ড্যানিয়েল ডিফোর প্লেগ ইয়ার ও বর্তমান বিশ্ব

মিল্টন বিশ্বাস

ইউরোপে চৌদ্দ শতকেব্ল্যাক ডেথবা প্লেগের মহামারীর সময় (১৩৪৮) ইতালিতে উদ্ভব হয়েছিলকোয়ারেন্টিনব্যবস্থা। সতেরো শতকে লন্ডন প্লেগে মাত্র ১৮ মাসে প্রায় এক লাখ মানুষ মারা যাওয়ার সময় ওই একই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। বিশেষত ১৬৬৫ সালে পুরো লন্ডন শহর পরিণত হয়েছিল কবরস্থানে। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে অসহায় নগরবাসী তখন অদৃশ্য শত্রুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করত। সেই সময় আক্রান্ত পরিবারের বাড়ির দরজায় লাল রঙের ক্রুশ এঁকে চিহ্নিত করা থাকত এবং লেখা থাকত—‘ঈশ্বর আমাদের করুণা করুন।লাল নিশান ওড়ানোর দৃশ্য ২০২০ সালের পৃথিবীতেও দেখা যাচ্ছে। প্লেগ বা কলেরা মহামারীর বিবরণ আছে অনেক বিখ্যাত লেখকের রচনায়। বোক্কাচ্চিওরডেকামেরনেইতালির প্লেগের বর্ণনা আছে। কবি জিওফ্রে চসারক্যান্টারবারি টেলসে প্লেগের কথা লিখেছেন। ড্যানিয়েল ডিফোর (১৬৬০-১৭৩১) ‘ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’ (১৭২২) উপন্যাসটির শুরু হয়েছে লন্ডনের বাইরে অরেকটি শহরে প্লেগ মহামারীর ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর খবর দিয়ে। তখন কেউ কেউ ভেবেছিল এটি এসেছে ইতালি থেকে। ডিফো উপন্যাসে তার কাকা হেনরি ফো- চোখ দিয়ে উপস্থাপন করেছেন মহামারীর বীভত্সতা। আক্রান্ত মানুষের শঙ্কা, মৃত্যুভীতি, মানসিক যন্ত্রণা আর কোয়ারেন্টিন সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় শূন্য হয়ে পড়া শহরের সড়ক অলিগলির চিত্র রয়েছে তার গ্রন্থে। আলবেয়ার কামুরদ্য প্লেগ’ (১৯৪৭ লা পেস্তে) উপন্যাসে দেখা যায়, ১৯৪০ সালের গোড়ার দিকে আলজেরিয়ার ওরাঁ শহরে প্লেগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন ওরাঁ শহরটি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মানুষগুলো কোয়ারেন্টিনে থেকেই বেঁচে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। পাল্টে যায় তাদের আচার-আচরণ প্রাত্যহিক জীবনধারা। আখ্যানের কথক ডাক্তার বার্নার্ড রিয়েউঁ সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হন। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ক্যারিবীয় অঞ্চলের পটভূমিতেলাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (১৯৮৫) লিখেছেন, যেখানে কলেরায় আক্রান্ত মানুষকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা ডাক্তার উরবিনোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আলবেয়ার কামু মার্কেজ এই উভয় ঔপন্যাসিক ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে রূপকের আবরণে প্লেগ কলেরাকে মানবজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরশ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহপথের দাবিউপন্যাসে ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রসঙ্গ রয়েছে। অন্যদিকে ১৮৮১ সালে ঢাকায় মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ আছে দীনেশচন্দ্র সেনের (১৮৬৬-১৯৩৯) আত্মজীবনীঘরের কথা যুগসাহিত্য’ (১৯২২) গ্রন্থেরঢাকায় ওলাউঠাশীর্ষক অংশে।

.

তবে ড্যানিয়েল ডিফোর জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ারউপন্যাসকে সামনে রেখে আমরা আমাদের বর্তমান বিশ্বকে দেখতে চাই। বাংলাদেশে মার্চের প্রথম কেসটি নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল নভেল করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। সরকার ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণার পর ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব অফিস এখন বন্ধ। বেশকিছু মানুষ তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাজধানী ছেড়েছে। ঢাকায় যারা হোম কোয়ারেন্টিনে অবস্থান করছেন এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন, তাদেরকে বেশকিছু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা গেছে। অনেকেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কিত। করোনায় মৃত্যুহার দশমিক ২৩ শতাংশ হলেও তারা বিভিন্ন গুজবে বিশ্বাস করে নিজেদের এবং তাদের পরিবারকে বাড়িতে রেখেও কবিরাজি বা ঔষধি দাওয়ায় বিশ্বাসী হয়েছেন; কেউ কেউ মসজিদ বা ধর্মগৃহে জড়ো হয়েছিলেন; অন্যরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভাগ্যগণনাকারীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন; আরো অনেকে অদৃশ্য ভাইরাসকে অস্বীকার করে বা জনসাধারণের মধ্যে এটি দৃশ্যমান ভয় দেখেও নিজের খেয়ালখুশিমতো বিচরণ করেছেন। 

ড্যানিয়েল ডিফোর উপন্যাসের কাহিনীসূত্রে আমরা দেখতে পাই, সতেরো শতকে প্লেগের মহামারী প্রতিরোধে লন্ডন নগরের তৎকালীন প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে মেয়র একাধিক আদেশ জারি করেন, যা কঠোরভাবে অনুসরণ করায় মেট্রোপলিটন জীবন বদলে যায়। জনসাধারণের সামাজিক অনুষ্ঠান জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, স্কুল বন্ধ ছিল এবং পুলিশি দায়িত্ব পালনকে সহজীকরণের জন্য শহরটিকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছিল। সংক্রমিত ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে তাদের বাড়িতে অবরুদ্ধ ছিলেন এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ কিংবা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থেকে বের হওয়া ছিল নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধি জারি হয়েছিল। আইন জারি হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি অনুসন্ধানকারী, জনগণের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণকারী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত ব্যক্তিরা নাগরিকদের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা তদারক করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। উপন্যাসে উপস্থাপিত ঘটনা ছিল ১৬৬৫ সালের লন্ডনের। সেটি বর্তমানের ঢাকা, উহান, মিলান কিংবা নিউইর্য়ক নয়। আর ১৬৬৬ সালের আগেই প্লেগে (বুবোনিক) লন্ডন শহরের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মৃত্যুবরণ করেছিল। চিত্রটি যতটা ধ্বংসাত্মক ছিল, হয়তো তার চেয়ে ওই পরিস্থিতি আরো খারাপ ছিল।

ড্যানিয়েল ডিফোর জার্নাল অব প্লেগ ইয়ারের অন্যতম গ্রহণযোগ্যতা হলো, ভয়াবহ বিপর্যয়ের অনুপুঙ্খ বিবরণ। ১৭২২ সালে প্রকাশিত ডিফোর গ্রন্থটি একটি উপন্যাস, তবে ঐতিহাসিক মহামারী বিজ্ঞানীরামহামারী দুর্যোগে লন্ডনের জীবনের যথার্থ প্রতিবেদন হিসেবে এটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ডিফো, যিনি তার উপন্যাসরবিনসন ক্রুসো জন্য সর্বাধিক খ্যাতিমান, তিনি ১৬৬৫ সালে লন্ডনে বসবাস করছিলেন, তবে তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। আজকে আমরা বিশ্বব্যাপী যে নভেল করোনাভাইরাসের মুখোমুখি হয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ এক মহামারী নিয়েপ্লেগ জার্নালেএকজন মধ্যবয়স্ক বর্ণনাকারী লন্ডন শহরের অভ্যন্তরে জীবনের নানা দিকের বিস্তৃত চেহারা উপস্থাপন করেছেন। ডিফো উপন্যাসটি লিখেছিলেন ভবিষ্যতের মানুষকে মহামারীর বর্ণনার মধ্য দিয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য। এজন্য বর্ণনাকারী বলেছেন, আমি বিষয়টিকে পুরোপুরিভাবে স্থির করে রেখেছি যে আমার পরে যারা আসবেন, যদি তারা একই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন তাহলে সেই মুহূর্তগুলোর রূপ কেমন হতে পারে তা বুঝতে পারবেন। জার্নালের লক্ষ্য ছিল এমন একটি অনুপুঙ্খ প্রতিবেদন তৈরি করা, যা ভবিষ্যতের মানবসমাজ যখন রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তখন যেন নিজেদের পথ বাতলে নিতে পারে। অন্যান্য বিস্ময়কর মহামারীর বিবরণের সঙ্গে সংঘটিত বিশৃঙ্খলাগুলোর বিবরণ হলেও ডিফোর বইটি প্লেগ নগরীতে উদ্ভূত কঠোর রাজনৈতিক অনুশাসনের পট উন্মোচন করে। বিশ শতকের দার্শনিক মিশেল ফুকো, যার চিন্তা আধুনিক ক্ষমতার ধারণাগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তিনি তারডিসিপ্লিন পানিশগ্রন্থে বিষয়ে তাত্পর্যবহ অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন।

ডিফোর উপন্যাসের আখ্যানাংশ গড়ে উঠেছে মহামারীর পরিধিকে কেন্দ্র করে। যে পরিধির ভেতর রয়েছে প্রচলিত আইনের স্থগিতাদেশ, নিষেধাজ্ঞা প্রতিপালন, শঙ্কা নিয়ে সময় পার করা আর শ্রদ্ধা জানানোর আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াই ধনী-গরিব নির্বিশেষ মরদেহগুলোকে কবরস্থ করা। ফুকো লিখেছেন, প্লেগের একটি রাজনৈতিক দিকও ছিল, যা ঠিক যৌথ উত্সব উদযাপনের বিপরীত; যা ছিল আইন লঙ্ঘন না করে কঠোরভাবে বিচ্ছেদ তৈরি করা; যা দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্রতম নিয়ম-নীতির ব্যত্যয়ও বটে। মহামারীকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করার জন্য তৎকালীন প্রশাসকদের এই রাজনৈতিক সংকল্পটি ফুকোর মতো ডিফোও বুঝতে পেরেছিলেন।

১৬৬৫ সালে লন্ডন শহর দ্বারা গৃহীত সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থাটি ছিল সংক্রমিত সব ব্যক্তিকে পরিবারের অন্য সুস্থ সদস্যদের সঙ্গে তাদের বাড়িতে তালাবদ্ধ (কোয়ারেন্টিন) রাখতে বাধ্য করা। ডিফো স্বীকার করেছেন, এর ফলে সংক্রমিত জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে খুব বড় অসুবিধা সৃষ্টি করে এবং কিছু ঘটনা ছিল মর্মান্তিক। তবে এটি ছিল লন্ডনের প্রশাসকদের একটি আইন জারি করা অনুমোদিত ব্যবস্থা, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল জনগণের মঙ্গল এবং জনসাধারণের উপকারের জন্য কারো কারো ব্যক্তিগত চরম ক্ষতি সেদিন মেনে নিতে হয়েছিল।

প্লেগের মহামারীতে আক্রান্ত স্বজনদের সঙ্গে একই ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে অনেক লোকই অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিল। তবে সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের রাস্তায় ফেলে রেখে আবার অনেকে বেঁচেও ছিল। ডিফো জোর দিয়ে বলেছেন যে ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল সংক্রমিত ব্যক্তির আচার-আচরণ। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের সন্তান আত্মীয়স্বজনকে আলিঙ্গন-করমর্দন করেছেন, নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে জীবাণু ছড়িয়ে সুস্থ মানুষকে মৃত্যুর কোমল স্পর্শ দিয়েছেন, অচেনা মানুষের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছেন। সেদিন রকম পরিস্থিতিতে জনগণকে ভালো অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়া প্লেগ প্রতিরোধের বাধ্যবাধকতা ডিফোর লন্ডনবাসীকেও মেনে চলতে হয়েছিল।

রাস্তায় পড়ে থাকা মরদেহগুলো সরিয়ে গণকবরে স্থানান্তর করার কাজটি ছিল সর্বাধিক কষ্টসাধ্য। এই গুরুতর কাজটি সম্পাদন করার দায়িত্ব ছিল সমাজের দরিদ্র পিছিয়ে পড়া পুরুষদের, যারা প্লেগে আক্রান্ত না হওয়া অবধি তাদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর আক্রান্ত হওয়ার পর অন্য সুস্থ ব্যক্তিরা সেই কাজে নিয়োজিত হতেন। ডিফো এই মানুষদের কাজকে খুব প্রশংসা করে বলেছিলেন, লন্ডনে সে সময় জীবিতরা মৃতদের কবর দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ডিফো তারপ্লেগ জার্নালেতৎকালীন সরকার লন্ডনকে যেভাবে পরিচালনা করেছিল, তার জন্য ব্যাপক প্রশংসা করেছেন, বিশেষত জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণের মতো ছোটখাটো ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের মতো আরো উল্লেখযোগ্য কাজ তার দৃষ্টিতে ভালো মনে হয়েছিল। তবে তিনি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলোর অভাবকে দুঃখ করে বলেছিলেন, এই বড় শহরের বাড়িগুলো গাদাগাদির কারণে এখন কীটপতঙ্গের বসতিতে পরিণত হয়েছে।

আমরা দেখতে পাই বর্তমান বিশ্বের সরকারগুলো কভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন ভিন্নভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে চীন প্রথম থেকেই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মিডিয়া মারফতে উঠে এসেছে। তাদের কঠোরভাবে প্রয়োগ করালকডাউনএবং দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রিতসামাজিক দূরত্বে ব্যবস্থাগুলো ডিফো কর্তৃক চিত্রিত ১৬৬৫ সালের লন্ডন শহরের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে লন্ডনে সে সময় সুস্থ পরিবারের সদস্যদের অসুস্থদের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল, যা করোনাকালে আধুনিক চীন করেনি। সেখানে প্রথম থেকেই অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের সুস্থ আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, নাগরিকদের প্রায় সবারই করোনা পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। উপরন্তু বিভিন্ন লক্ষণের রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা ছিল। জ্বরে আক্রান্ত রোগীর কেন্দ্রগুলোর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়। সেখানে (চীন) রাষ্ট্রের গৃহীত কঠোর নিয়মনীতির ক্ষেত্রে নাগরিক স্বাধীনতা কোনো বিবেচ্য বিষয় ছিল না। কারণেই চীনের গোটা জাতি সংক্রমিত হয়ে ডিফোর প্লেগ নগরীতে পরিণত হয়নি। পক্ষান্তরেকোয়ারেন্টিনব্যবস্থার প্রচলনকারী দেশ ইতালি করোনা সামলাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও একইভাবে বিপর্যস্ত।

পুঁজিবাদী বিশ্বে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও মিশেল ফুকোর ক্ষমতা প্রয়োগের তাত্ত্বিক দৃষ্টি এখানে প্রয়োগ করা যাবে না। স্বাধীন মতাদর্শ এবং নিজেদের স্বার্থে জাতীয় নীতির অগ্রগামিতা দিয়ে আমরা পরিচালিত হই। যদিও মানগুলোর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তবে যার অভাব রয়েছে ব্যাপকভাবে তা হলো, এই আবশ্যকতার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মকৌশলপত্রের অনুপস্থিতি। আসলে জনগণের মঙ্গলের জন্য মহামারীকে পরাস্ত করতে আমরা অবশ্যই সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রীয় নীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ সম্পর্কে ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াগুলো ব্যাখ্যা করে দেখা গেছে বিদেশ থেকে আসা কোনো যাত্রী, যিনি করোনাভাইরাস পরীক্ষা গ্রহণের পরে ঢাকায় আসা বিমানে চড়েছিলেন (এবং যাত্রী জানতেন তিনি পজিটিভ) বা দেশে পৌঁছে হোম কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করে মিশেছেন নিজের পরিবার সমাজের লোকের সঙ্গে এবং তার অজ্ঞতার পরিচয় ইচ্ছাকৃত অবহেলা থেকে আমরা সংক্রমিত হয়েছিএভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ মানুষগুলো আমাদের জন্য এখনো হুমকির কারণ।

উপরের পর্যালোচনা থেকে আমরা একটি সূত্র গ্রহণ করতে পারি তা হলো, প্রকৃতি কিংবা মানবসৃষ্ট মহামারীর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে শেখ হাসিনা সরকারের প্রাথমিক কর্মসূচি ব্যবস্থাদি গ্রহণ ছিল যথার্থ। করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের যত্ন প্রদর্শন বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত ছিল। যদিও দেশের নির্বাহী ক্ষমতা থেকে শেষ পর্যন্ত একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা আসবে কিনা, আমরা তা জানি না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলে সেই জরুরি পদক্ষেপের কথা বলা দরকার হতে পারে। যারা পরিস্থিতি উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের কথা বলেছেন, তার প্রতিও রাষ্ট্রের আগ্রহ থাকতে পারে। এক মাস পরই শেয়ারবাজারের পুনরুজ্জীবন রফতানি বাণিজ্যের পূর্বাবস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

.

সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের জনসাধারণের পক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ করছে। শেখ হাসিনা সরকার যেমন তাদের নির্দেশনাকে গুরুত্বের সঙ্গে মেনে নিয়ে দেশব্যাপী করোনা শঙ্কা দূর করার জন্য সচেষ্ট, তেমনি শঙ্কিত জনগণও রাষ্ট্রের মোকাবেলা পদ্ধতি গ্রহণ করে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সক্রিয়। কভিড-১৯ মোকাবেলায় দেশের বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করছে। উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে চীন যে ধরনের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত আমাদের সরকার চূড়ান্তভাবে অনুসরণ করবে বলে আমরা মনে করি। সরকার চীনের মতো কঠোর নীতি অবলম্বন করলে তা ডিফোর প্লেগ জার্নালের অন্তর্নিহিত বার্তাকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেবে। কারণ সংক্রামক রোগ ক্রমাগত বিস্তার লাভের চেয়ে ভীতি প্রদর্শন উত্তম।

. মিল্টন বিশ্বাস: বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট; সাধারণ সম্পাদক, প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন