অনিশ্চয়তায় বিদেশফেরত ৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিক

মনজুরুল ইসলাম

মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানিতে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতেন বরগুনার দেলোয়ার হোসেন। দুই মাসের ছুটি নিয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসেন তিনি। মালয়েশিয়া ফেরত যাওয়ার জন্য গত ১০ এপ্রিলের টিকিটও করা ছিল তার। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে তা আর সম্ভব হয়নি। চুক্তিভিত্তিক হওয়ায় ছুটি চলাকালে কোনো বেতনও পাবেন না তিনি। পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তিনি মালয়েশিয়ার ওই কোম্পানিতে আবার কাজ নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, সে বিষয়টিও নিশ্চিত নয়।

একই পরিস্থিতিতে আছেন দীর্ঘ আড়াই বছর সৌদি আরবে প্রবাস জীবন কাটিয়ে গত জানুয়ারি মাসে দেশে ফেরা দিনাজপুর নিবাসী মো. শাহ আলমও। এক মাসের ছুটিতে দেশে এলেও নভেল করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে সৌদি আরবে ফেরেননি তিনি। কবে যেতে পারবেন, সে নিশ্চয়তাও নেই। আবার দেশেও এখন নতুন করে কোনো চাকরিতে ঢোকার পরিস্থিতি নেই।

এভাবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ছুটি নিয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীদের বড় একটি অংশই এখন চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। আবার প্রবাসীদের নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক থাকায় দেশে ফিরে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে থাকতে হচ্ছে তাদের।

পুলিশের বিশেষ শাখার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে পর্যন্ত লাখ ৬৯ হাজার ৩৭৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। এর মধ্যে শ্রমিক আছেন প্রায় লাখ। এদের মধ্যে মার্চের প্রথম ২০ দিনেই এসেছেন লাখ ৯৩ হাজার।

১৫ বছর সিঙ্গাপুরে কাজ করার পর সম্প্রতি দেশে এসেছেন স্বপন মিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলাম। কিন্তু এখন যেতে পারছি না। কোম্পানি থেকে বলা হয়েছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যেতে পারব। কিন্তু কবে সব ঠিক হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সিঙ্গাপুরে অন্য যারা আছেন, তারা বাসায় থেকেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু আমার মতো যারা দেশে এসেছেন, তাদের কী হবে?

তিনি বলেন, এখানে অনেকের অবস্থা আমার মতোই। বিরাট সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা না পেলে আমরা আর টিকতে পারব না।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকার সেসব দেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেয়ার ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির নিশ্চয়তা দিয়েছে। তার পরও স্বস্তিতে নেই প্রবাসীরা। তাদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একসঙ্গে অনেক শ্রমিক কর্মস্থলে ফিরে যেতে উড়োজাহাজের টিকিটের খোঁজ করবেন। ফলে চাহিদা বেড়ে সে সময় দাম বাড়তে পারে টিকিটের।

সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। ধস নেমেছে দেশগুলোর পর্যটন এয়ারলাইনস ব্যবসায়। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও। ফলে সামনের দিনগুলোয় কাজ হারানোরও আশঙ্কা রয়েছে প্রবাসীদের মধ্যে। এছাড়া পুঁজি হারানোর ভয় করছেন বিভিন্ন ছোট মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশীরা। এসব প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো কাজ করা বাংলাদেশী শ্রমিক যারা দেশে এসেছেন, তারা কবে যেতে পারবেন; তার নিশ্চয়তা নেই। 

প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক . সিআর আবরার বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে সবসময়ই বড় অবদান রেখে আসছে। এখন নভেল করোনাভাইরাসের কারণে কাজ না থাকায় অনেকেই দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। আবার যারা ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন, তারাও পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। সরকারের এখনই উচিত তাদের জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর ব্যবস্থা করা।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দা হলে অনেক প্রতিষ্ঠান কম জনবল নিয়ে কাজ চালাতে চাইবে। ফলে প্রবাসীদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়তে পারে। বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মার্চ মাসে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। আর আগের মাস ফেব্রুয়ারির চেয়ে কম ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ডিসেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। জানুয়ারিতে এসেছে ১৬৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে দেশে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ ছিল ১৪৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন