করোনায় বৈষম্যের নগ্ন চেহারা উন্মোচিত অগ্রসর ফ্রান্সেও

বণিক বার্তা ডেস্ক

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বিলাসবহুল ইয়টে নিরাপদ কোয়ারেন্টিন উদযাপন করছেন ধনকুবের বিলিয়নেয়াররা। অন্যদিকে বিভিন্ন দরিদ্র জনবহুল শহরতলির বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব। বাড়ছে মৃত্যু। দরিদ্র এসব এলাকার বাসিন্দারা এখন কর্মহীন হচ্ছেন। গৃহহীন হচ্ছেন। রাস্তাঘাটও হয়ে উঠছে সংঘাতমুখর। দুই শ্রেণীর মধ্যকার বৈষম্যের চিত্রটি অগ্রসর ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্সের।

প্যারিসের উত্তরাঞ্চলীয় শহরতলির একটি সড়কে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গত সপ্তাহে। স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে নির্মম বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ তুলে পথে নামে উত্তেজিত জনতা। বিষয়টি ঝড় তুলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তেজিত জনতা গাড়ি ময়লার ক্যানে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ পুলিশের দিকে পটকাও ছুড়ে মারছে। অন্যদিকে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার প্রয়াসে বৃথাই দলবেঁধে ছুটে আসছে পুলিশ।

ফ্রান্সে লকডাউনের শুরু গত ১৭ মার্চ। এর পর থেকে দেশটির বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলেছে লকডাউন। আগামী ১১ মে পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবসা চালুর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটির সরকার। ঘরের বাইরে বের হতে দেশটির মানুষের প্রয়োজন পড়ছে বিশেষ অনুমতি-সংবলিত স্লিপের।

ফ্রান্সের তুলনামূলক দরিদ্র জনবহুল এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের ওপর লকডাউন খুব ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছে। অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ট্যাক্সেশন অব ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশনস অ্যান্ড এইড টু সিটিজেনসসহ (এটিটিএসি) বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ইউনিয়নের এক যৌথ মতামতে সম্প্রতি প্রসঙ্গে বলা হয়, যেসব এলাকায় কর্মজীবী মানুষের বসবাস বেশি, সেসব এলাকার মানুষই অপরিহার্য শ্রমিক হিসেবে অর্থনীতির ফ্রন্টলাইনে ভূমিকা রেখেছে সবচেয়ে বেশি। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনায় তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে আরো বেশি। আসন্ন অর্থনৈতিক সামাজিক সংকটের কালে বৈষম্যের শিকার মানুষগুলো বিস্ফোরিত হতে পারে।

অন্যদিকে বিপরীত চিত্র ফ্রান্সের ধনাঢ্য এলাকাগুলোর। সেখানকার মানুষেরা লকডাউনের মধ্যে সামাজিক সব ধরনের নিরাপত্তা সুবিধা ভোগ করে আসছে। এমনকি কেউ কেউ এরই মধ্যে দেহে পরীক্ষামূলক অ্যান্টিবডি প্রয়োগেরও সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে গোটা ফ্রান্সেই হাসপাতাল নার্সিং হোমগুলোয় রোগীর চাপ বাড়ছে।

প্যারিসের শহরতলিতে গত সপ্তাহের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীভুক্ত এক ব্যক্তি মোটরসাইকেলে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে টহল পুলিশ আকস্মিকভাবেই গাড়ির দরজা খুলে তার গতিরোধ করার প্রয়াস চালায়। চলমান মোটরসাইকেলের সামনে আকস্মিকভাবে দরজা মেলে ধরায় এর সঙ্গে মোটরসাইকেলটির সংঘর্ষ ঘটে। পা ভেঙে যায় আরোহীর।

পরে পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ওই সময় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ওই মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে কথা বলার জন্য গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজা খুলেছিলেন। ঘটনার পর গোটা পঞ্চাশেক ব্যক্তি পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিয়ে হামলা চালায় বলেও দাবি করা হয়েছে বিবৃতিতে।

ওই মোটরসাইকেল আরোহীর আইনজীবী স্টিফেন গ্যাস এরই মধ্যে পুলিশের আচরণ নিয়ে তদন্ত চালানোর জন্য ফ্রান্সের জেনারেল ইন্সপেক্টরেট অব ন্যাশনাল পুলিশের (আইজিপিএন) কাছে আবেদন জানিয়েছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, ওই ঘটনায় পুলিশের আচরণ ছিল সম্পূর্ণরূপে অস্বাভাবিক।

তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা মোটরসাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লাগার আগে গাড়ির দরজা মেলে ধরেছিলেন রাস্তার একেবারে মাঝখানে। কোনো ধরনের হুঁশিয়ারি ছাড়াই। বিষয়ে এখন আমি শুধু প্রশ্ন তুলতে পারি।

প্যারিসের শহরতলির যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে, ওই এলাকাটি পুলিশের নির্মমতা এবং পুলিশবিরোধী দাঙ্গার জন্য এরই মধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের শোডাউন এলাকা হিসেবে বেশ খ্যাত অঞ্চলটি।

গত সপ্তাহের শনিবার রাতের ওই ঘটনার পর প্যারিসের সবগুলো শহরতলি এলাকায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম পোস্ট করেছিলেন তাহা বুহাফস নামে এক সাংবাদিক। তিনি বলেন, ওই ঘটনাটি ছিল এক প্রতীকী মুহূর্ত। লকডাউনের মধ্যে আচরণের দ্বিমুখিতা এখন সবার সামনে স্পষ্ট। প্যারিসের রাস্তাঘাটে মানুষ হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্য সবাই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সেখানে পুলিশ কাউকে কিছু বলছে না। পুলিশের যত নির্মমতা, সব শুধু শহরতলিতেই।

তিনি জানান, শহরতলির মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর তুলনায় কর্মজীবী পরিবারগুলোর ওপর লকডাউনের প্রভাব অনেক বাজেভাবে পড়েছে। আটকে রাখার বিষয়টি সবার কাছে সমান নয়। আমাদের সবার এখানে এমন কোনো টেরেস নেই, যেখানে প্রতিবেশীরা একে অন্যকে অ্যাকর্ডিয়ন বাজিয়ে শোনায়। শহরতলির একেকটি স্বল্প ব্যয়ে আবাসনযোগ্য বাড়িতে আটজন বা তারও বেশিসংখ্যক মানুষ বসবাস করে। মানুষগুলোর কেউ হয়তো পেশায় ক্যাশিয়ার, কেউ ডেলিভারি ম্যান, কেউ ডাকপিয়ন, যাদের বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ নেই।

এসব এলাকায় মৃত্যুহারের দিক থেকেও প্রত্যক্ষ নাটকীয় প্রভাব ফেলেছে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। ৩০ মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে প্যারিসের সিন-সাঁ দাঁনি এলাকায় মৃত্যুহার বেড়েছে অন্যান্য বছরের সময়ের স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় ২৯৫ শতাংশ। হতস দু সিন এলাকায় মৃত্যুহার বেড়েছে ২৫৫ শতাংশ। গোটা প্যারিসে মৃত্যুহার বেড়েছে ১৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে পুরো ফ্রান্সে বৃদ্ধির হার ৬১ শতাংশ।

ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুধবার দেশটির সিনেটে জানান, ঝুঁকিপূর্ণ সিন-সাঁ দাঁনি এলাকায় প্রতি সন্ধ্যায় নিয়মিতভাবেই সমন্বিত কার্যক্রম চালাচ্ছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। সেখানে এখন পর্যন্ত লাখ ২০ হাজারটি সংক্রমণ রোধমূলক তল্লাশি (টহল) ৩৮ হাজার জরিমানার ঘটনা ঘটেছে, যা গোটা ফ্রান্সে পুলিশি তল্লাশির জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।

অন্যদিকে ওই মোটরসাইকেল আরোহীর ঘটনা সম্পর্কে সিনেটে তিনি বলেন, পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা হয়েছে। সময় তিনি পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলার তীব্র নিন্দাও জানান।

এর আগে তিনি স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, শহরতলির বাসিন্দারা ঘরে আটক থাকার নিয়মকানুন বেশ শ্রদ্ধাশীলতার সঙ্গেই মানছেন সে সময় তিনি আরো বলেছিলেন, আমি (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে) বলেছি এসব নিয়মকানুন বিবেচনাবোধ সংযমের সঙ্গে প্রয়োগ করতে।

অন্যদিকে বুধবার তিনি সিনেটে বলেন, কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে আমরা ফ্রান্সের সর্বত্র যাতে ঘরে অবস্থানের নীতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুসরণ করা হয়, সেটি নিশ্চিত করছি; এমনকি যেখানে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ উত্তেজিত করা হচ্ছে, সেখানেও। আমরা তাদের নিরাপত্তা দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সুতরাং ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা সম্ভাব্য সবচেয়ে শক্ত উপায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করছি।

এর আগে মার্চেই বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের মহাপরিচালককে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছিল। এতে অনুরোধ করা হয়েছিল, কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব রোধে লকডাউনের মধ্যে পুলিশ যাতে কোনো ধরনের মাত্রাছাড়া বলপ্রয়োগ, সহিংস বৈষম্যমূলক আচরণ না করে।

প্যারিসের শহরতলির বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যখন এতকিছু ঘটে চলেছে, ঠিক সে মুহূর্তে ফ্রান্সের অন্য এক স্থানে জন্ম নিয়েছে আরেক বিতর্ক।

ফ্রান্সের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আবাসস্থল অভিজাত সাঁ ত্রোপে শহরের একটি ক্লিনিক সম্প্রতি এখানকার বাসিন্দাদের নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা চালায়। ধরনের পরীক্ষায় রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে দেখা হয়, কারো শরীরে নভেল করোনাভাইরাস দমনের মতো অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা। শুধু এলাকার ধনী বিলাসবহুল বাসিন্দারাই ধরনের পরীক্ষা চালানোয় ফ্রান্সে এখন করোনা পরীক্ষার উপযোগী ওষুধ কিটের সংকট দেখা দিয়েছে বলে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দ ফিলিপও সম্প্রতি স্বীকার করেছেন। অবস্থায় একটি এলাকায় শুধু ধনীদের বেছে সেরোলজিক্যাল পরীক্ষা চালানোর খবরে এমনকি সাঁ ত্রোপের বাসিন্দাদের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। যদিও সেরোলজিক্যাল টেস্ট করোনা শনাক্তে করা ডায়াগনস্টিক টেস্ট বা পিসিআর পরীক্ষার তুলনায় ভিন্ন। ডায়াগনস্টিক টেস্টে দেখা হয়, কেউ সংক্রমিত কিনা। অন্যদিকে সেরোলজিক্যাল টেস্টে দেখা হয় কেউ আগে সংক্রমিত হয়েছিল কিনা।

কিন্তু যে মুহূর্তে ফ্রান্সের স্থানীয় হাসপাতালগুলো আগত রোগীদের পরীক্ষা চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, সে সময় ধরনের কার্যক্রমকে জরুরি চিকিৎসা সম্পদের অপচয় হিসেবে দেখছেন সবাই। এমনকি ধরনের পরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মও অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ আসছে খোদ সরকারি পর্যায় থেকেই।

সিএনএন থেকে অনূদিত সংক্ষেপিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন