প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ, বেতন পাননি অনেক কর্মী

হাসান জামিল

বিশ্বের অনেক দেশ নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশের সিনেমা হলগুলো করোনাভাইরাসের কারণে ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। এদিকে চলচ্চিত্র ব্যবসার মন্দার কারণে দেশে গত দুই দশকে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে হলের সংখ্যা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বর্তমানে যে প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ রয়েছে, তার বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন বা ভাতা পাননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতারা বিষয়টি নিয়ে সরকারের ওপর মহলে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কারণ অতীতে বিভিন্ন সংকটে সরকারের কাছ থেকে তারা বিভিন্ন সহায়তা পেয়েছেন। দেশের বিরূপ পরিস্থিতিতে এখন সরকারই তাদের একমাত্র ভরসার স্থল।


বলাকা হলের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত শাহিন টকিজকে জানান, তারা এখন পর্যন্ত তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের হল কর্তৃপক্ষ আসলে ব্যবসার জন্য হল চালায় না। হলের ব্যবসা হয় মাসে - লাখ টাকার, কিন্তু আমাদের মাসে বেতন দিতে হয় লাখ টাকার বেশি। ঈদ মৌসুম বা খুব হিট ছবি ছাড়া প্রতি মাসে ভর্তুকি দিতে হয়। সেটা আমরা মার্কেটের ভাড়া থেকে দিই। এখন মার্কেট বন্ধ থাকায় এখান থেকেও টাকা পাব না। জানি না ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি হবে।

ঢাকার অন্যান্য হলের অবস্থাও প্রায় একই রকম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধুমিতা হলের এক কর্মচারী জানান, তাদের হলে নিয়মিত-অনিয়মিত মিলে ৭০-৮০ জন কর্মচারী কাজ করেন। হল বন্ধ হওয়ার পর থেকে সবার বেতন বন্ধ রয়েছে। হল কর্তৃপক্ষ বা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কোনো সহায়তাও পাচ্ছেন না বলে তিনি জানান।


পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে আসছে ঐতিহ্যবাহী মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহ। প্রেক্ষাগৃহের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমরা মার্চ-এপ্রিলের বেতন এখনো দিতে পারিনি। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিতে পেরেছি। গত কয়েক মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়ে হল চালিয়েছি। বতমান যে পরিস্থিতি তাতে আসন্ন ঈদেও হল চালানো সম্ভব হবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রদর্শন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের অবস্থায় অনেক হল স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার

শঙ্কা রয়েছে। আর ঢাকা ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ হল কর্তৃপক্ষই কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেনি।

রাজধানীর রায়েরবাজারে অবস্থিত মুক্তি সিনেমা হল। করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাওয়ায় রায়েরবাজার এলাকায় চলছে লকডাউন। ঢাকার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার হলটিতে কাজ করেন প্রায় ২২ জন কর্মচারী। তাদের অনেকেই এলাকায় বাস করেন। যারা বাইরে বের হতে পারছেন না। জানতে চাইলে হলটির ব্যবস্থাপক শহিদুল্লাহ বলেন, হল বন্ধের প্রায় এক মাস হতে চলল। আগের মাসের বেতনই দেয়া হয়নি। কাউকে কাউকে সামান্য বেতন দিতে সমর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। আমাদের হয়তো না খেয়েই মরতে হবে।

ঢাকার মিরপুরের পূরবী হলের ম্যানেজার পরেশ জানান, তাদের হলে মোট ৩২ জন কর্মচারী কাজ করেন। হলের কর্মচারীরাও বেতন পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বেতন পাইনি। আসলে ব্যবসা না থাকলে মালিকের পক্ষে বেতন দেয়াও সম্ভব হয় না। এমনিতেই হলের ব্যবসা মন্দা।

ঢাকার বাইরের হলগুলোর অবস্থাও একই। বেতন-ভাতার বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় রংপুরের শাপলা হলের ম্যানেজার কামাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের হল বন্ধ হয়েছে মার্চের ১৮ তারিখ। মার্চ মাসের বেতন দেয়া সম্ভব হয়নি। ছবি না চললে বেতন দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া এখন যা অবস্থা, তাতে হল খুললেও মানুষ আসবে বলে আমার মনে হয় না। হলে প্রায় ২২ জন কর্মচারী ফুলটাইম দায়িত্ব পালন করেন।

যশোরের মণিহার প্রেক্ষাগৃহের কর্মচারীরাও দুই মাস ধরে বেতন পাননি বলে জানা গেছে। বিষয়ে প্রেক্ষাগৃহের হিসাবরক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমরা ৩২ জন কাজ করি। প্রায় দুই মাস ধরে আমাদের বেতন হয়নি। সিনেমা হলের তো এমনি আয় কম। মালিকপক্ষ ভর্তুকি দিয়ে চালাত। বেতন দেয়া হতো মূলত আমাদের মার্কেট, আবাসিক হোটেল কমিউনিটি সেন্টারের আয় থেকে। লকডাউনের ফলে তাও বন্ধ আছে।

চট্টগ্রামের প্যালেস প্রেক্ষাগৃহে কাজ করেন প্রায় ১৫ জন, সুগন্ধা হলে ১২ জন। তাদেরও বেতন হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন প্রেক্ষাগৃহ দুটির ম্যানেজার সাইফ হোসেন। এমন পরিস্থিতিতে শিল্প ধ্বংস হওয়ার পথে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকা ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, গত দুই দশকে অনেক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক প্রেক্ষাগৃহ ছিল যেগুলো শুধু ঈদের সময় খুলত। সেই ব্যবস্থাও এবার নেই। ভবিষ্যতেও যারা ব্যবসায় থাকতে চান তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা উচিত। এতে অন্তত তারা প্রেক্ষাগৃহ চালু রাখতে পারবেন।


বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবেশক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, অতীতে প্রতিটি জাতীয় দুর্যোগে হল মালিক, পরিবেশক, প্রযোজকরা সহায়তা প্রদান করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সারা দেশেই হল মালিকরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছেন না। অবস্থায় তারা সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

মিয়া আলাউদ্দিন আরো বলেন, মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ হওয়ার আগে যে হলগুলো চালু ছিল তার তালিকা উপজেলার ইউএনও জেলা প্রশাসকের কাছে রয়েছে। সেই তালিকা ধরে ধরে যেন কর্মচারীদের বেতন বা সহায়তা প্রদান করা হয়। আর আমরাও ব্যাপারে সরকারের পাশে থেকে সহায়তা করতে চাই।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন