সাত-সতেরো

করোনাকালে করণীয়

মো. আব্দুল হামিদ

২০০৪ সালে থাইল্যান্ডে সুনামির ভিডিও দেখেছেন? ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের; কিংবা ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের? প্রাকৃতিক দুর্যোগ ওভাবেই আসে। সেদিক থেকে বলা যায়, নভেল করোনাভাইরাস বেশ ভালো কি বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? এমনভাবে সাইরেন বাজিয়ে, সতর্ক হওয়ার পর্যাপ্ত সময় দিয়ে, বাজারসদাই সেরে, নাপিতের কাছে মাথা মুড়িয়ে ঘরে ওঠার সুযোগ আর কোন দুর্যোগে মেলে, বলুন তো? আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, গ্যাসলাইনে লিকেজ, প্রবল বন্যা, কালবৈশাখী ঝড়, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা নাকি মেঘনায় লঞ্চডুবি? না, এগুলোর কোনোটাই এত সময় মঞ্জুর করে না। তাছাড়া ব্যাপারটা এমনও নয় যে আপনার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হচ্ছে, রোদে-খরায় পুড়ে যাচ্ছেন, পানিতে তলিয়ে যাচ্ছেন, পাহাড়ি ঢল আপনার বাসস্থানকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে...এর কোনোটাই নয়। তবুও কেন দুর্যোগে আমরা এতটা অসহায় বোধ করছি?

চাইলে হাজারটা কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে। কিন্তু এখন সময় সেটা করার নয়। কারণ সত্যিকার অর্থেই আমরা এক যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে অতীত নিয়ে অনেক বিশ্লেষণই করা যাবে। তবে এখন কথা হওয়া দরকার করোনা সৃষ্ট ক্ষতি কীভাবে ন্যূনতম করা যায়? আপাতত সব ভেদাভেদ ভুলে নিজে বাঁচা অন্যদের বাঁচতে সাহায্য করাটা জরুরি। এমন সর্বব্যাপী সংকট নানাভাবেই বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে শুধু সে-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করতে চেষ্টা করছি।

ত্রাণ থেকে পরিত্রাণ: নেপোলিয়ান বোনাপার্ট একদিন নদীর ধারে হাঁটছিলেন। জেলেদের মাছ ধরা দেখে বললেন, তোমরা আমাকে মাছ ধরা শিখিয়ে দেবে? তারা বলল, আপনি এত বড় যোদ্ধা; মাছ ধরার মতো কাজ আপনার নয়। তার চেয়ে বরং আপনাকে কিছু মাছ আমরা উপহার হিসেবে দিচ্ছি। তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমাকে বোকা পেয়েছ? তোমরা যদি মাছ দাও তাহলে আমার একবেলা মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু মাছ ধরা শিখিয়ে দিলে সারা জীবন মাছ খাওয়া ব্যবস্থা হবে! যেকোনো দুর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দেয়া অনেকটা সেই জেলেদের মাছ দেয়ার মতো। তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে এটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু যদি অচলাবস্থা আমাদের ধারণার চেয়েও দীর্ঘ হয়, তখন কীভাবে অগ্রসর হওয়া দরকার, সেটাও এখনই ভাবতে হবে।

সব দুর্যোগই বিপর্যয় ডেকে আনে। তবে ব্যক্তিপর্যায়ে যেভাবে মোকাবেলা করা যায়, জাতীয় জীবনে সেটা সম্ভব হয় না। অসংখ্য ফ্যাক্টর পরস্পর সংযুক্ত হওয়ায় জনজীবনে এর প্রভাব হয় বহুগুণ বেশি। সে কারণে প্রত্যেক রাষ্ট্র দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বছরব্যাপী কাজ করে। যদিও এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের মন্ত্রণালয়টির তেমন উদ্যোগ নজরে আসেনি। যাহোক, প্রথম ধাক্কা সামলাতে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসনীয়। কিন্তু এত বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে শুধু ত্রাণ দিয়ে ঠিক কতদিন চালানো সম্ভব? কারণ অধিকাংশ বিশ্লেষক উদ্বিগ্ন হচ্ছেন করোনা-পরবর্তী সম্ভাব্য সংকট নিয়ে। আর সেটা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে ত্রাণ থেকে আমাদের মনোযোগ পরিত্রাণ- স্থানান্তর করা জরুরি।

বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে করোনাসৃষ্ট প্রভাব আরো দীর্ঘমেয়াদি হবে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। ফলে চলমান কার্যক্রমের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের জন্য মধ্য দীর্ঘমেয়াদি সাপোর্ট সিস্টেম ডেভলপ করা দরকার। মধ্যমেয়াদে সহজ শর্তে ঋণ দেয়া ইতিবাচক ফল আনতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দরকার বাস্তবসম্মত পলিসি সাপোর্ট। কারণ আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

মজুদ বণ্টন: বাপ-চাচাদের কাছে ১৯৭৪ সালের গল্প শুনেছি। এক স্যার সেই প্রসঙ্গে ক্লাসে বলেছিলেন, ক্ষুধার জ্বালায় তার পরিবারের সদস্যদের কচি ঘাস সিদ্ধ করে খেতে হয়েছিল! বর্তমানে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে খাদ্যদ্রব্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। শুনেছি তখনো চাল-আটা-লবণের মজুদে ঘাটতি ছিল না। কিন্তু মজুদদারদের অতিমুনাফার লোভ সেগুলো সাধারণ মানুষের হাত অবধি পৌঁছতে দেয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির আকাশছোঁয়া দাম ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। যদিও এখনকার পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্টভাবেই ভিন্ন। তবুও চক্র চাইলেই পুরো সিস্টেমকে অকার্যকর বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কয়েক মাস আগের পেঁয়াজকাণ্ডের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। গণমাধ্যমে ত্রাণ চোরদের ছবিগুলো আবারো সেই শঙ্কা জাগায়। তাই এদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। 

অসৎ রাজনৈতিক নেতা, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা অতিমুনাফাপ্রত্যাশী মজুদদাররা মিলে বড় অঘটন ঘটাতে সক্ষম। সরকারকে বিব্রত করার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি সরকারকে কঠোর হস্তে এমন তত্পরতা দমন করতে হবে। এমন যেকোনো অপকর্মের প্রমাণ পাওয়ামাত্রই দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে পুরো ব্যবস্থাপনা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। তাদের ঠেকাতে ব্যর্থ হলে করোনার চেয়েও পরবর্তী সংকট তীব্র হতে পারে।

স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই প্রশংসনীয় কাজ করছেন। জেলা থানা প্রশাসন অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছে। ফেসবুকে আমি যাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি, তাদের কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে অনেক জনপ্রতিনিধিই নিজ এলাকায় যাচ্ছেন না, এমন অভিযোগ রয়েছে। এমনকি স্থানীয় কর্মীরা যোগাযোগ করলেও তারা পাত্তা দিচ্ছেন না। তাদের ব্যাপারে প্রাশাসনিক সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। দু-একজনের ক্ষেত্রে অ্যাকশন নিলেই অন্যরা সতর্ক হবে, জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। 

দীর্ঘায়িত সেবা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত কমিটি করা দরকার। সেক্ষেত্রে যেসব সংগঠন এরই মধ্যে স্বেচ্ছায় মাঠে কাজ করছে, তাদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। তাতে দুটো কাজ হবে। একদিকে দুর্নীতি করার সুযোগ কমবে। অন্যদিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্যোগ মোকাবেলার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে এখন যারা স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ত্রাণ দিচ্ছেন, তাদের আবেগ বাস্তব কারণেই অল্প দিনের মধ্যে হ্রাস পাবে। শিগগিরই তারা নিজ নিজ কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। কিন্তু অসহায় জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা তো নিবারণ করতে হবে।

সামাজিক শৃঙ্খলা: পোশাক খাতের কর্মীদের বেতন-বোনাস ঠিক রাখার জন্য নগদ অনুদান, সহজ শর্তে ঋণদান ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আরো বহু খাত টিকে থাকার লড়াইয়ে রয়েছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ব্যাংক-বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, আবাসিক হোটেল, সংবাদপত্র, ফিলিং স্টেশন, পরিবহন খাতসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ঠিক কয় মাস বেতন-ভাতা দিতে পারবে বা দিতে চাইবে, সেটাও ভাবা দরকার। পোশাক শিল্পে কোয়ান্টিটি বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য শিল্পের কর্মীদের কোয়ালিটি নিশ্চয় উপেক্ষণীয় নয়। তাছাড়া সেগুলো বন্ধ হলে অধিকাংশ মালিকের কিছুই হবে না। কিন্তু কাজ হারাবে আমাদের তরুণ, উদ্যমী, শিক্ষিত বিপুল এক জনগোষ্ঠী। তাদের হতাশ হতে দেয়া যাবে না। ফলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ঋণসহায়তা দিতে হবে। আর সংকটের অজুহাতে তারা যেন কর্মী ছাঁটাই করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ স্বাভাবিক সময় হলে তারা অন্যত্র সুইচ করতে পারত। এখন এই মানুষগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর কাজ না থাকলে, পরিবারের সদস্যরা অভুক্ত থাকলে তখন তারা যেকোনো কাজে লিপ্ত হতে পারে। ফলে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি এমনকি লুটতরাজের মতো ঘটনা বাড়তে পারে। তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন হবে। ফলে তাদের আস্থায় রাখা জরুরি। নইলে আমরা কেউই নিরাপদ থাকব না। গার্মেন্টের মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীরা চাকরি হারালে তাদের অনেকের মধ্যে পতিতাবৃত্তি, মাদক চোরাচালানসহ অন্যান্য অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে। বিভিন্ন অপকর্মের হোতারা তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে। তাই সময় থাকতে বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে ভাবা দরকার।

সাপ্লাই চেইনের বৈচিত্র্যায়ন: কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি অন্যান্য সাপোর্ট সার্ভিসের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা অবশ্যই কমাতে হবে। একবার ভাবুন, চীন বা ভারত যদি কোনো (যুদ্ধ বা অভ্যন্তরীণ সংকটের) কারণে দীর্ঘ সময় জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায় তাহলে আমাদের কতগুলো শিল্প-কারখানা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তখন খাদ্যনিরাপত্তার কী হবে? তাই নিজেরা যেগুলো সম্ভব সেগুলো উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শক্তিশালী বৈচিত্র্যময় করা দরকার। সেক্ষেত্রে বন্ধুরাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ভৌগোলিক কারণে আমরা ভারত চীনের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল। সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও গিভ অ্যান্ড টেক ফর্মুলায় অগ্রসর হওয়া জরুরি। সেটা করা গেলে ক্রমান্বয়ে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে, ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।

বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়ানো অত্যাবশ্যক। আপাতত না হলেও চলে বা কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিতে পারে এমন দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো দরকার। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান জার্মানি এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হতে পারে। বহুজাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বিভিন্ন খাতে বড় বিনিয়োগে তাদের সম্মত করাতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে বহুমুখী সুবিধা পাওয়া যাবে।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা: ডিসেম্বর থেকে মেএই কয়টা মাস বছর ব্যবসার জন্য খুব অনুকূল সময় ছিল। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় যে উৎসবগুলোয় বিপুল পরিমাণ পয়সা হাতবদল হতো, তার প্রায় সব পড়েছে সময়ের মধ্যে। এবারের ঈদুল ফিতরকেন্দ্রিক ব্যবসায় যে খুব নেতিবাচকভাবে প্রভাব পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসবও আমরা নীরবে, ঘরে বন্দি অবস্থায় পার করেছি। যেদিন রাস্তায় পা ফেলার জায়গা থাকে না, সেদিনও সুনসান নীরবতা, খাঁ-খাঁ করছে পথঘাট। এরই মধ্যে স্বাধীনতা দিবস বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বড় অনুষ্ঠানগুলো বাতিল করা হয়েছে। তাছাড়া রমজান মাস শবেবরাতকে কেন্দ্র করেও ভালো ব্যবসা হতো।

অনুষ্ঠানগুলো নীরবে পার হওয়ায় শুধু দোকানদার বা বড় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ব্যাপারটা তেমন নয়; বরং তাদের সরবরাহ চেইনে থাকা লাখ লাখ মানুষ থেমে গেছে। একটা উদাহরণ: গদখালীতে কোটি টাকার ফুল গাছেই শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে ফুলচাষী, দিনমজুর, ফড়িয়া, বেপারি, পরিবহনকর্মী, খুচরা বিক্রেতা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বড় অসহায় হয়ে পড়েছে স্বল্প পুঁজির এসব মানুষ। তারা কারো কাছে হাত পাততে চায় না। কাজ করেই খেতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা তাদের সাহায্য করছে না। এই লাখো-কোটি কর্মীর হাত থেমে গেলে অর্থনীতির চাকাও থমকে যাবে। ফলে তাদের সচল রাখতে উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীদের অন্তত আগামী ছয় মাসের ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করা দরকার।

সেমিনার-সিম্পোজিয়াম টকশোতে উচ্চাভিলাষী বক্তৃতা ছাড়া ফ্রিল্যান্সারদের সত্যিকারের অবদান সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। সমাজের প্রভাবশালীরা যখন দেশের অর্থ বাইরে পাচারের নিত্য-নতুন ফন্দি আঁটে, তখন এই মানুষগুলো ঘরে বসে, পরিবেশ দূষণ না করে, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম না বাধিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ঘরে আনে। কিন্তু তারাও এবার বড় সংকটে পড়বে। এটা যদি ভূমিকম্প বা সাইক্লোনের মতো শুধু বাংলাদেশের বা আঞ্চলিক সমস্যা হতো, তারা দূরবর্তী দেশের বায়ারদের কাছে সেবা বিক্রি করে অর্থের প্রবাহ বজায় রাখতে পারত। কিন্তু এই বৈশ্বিক সংকটে তাদের ভোগান্তি বাড়বে। কীভাবে সাপোর্ট দিলে সংকটে তারা টিকে থাকতে পারবে, সেটাও ভাবা জরুরি।

অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো), ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পে নিয়োজিত অসংখ্য উদ্যোগ থমকে গেছে। কাজ না থাকলে কর্মীদের বেতন দিতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। আবার সেই কর্মীরা দীর্ঘ সময়ে যে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তা ছেড়ে হঠাৎ অন্য কাজেও যেতে পারবেন না। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধার্ত মুখ তো সে কথা শুনবে না। এমনিভাবে নিত্যদিন আমাদের সেবা দেয়া ডেইরি, পোলট্রি, হ্যাচারি, প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি (প্রেস, বাঁধাই, বইয়ের দোকান), ইলেকট্রনিকসামগ্রী, হার্ডওয়্যার দ্রব্যাদি ছোট ব্যবসায়ী (পোশাক, স্টেশনারি, জুতা-স্যান্ডেল, খেলনা প্রভৃতি), রেস্টুরেন্ট মালিক, ফেরিওয়ালা, হকার, নাপিত, রিকশা-ভ্যানওয়ালা, অনলাইন উদ্যোক্তাসবাই অজানা এক শঙ্কার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছেন। তাদের হতাশ হতে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ তারাই নিত্যদিন আমাদের আর্থসামাজিক জীবন রাখেন নির্বিঘ্ন। 

কৃষকের ক্ষমতায়ন: প্রশিক্ষণবিহীন, স্বশিক্ষিত মানুষগুলোর হাতেই যুগের পর যুগ আমাদের খাদ্য উৎপাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি। কিন্তু আগামী দিনের বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের জন্য পরনির্ভরশীলতা অবশ্যই কমাতে হবে। এখানে প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগানো যায়। তাই সেদিকে আমাদের গভীরভাবে মনোযোগী হতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদন, মজুদ, বণ্টন, মূল্যনির্ধারণ প্রতিটি পর্যায়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।

সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত অনেক সময় বড় সুফল বয়ে আনে। সম্প্রতি পাটবীজের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় কৃষিকাজে সেচের জন্য শ্যালো মেশিন ব্যবহার করা হয়। এর জ্বালানি তেলের (ডিজেল) উচ্চমূল্যের কারণে প্রয়োজনীয় সেচ দেয়া কৃষকের জন্য কষ্টকর হয়। তাই অন্তত চলতি মৌসুমে ডিজেলে বড় ভর্তুকি দিলে তাদের বড় ধরনের সাহায্য করা হবে।

গ্রীষ্মের ফল (আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি) জনসাধারণের কাছে সম্পূরক খাদ্য হিসেবে সমাদৃত। শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের চাহিদা পূরণেও এগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তাই এক্ষেত্রে ব্যবহূত বিভিন্ন কীটনাশক, বালাইনাশক ছত্রাকনাশকের দাম কমানো গেলে উৎপাদন খরচ কমে আসত। সেগুলো সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব হতো। তাছাড়া কৃষিতে আজকাল শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বণ্টনকৃত চারটি সারের পাশাপাশি সম্পূরক উপাদান হিসেবে মানসম্মত বরিক অ্যাসিড, জিংক সালফেট, জিপসাম ইত্যাদি প্রয়োগ হয়। সেগুলোর দাম বেশি হওয়ায় কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। ফলে এগুলোও সরকারি ব্যবস্থাপনায় বণ্টনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদে কৃষির দিকে আমাদের মনোযোগ দিতেই হবে। তাই আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষকদের মোটিভেশন দেয়া দরকার। এই কঠিন সময়ে কম দামে সেগুলো কৃষকের হাতে তুলে দিলে দীর্ঘমেয়াদে ফল ভোগ করা যাবে। অবহেলিত কৃষি খাতই যেকোনো দুঃসময়ে আমাদের সাহায্য করতে পারবে। 

পরিশেষে, মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে করোনা সরাসরি দুটোতে (খাদ্য চিকিৎসা) আঘাত করেছে। কিন্তু বন্যা, সাইক্লোন, দাবানল, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আরো বেশি দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে অর্থে এটা মোকাবেলা করা তুলনামূলকভাবে সহজ হওয়ার কথা। আজ করোনা বিদায় নিলে কালই পূর্ণোদ্যমে কর্মজীবন শুরু করা সম্ভব। তাছাড়া সিডর, আইলার মতো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। দেশের কোটি কোটি মানুষ নিজের চেষ্টাতেই বিপদে-আপদে করণীয় ঠিক করে নেয়। তদুপরি যেকোনো পরিস্থিতিতে বাঙালির খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা অতুলনীয়। তার প্রমাণ হলো, দেশে থাকতে যে ছেলেটা কখনো গ্লাসে পানি ঢেলে খায়নি, সে বিদেশে গিয়ে প্রতিদিন ১৮-২০ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। বিস্ময়করভাবে, কারো কাছে কোনো অভিযোগ করে না। ফোনে হাসিমুখে মা-বাবাকে বলে, খুব ভালো আছি! সেই দেশের মানুষ হেরে যেতে পারে না। খুব শিগগিরই আমরা ঘুরে দাঁড়াব। সবাইকে বাংলা নবর্ষের শুভেচ্ছা! শুভ হোক আগামীর পথচলা...

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন