কভিড-১৯

ডায়রিয়া ও ইবোলা ক্যাম্পেইন থেকে আমরা কী শিখলাম

ড. আহমদ মোশ্তাক রাজা চৌধুরী

কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব এখনো চলছে। করোনার উত্পত্তিস্থল উহানে এখন এর প্রকোপ কমেছে, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জনজীবন ফিরে আসছে। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এখনো লড়াই করে চলেছে। মহামারী এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছেউহান থেকে ইউরোপ, সেখান থেকে নিউইয়র্ক। এরপর কোথায়?

এটি পরিষ্কার যে রোগের সংক্রমণ এবং এর ফলে যে বিপর্যয় ঘটবে তা ঠেকাতে আগামী কয়েক মাস আমাদের বেশির ভাগ সময়, সম্পদ ধ্যান-ধারণাকে কাজে লাগাতে হবে। বর্তমানে দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছেরোগের প্রশমন এবং তার নিয়ন্ত্রণ। প্রশমনের জন্য আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিতে পারি তা হলো, পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ শনাক্তকরণ, আইসোলেশন এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আস্থা গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে তা করার ক্ষেত্রে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশকেও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বেশির ভাগ চ্যালেঞ্জই প্রযুক্তিগত, যার সমাধান পেতে প্রয়োজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার, আনুষঙ্গিক সহায়তা সেবা এবং স্বচ্ছ প্রশাসন।

অন্যদিকে রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান, প্রশাসন সমাজের সমন্বয়ে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা কিছুটা ভিন্ন ধরনের। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান-ধারণা মতে, রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের যে দুটি অভ্যাস কঠোরভাবে পালন করতে হবে তা হলো, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কারণে হাত ধোয়ার বিষয়টি সম্পর্কে এখন অনেকেই জানেন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বেশির ভাগ মানুষ এর চর্চাও করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে তেমন আশানুরূপ সফলতা দেখা যাচ্ছে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস বিপণিবিতানগুলোর জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে এবং রেল, সড়ক, আকাশ নৌপথে সাধারণ যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের কারণে দেশ অল্প সময়ে সামাজিক দূরত্বের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। যখন নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে তখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কাও একই সঙ্গে বিরাজমান।

আমার মতে, সামাজিক দূরত্ব অনুশীলন একটি আচরণগত বিষয় এবং একে সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা উচিত। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রাথমিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে, কিন্তু তা বজায় রাখতে হলে বিষয়টিকে একটি আচরণগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যেমন অজানা এই রোগের মতো নিজেকে আইসোলেশন করাও সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা। বেশির ভাগ বাংলাদেশীর কাছে এটি বিদেশী আচরণ হিসেবেই গণ্য। আমরা আড্ডা অন্তঃপ্রাণ। সামাজিকতা রক্ষায় আমাদের জুড়ি মেলা ভার।

আমরা বড় বড় রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং করতে অভ্যস্ত, ধর্মীয় প্রার্থনাসভায় আমরা নিয়মিত সমবেত হই এবং রকম আরো অনেক কিছুই করে থাকি।

তাই হঠাৎ কীভাবে আমরা এসব বিষয় এড়িয়ে চলব এবং প্রয়োজনে নিজেকে সামাজিক দূরত্বের একটি কঠোর নিয়মে আবদ্ধ করব? এজন্য আমাদের যা প্রয়োজন, বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান দার্শনিক শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরির ভাষায়, সার্বিক সচেতনতা বা সামগ্রিক উপলব্ধি এজন্য শুধু জানাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন এই জানাকে কতটুকু চর্চার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে তা দেখা। পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য জ্ঞান চর্চার ব্যবধান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্য খাবার স্যালাইনের ব্যবহার।

আশির দশকের শুরুর দিকে ব্র্যাক মায়েদের শেখানো শুরু করেছিল কীভাবে বাসায় খাবার স্যালাইন তৈরি করতে হয়। প্রত্যেক পরিবারের মায়েরা ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে খুব ভালোভাবে খাবার স্যালাইন তৈরির পদ্ধতি শিখে নিয়েছিলেন। কিন্তু হতাশাজনক ব্যাপার হলো, জরিপে দেখা গেল খুব কমসংখ্যক মা শিশুর ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন তৈরি করে খাওয়াচ্ছেন। ব্র্যাক যেহেতু সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে খাবার স্যালাইনের প্রতি জনগণের আচরণ পরিবর্তন করতে চেয়েছিল, তাই এর প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য ধারাবাহিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। ফলে তাদের জন্য সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যচর্চার অভ্যাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়েছিল।

গবেষণালব্ধ জ্ঞান এবং তথ্য-উপাত্তকে ব্যবহার করে ব্র্যাক তার বাস্তবায়ন কৌশল নীতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করেছে। এখন বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে খাবার স্যালাইন ব্যবহারের হার সর্বাধিক। আমি মনে করি, আশির দশকে ব্র্যাকের নেয়া পদক্ষেপ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা প্রাদুর্ভাবের কথা বলা যায়। ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ইবোলা মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। গিনি থেকে শুরু করে এটি সিয়েরা লিওন লাইবেরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।

কভিড-১৯-এর চেয়ে ইবোলা অনেক বেশি মারাত্মক ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, লাইবেরিয়ায় ১০ হাজার ৬৭৫ জন সংক্রমিত হয়েছিল, যার মধ্যে হাজার ৮০৯ মারা গেছে (মৃত্যুহার ৪৫%) ইবোলা আক্রান্ত মৃত বা জীবিত ব্যক্তিদের নিঃসৃত যেকোনো তরল পদার্থ যেমন রক্ত, লালা, ঘাম ইত্যাদি সংস্পর্শে অন্যরা সংক্রমিত হতো।

ইবোলা প্রতিরোধে লাইবেরিয়ার স্লোগান ছিলস্পর্শ নয়, হ্যান্ডশেক নয়, নয় কোলাকুলি। লাইবেরিয়ায় ব্র্যাকের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ আবদুস সালাম এই মহামারী মোকাবেলা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ইবোলা প্রতিরোধে সতর্কবার্তাগুলো যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার (এমএসএফ) ইউএস আর্মির নেতৃত্বে বেশির ভাগ চিকিৎসা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল।

ব্র্যাক অন্যান্য এনজিও আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তকরণ তথ্য সংগ্রহ এবং জীবাণুমুক্তকরণের মাধ্যমে ইবোলা প্রতিরোধে ভূমিকা রেখেছিল। আবদুস সালাম বলেন, মানুষের ভয়-আতঙ্ক দূর করা এবং মানসিকভাবে সুস্থ রাখার বিষয়টি ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ইবোলা থেকে আরোগ্য লাভ করা ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে একঘরে করে দেয়া হচ্ছিল, এমনকি তারা পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল।

কভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবিকা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লীসমাজ, মাইক্রোফিন্যান্স গ্রুপসহ ব্র্যাক তার বিভিন্ন প্লাটফর্মকে কাজে লাগিয়েছে। এই আপত্কালে ব্র্যাক তার মাঠ পর্যায়ের সাধারণ কার্যক্রম স্থগিত করেছে এবং স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। সব প্রতিকূলতাকে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করে উন্নয়নযোদ্ধারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেশবাসীকে সচেতন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ইবোলার অভিজ্ঞতার আলোকে ব্র্যাক এরই মধ্যে তার সামনের সারির কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান করেছে।

ব্র্যাকের এই কর্মিবাহিনীতে রয়েছেন ৪০ হাজার স্বাস্থ্যসেবিকা, ২০ হাজার শিক্ষক, হাজার ৫০০ পল্লীসমাজের সদস্য এবং ৫০ হাজার মাইক্রোফিন্যান্স কর্মী। কিন্তু এর কার্যকারিতা এবং প্রভাব এখনই নির্ণয় করা কঠিন হবে। প্রাথমিকভাবে যে ফিডব্যাকগুলো পাওয়া গেছে তাতে বলা যায়, এই আচরণগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষই বুঝে উঠতে পারে না যে তার নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার মধ্যে সামাজিক দূরত্বের অর্থ কী।

এজন্য পরামর্শ দেয়া সত্ত্বেও অনেক মসজিদে এখনো জামাতে নামাজ পড়া হচ্ছে। ব্র্যাকের খাবার স্যালাইন কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় মসজিদগুলোর মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়ার কাজটি খুব সফলভাবে করা গিয়েছিল। ব্র্যাক কি একইভাবে জামাতে নামাজ পড়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে মসজিদগুলোকে রাজি করতে পারবে? অনেক জায়গায় ফিরে আসা প্রবাসীদের অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে এবং প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য রাজি করাতে আমরা কীভাবে ইবোলার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি?

এই প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ব্র্যাকের শীর্ষ পর্যায়ের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী মোর্শেদা চৌধুরী বলেন, আমাদের উদ্যোগগুলো তৃতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে এই তৃতীয় দৃষ্টিকোণ হলো গবেষণা, যার ওপর ব্র্যাক অনেকটা নির্ভরশীল। ব্র্যাকের মতো অন্যান্য এনজিও তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে তৃণমূল পর্যায়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সম্মিলিতভাবে কাজ করা হলে জনগণের সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখা যেতে পারে।

এটি সত্য যে নভেল করোনাভাইরাসের মতো অন্য কোনো মহামারী বিশ্বব্যাপী এত বেশি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেনি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এখন লকডাউন অবস্থায় রয়েছে। তবে লকডাউন কঠোর এবং অস্থায়ী ব্যবস্থা। লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয়ার পর কী হবে? মানুষ হয়তো তাদের পুরনো অভ্যাসে জীবনযাপন শুরু করবে, বিশ্বকে আবার নতুন কোনো সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। লকডাউনের সুফলগুলো আমরা তখনই পাব যখন বর্তমান সময়ের আচরণগত পরিবর্তনের চর্চাগুলো আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ধরে রাখতে পারব। এজন্য আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে এই পরিবর্তন আনা হবে সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতিতে; চিকিৎসাবিজ্ঞান, স্থানীয় সংস্কৃতি তথ্যের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে। পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সবচেয়ে কার্যকর টেকসই উপায়গুলো নির্বাচন করতে হবে।

 

. আহমদ মোশ্তাক রাজা চৌধুরী: উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠাতা ডিন

জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ

সাবেক ভাইস চেয়ার, ব্র্যাক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন