই আসল কথা। মানুষ আবার হাজার হাজার মাইল দূরে ভ্রমণ করবে। গাড়িঘোড়া চলবে, উড়োজাহজ উড়বে, চালু হবে কলকারখানা, কয়লা ও ফার্নেস ওয়েল চালিত তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আবার চালু হবে। তার মানে আবার গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ আগের মতোই হবে।

গ্রিস হাউস গ্যাস নিঃসরণ সাময়িকভাবে কমে যাওয়ার ঘটনা কিন্তু এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৮ সালের মহামন্দার সময়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল।

বরং এখানে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, মহামারীর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন দেশ মরিয়া পদক্ষেপ নেবে। কার্বন নিঃসরণ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাবে না। ফিনল্যান্ডের সেন্টার পর রিসার্চ অব এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের গবেষক লৌরি মিলিভার্টা বলেন, এরই মধ্যে চীন সর্ববৃহৎ দূষণকারী অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেয়া শুরু করেছে। ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন টন কয়লা ব্যবহার করবে। ফলে আগামী কয়েক বছর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ আরো বাড়বে।

এই মহামারী পরিবেশ ও জলবায়ুকে অন্যভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এ বছরের জলবায়ু বিষয়ক বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনগুলো বাতিল করতে হচ্ছে। জাতিসংঘের কপ-১৬ এরই মধ্যে স্থগিত করা হয়েছে।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা সশরীরে বাইরে বেরোতে পারছেন না এবং প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তও পাচ্ছেন না।

অবশ্য মহামারী কিছু ইতিবাচক শিক্ষাও দিয়েছে। যেমনটি বলছেন ফিনল্যান্ডের সেন্টার পর রিসার্চ অব এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের গবেষক লৌরি মিলিভার্টা। তিনি বলছেন, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ব্যাপারে এ মহামারী একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোককে আর অফিসে না গেলেও চলবে। তারা হোম অফিস করবেন।

তাছাড়া শহুরে মানুষের টেবিলে কীভাবে খাবারটি আসে সে শিক্ষাও মানুষ অনেকখানি পেয়ে গেছে। এই মহামারী তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা খাদ্য অপচয় না করতে শিক্ষা দিচ্ছে।  তাছাড়া লকডাউনের আতঙ্কে সুপারশপে হুমড়ি খেয়ে পড়া এবং অন্যের কথা না ভেবে নিমেষে সুপারশপের তাক খালি করে দেয়া নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যতোটা আলোচনা হয়েছে তাতে পরবর্তীতে মানুষ এ আচরণ শুধরে নেবে বলে আশা করা যায়।

সুইডেনের লান্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক কিম্পারলি নিকোলাস বলছেন, এই মহামারী আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের একটা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ পরস্পরকে সহযোগিতা করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে, এমনকি ত্যাগ স্বীকার করেও অন্যের উপকার করছে। পরিবেশ রক্ষায় এই শিক্ষাটা খুবই কাজে লাগতে পারে।

বিবিসি অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন