প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পূর্ণ করল প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড। দীর্ঘ এ পথপরিক্রমায় ব্যাংকটির অর্জনের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ। রজতজয়ন্তী উৎসব উদযাপনে ব্যাপক প্রস্তুতিও ছিল ব্যাংকটির। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের মুখে স্থগিত হয়ে গেছে সব কর্মসূচি। বণিক বার্তার কাছে ব্যাংকটির দীর্ঘ পথচলার গল্প তুলে ধরেছেন প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রাহেল আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান
২৫ বছরের
পথযাত্রায় প্রাইম ব্যাংকের অর্জন
কী?
প্রাইম ব্যাংকের
পথচলা শুরু
হয়েছিল ১৯৯৫
সালের ১৭
এপ্রিল। গত
২৫ বছরে
দেশের অর্থনীতিতে
যা কিছু
অর্জন, তার
প্রতিটি ধাপেই
প্রাইম ব্যাংক
কার্যকর ভূমিকা
রেখেছে। সে
হিসেবে দেশের
অর্থনৈতিক যেকোনো
অর্জনেই প্রাইম
ব্যাংক অংশীদার।
শুরু থেকেই
এ ব্যাংকের
স্লোগান ছিল
‘আ
ব্যাংক উইথ
আ ডিফারেন্স’।
ব্যাংকের এ
স্লোগান শুধু
লেখা বা
বলার মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকেনি।
বরং সত্যিকার
অর্থেই সর্বোত্কৃষ্ট
গ্রাহকসেবার মাধ্যমে
প্রাইম ব্যাংক
নিজেকে ব্যতিক্রমী
ব্যাংক হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করতে
পেরেছে। দেশের
ব্যাংকিং খাতের
আধুনিকায়ন, পণ্য
বৈচিত্র্য, দক্ষ
মানবসম্পদ তৈরি
থেকে শুরু
করে প্রতিটি
ধাপে প্রাইম
ব্যাংকের ভূমিকা
আছে। এটি
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের
জন্যই বড়
অর্জন।
প্রাইম ব্যাংক কীভাবে দেশের
অর্থনৈতিক বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে?
দেশের বৈদেশিক
মুদ্রা আয়ের
প্রধান মাধ্যম
তৈরি পোশাক
খাতে প্রাইম
ব্যাংক শুরু
থেকেই বিনিয়োগ
করেছে। এ
খাতের শীর্ষস্থানীয়
অনেক উদ্যোক্তাই
এ ব্যাংকের
হাত ধরে
উঠে এসেছেন।
এখনো প্রাইম
ব্যাংকের বিনিয়োগের
গুরুত্বপূর্ণ অংশ
তৈরি পোশাক
খাতে। কৃষি,
বস্ত্র, খাদ্য,
ওষুধ, চামড়া,
সিমেন্ট, সিরামিক,
রাসায়নিকসহ ভারী
শিল্পের সব
খাতেই প্রাইম
ব্যাংক বিনিয়োগ
করেছে। একই
সঙ্গে এসএমই
ও রিটেইলে
প্রাইম ব্যাংক
নিত্যনতুন প্রডাক্ট
চালু করেছে।
এজন্য প্রাইম
ব্যাংক দেশী
ও আন্তর্জাতিক
বহু প্রতিষ্ঠান
থেকে পুরস্কৃত
হয়েছে।
প্রাইম ব্যাংকের
মাধ্যমে দেশের
ব্যাংকিং খাতে
সিন্ডিকেশন ফিন্যান্স
শুরু হয়।
কনজিউমার ফিন্যান্স
স্কিমের নিত্যনতুন
প্রডাক্ট প্রাইম
ব্যাংকের হাত
ধরে বাংলাদেশের
ব্যাংকিং খাতে
এসেছে। ২০১৮
সালে আমরা
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট
ব্যাংক (এডিবি)
থেকে বেস্ট
এসএমই ডিল
অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি।
সম্প্রতি ইউরোমানি
প্রাইম ব্যাংককে
বাংলাদেশের বেস্ট
ডিজিটাল ব্যাংক
হিসেবে স্বীকৃতি
দিয়েছে। প্রাইমডিজি
নামের ভার্চুয়াল
ব্যাংকিং চালু
করার জন্য
আমরা এ
পুরস্কার পেয়েছি।
২৫ বছরে
প্রাইম ব্যাংকের ব্যাপ্তি কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে?
প্রতিষ্ঠার ২৫
বছর শেষে
প্রাইম ব্যাংক
প্রায় ৩২
হাজার কোটি
টাকা সম্পদের
ব্যাংকে পরিণত
হয়েছে। আমাদের
কাছে গ্রাহকদের
আমানত আছে
২১ হাজার
কোটি টাকার।
প্রাইম ব্যাংক
প্রায় সাড়ে
২১ হাজার
কোটি টাকা
বিনিয়োগ করেছে।
প্রচলিত ধারার
ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি
আমরা গ্রাহকদের
ইসলামী ব্যাংকিং
সেবাও দিচ্ছি।
প্রাইম ব্যাংকের
অফশোর ব্যাংকিং
ইউনিটের কার্যক্রমও
বেশ জোরালো।
দেশে-বিদেশে
প্রাইম ব্যাংকের
রয়েছে ছয়টি
সহযোগী প্রতিষ্ঠান।
যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর,
হংকংয়ে আমাদের
তিনটি সহযোগী
প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
দেশে প্রাইম
ব্যাংক সিকিউরিটিজ
এবং প্রাইম
ব্যাংক ইনভেস্টমেন্টও
গ্রাহকদের আস্থা
অর্জন করতে
পেরেছে। দেশব্যাপী
১৪৬টি শাখা,
১৭০টি এটিএম
বুথ ও
ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ
প্রযুুক্তির সর্বোচ্চ
ব্যবহারের মাধ্যমে
প্রাইম ব্যাংক
গ্রাহকসেবা দিচ্ছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে
প্রাইম ব্যাংক কী করেছে?
সামাজিক দায়বদ্ধতার
জায়গা থেকে
প্রাইম ব্যাংক
শুরু থেকেই
দেশের শিক্ষা,
চিকিৎসা ও
ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করছে। প্রাইম
ব্যাংক ফাউন্ডেশন
থেকে প্রতি
বছরই দেশের
মেধাবী ও
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের
বৃত্তি দেয়া
হচ্ছে। প্রাইম
ব্যাংক চক্ষু
হাসপাতাল ও
নার্সিং ইনস্টিটিউট
মানবসেবায় কাজ
করছে। দেশের
ক্রিকেটের উন্নয়নে
প্রাইম ব্যাংকের
ভূমিকা সর্বমহলে
প্রশংসিত। প্রাইম
ব্যাংক স্কুল
ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করছে। সম্প্রতি
বিশ্বকাপজয়ী অনূর্ধ্ব-১৯
ক্রিকেট দলের
চারজন ক্রিকেটার
প্রাইম ব্যাংক
স্কুল ক্রিকেট
থেকে উঠে
আসা। এটি
প্রাইম ব্যাংকের
জন্য গৌরবের।
ভবিষ্যৎ পথচলায় আপনাদের ভাবনা
কী?
গত কয়েক
বছরে প্রাইম
ব্যাংকে আমূল
পরিবর্তন এসেছে।
এ সময়
ব্যাংকের সামগ্রিক
কার্যক্রম পুনর্গঠন
করা হয়েছে।
ব্রাঞ্চভিত্তিক ব্যাংকিং
ধারণা থেকে
বেরিয়ে আমরা
সেন্ট্রালাইজেশনে চলে
এসেছি। এখন
প্রাইম ব্যাংকের
শাখাগুলো শুধু
সেলস অ্যান্ড
সার্ভিস সেন্টার।
করপোরেট গ্রাহকরা
শাখায় গিয়ে
শুধু সার্ভিসটা
নিয়ে যাবে,
কিন্তু প্রডাক্টটা
সেখান থেকে
পাবে না।
এর জন্য
আমাদের প্রধান
কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট
টিম কাজ
করছে। শাখাগুলো
এখন রিটেইল
ব্যাংকিংয়ের প্রডাক্টগুলো
বিক্রি করছে।
প্রাইম ব্যাংক
নতুনভাবে যাত্রার
প্রস্তুতি নিয়েছে।
আগামী দু-তিন
বছরের মধ্যে
এ ব্যাংকের
কার্যক্রমে আমূল
পরিবর্তন আসবে।
প্রাইম ব্যাংক
শুরু থেকে
করপোরেট ব্যাংকিংয়ে
বেশি গুরুত্ব
দিয়েছে। কিন্তু
বর্তমানে আমরা
এসএমই ও
রিটেইলের সম্প্রসারণে
জোর দিয়েছি।
এরই মধ্যে
এ দুটি
খাতের অবকাঠামো
গড়ে তোলা
হয়েছে। গত
এক বছরে
প্রাইম ব্যাংকের
এসএমই ও
রিটেইলে বিনিয়োগ
বেড়েছে। ক্ষুদ্রঋণ
দেয়ার জন্য
আমরা তৃতীয়
একটি প্রতিষ্ঠানের
সঙ্গে চুক্তি
করতে যাচ্ছি।
প্রাইম ব্যাংকের
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও
বড় ধরনের
পরিবর্তন আনা
হবে। একই
সঙ্গে ব্যাংকের
সব কার্যক্রমকে
আরো বেশি
ডিজিটালাইজ করা
হবে।
দুই বছরের
বেশি সময়
প্রাইম ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বে আছেন।
এ সময়ে
আপনি প্রাইম ব্যাংকে মৌলিক
কী পরিবর্তন আনতে পেরেছেন?
গত দুই
বছরে আমি
প্রাইম ব্যাংকের
প্রত্যেক কর্মীকে
দলগতভাবে কাজ
করার মানসিকতায়
উদ্বুদ্ধ করেছি।
‘ওয়ান
ব্যাংক, ওয়ান
টিম’—এ
মন্ত্র কর্মীদের
মনে গেঁথে
দিয়েছি। দলগতভাবে
কাজ করার
সুফলও আমরা
পেতে শুরু
করেছি। গত
দুই বছরে
প্রাইম ব্যাংকের
মুনাফা প্রবৃদ্ধি
থেকে শুরু
করে প্রতিটি
সূচকে উন্নতি
হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে
ব্যাংকের সূচকগুলোয়
২০-২৫
শতাংশ প্রবৃদ্ধি
হয়েছে। গত
দুই বছর
ধরেই দেশের
ব্যাংকিং খাতে
তারল্য সংকট
চলছে। কিন্তু
সংকটের এ
সময়েও প্রাইম
ব্যাংকের তারল্য
সব সময়
উদ্বৃত্ত ছিল।
এখনো আমাদের
ব্যাংকের ক্যাপিটাল
অ্যাডিকোয়েসি রেশিও
১৬ শতাংশের
বেশি।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের
পথচলায় ভালো
ও খারাপ
সময় যায়।
প্রাইম ব্যাংকও
মাঝের কয়েকটি
বছরে খারাপ
সময় পার
করেছে। তবে
ভুল থেকে
শিক্ষা নিয়ে
আমরা সমৃদ্ধির
পথে ফিরেছি।
ধারাবাহিকভাবে ভালো
করার ভিত
প্রাইম ব্যাংকের
তৈরি হয়েছে।
আমাদের পরিচালনা
পর্ষদের চাহিদাও
ব্যাংকের ভিতকে
মজবুত করা।
১ এপ্রিল থেকে ঋণের
সুদের হার
৯ শতাংশে নামিয়ে আনার
কথা। এক্ষেত্রে প্রাইম ব্যাংকের পরিস্থিতি কী?
ঋণের সুদহার
৯ শতাংশে
নামিয়ে আনার
প্রতিশ্রুতি এখন
আর ঘোষণায়
সীমাবদ্ধ নেই,
এটি এখন
বাস্তবতা। আমরা
সব গ্রাহকের
ঋণের সুদহার
এক অংকে
নামিয়ে এনেছি।
যেসব ব্যাংক
এখনো সুদহার
কমাতে পারেনি,
তারাও ৩০
এপ্রিলের মধ্যে
৯ শতাংশে
নামিয়ে আনবে।
ঋণের সুদহার
কমানোর ফলে
প্রাথমিকভাবে ব্যাংকের
মুনাফায় নেতিবাচক
প্রভাব পড়বে।
এজন্য ব্যাংককে
বাঁচাতে হলে
তহবিল ব্যবস্থাপনা
ভালো করতে
হবে। ব্যাংকারদের
কর্মদক্ষতা বাড়াতে
হবে। ব্যাংকের
সব কর্মকাণ্ডকে
ডিজিটাল করার
পাশাপাশি খেলাপি
ঋণ কমাতে
হবে।
নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষতি থেকে
অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিতে প্রধানমন্ত্রী বড় অংকের
প্রণোদনার ঘোষণা
দিয়েছেন। যদিও
প্রণোদনার অর্থ
ঋণ হিসেবে ব্যাংকগুলোকেই জোগান
দিতে হবে।
এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর ও রেপোর
সুদহার কমানো,
এডিআর বাড়ানোসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে প্রণোদনা তহবিলের অর্থ
পৌঁছাতে এ
উদ্যোগগুলো যথেষ্ট মনে করেন
কি?
দেশের অর্থনীতিকে
সুরক্ষা দেয়ার
অংশ হিসেবে
প্রধানমন্ত্রী যেসব
প্রণোদনা প্যাকেজ
ঘোষণা দিয়েছেন,
সেগুলো বাস্তবায়ন
হলে অর্থনীতি
ঘুরে দাঁড়াতে
পারবে। এসব
প্যাকেজ বাস্তবায়নের
জন্য কেন্দ্রীয়
ব্যাংক এরই
মধ্যে ব্যাংকগুলোর
জন্য রেপোর
সুদহার দশমিক
৭৫ শতাংশ
কমিয়েছে। সিআরআর
সাড়ে ৫
শতাংশ কমিয়ে
৪ শতাংশে
নামিয়েছে। ব্যাংকগুলোর
এডিআরও ২
শতাংশ বাড়ানো
হয়েছে। কেন্দ্রীয়
ব্যাংক চাচ্ছে,
বাজারে টাকার
সরবরাহ বাড়ুক।
লক্ষ্য বাস্তবায়নে
এখন পর্যন্ত
বাংলাদেশ ব্যাংক
যেসব ছাড়
দিয়েছে, তা
ভালোই। তবে
এসব ছাড়
ঘোষিত প্রণোদনা
প্যাকেজ বাস্তবায়নের
জন্য যথেষ্ট
না-ও
হতে পারে।
টাকার সরবরাহ
বাড়াতে রেপোর
সুদহার আরো
কমাতে হবে।
ক্ষতি কাটানোর
জন্য দেশের
পুরো অর্থনীতিই
ব্যাংকিং খাতের
ওপর নির্ভর
করছে। যদিও
তা এরই
মধ্যে ঝুঁকিতে
আছে। বিদ্যমান
অচলাবস্থায় সবচেয়ে
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
হচ্ছে এসএমই
খাত। দেশের
অর্থনীতির এ
চালিকাশক্তি ঘুরে
দাঁড়ানোর ক্ষমতাই
হারিয়ে ফেলছে।
এজন্য এসএমই
খাতকে সহায়তা
দেয়াই হবে
ব্যাংকিং খাতের
জন্য সবচেয়ে
বড় চ্যালেঞ্জ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে
এসএমই খাতে
ঋণ দেয়ার
জন্য গ্রাহক
খুঁজে পাওয়া
কঠিন হবে।
এজন্য এসএমই
ঋণের ঝুঁকি
কমানোর জন্য
কোনো তৃতীয়
পক্ষকে মধ্যস্থতায়
রাখার উদ্যোগ
নেয়া প্রয়োজন।
তাহলে ব্যাংকাররা
সাহসের সঙ্গে
এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোকে
ঋণ দিতে
পারবেন।